অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৫

কোজাগরি লক্ষ্মী পূজা: আলোর আহ্বান ও নারীর মর্যাদার নীরব যুদ্ধ

 


কোজাগরি লক্ষ্মী পূজা: আলোর আহ্বান নারীর মর্যাদার নীরব যুদ্ধ

==================================
ভাস্কর পাল

 ==================================


পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করে উঠেছে শরৎরাত। আকাশে যেন সাদা অঞ্জলি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেবী নিজে। চারদিকে প্রদীপের সারি, শঙ্খধ্বনি, মন্ত্রের মৃদু গুঞ্জন। আর সেই সুরের ভিতর দিয়ে ভেসে আসে এক পুরনো প্রশ্ন
কে জাগো?”
এই প্রশ্নটি আজও আকাশে ঝুলে আছে, কিন্তু উত্তর কোথায়?
আমরা কি সত্যিই জেগে আছি?
না কি আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন নারীকে অপমানিত হতে দেখে আমরা কেবল নীরব দর্শক হয়ে আছি?


জাগরণের উৎসব, অথচ সমাজ নিদ্রিত


কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার মর্মকথা ছিল জাগরণঅন্তরের জাগরণ, নৈতিক জাগরণ। দেবী নাকি এই রাতে খোঁজেন কে জাগ্রত, কে পরিশ্রমী, কে শুচি। কিন্তু আজকের সমাজে এই প্রশ্ন শুনে দেবী হয়তো নিজের চোখ ঢাকেন।
যে দেশে একের পর এক নারী ধর্ষিত হয়, যে রাজ্যে অপরাধীরা প্রশাসনের চেয়ারে বসে ন্যায়বিচারের ভাষণ দেয়সেই দেশে কিসের জাগরণ?
আজ নারী আরগৃহলক্ষ্মীনন, তিনি হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞাপনেরব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর তার হাসি বিক্রি হয়, তার সৌন্দর্য প্যাকেটবন্দি হয়। মিষ্টির বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে গাড়ির শোরুমসবখানেই নারীকে পণ্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সমাজ তারই দর্শকচোখে গ্লসি ম্যাগাজিনের আলো, মনে নৈতিক অন্ধকার।


গৃহলক্ষ্মী থেকে বাজারের প্রতিমা

কোজাগরি পূজার নারীরা একসময় আলপনা আঁকতেন, প্রদীপ জ্বালাতেন, সংসারের প্রতিটি কোণে আলো ছড়াতেন। আজ তাঁদেরই এক অংশ দগ্ধ হচ্ছে নির্যাতনে, নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে সংবাদপত্রের এক কলামে।
আরেক অংশবাজারের বিলবোর্ডে বন্দি, প্রসাধনের ব্র্যান্ডে ঝুলছে তাদের মুখ।
দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক আজ হয়ে গেছেগ্ল্যামার”—আলোকিত তবু অন্ধকার।
এই সমাজেআলোকমানে কেবল বৈদ্যুতিক জৌলুস, ‘শুচিতামানে চেহারার মেকআপ। অথচ কোজাগরি পূজার আসল আলো ছিল ভেতরের আলোসেই আলোর নাম সততা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা।

ধন, ধর্ম আর ধ্বংসের সীমারেখা

এই পূজার শিক্ষা ছিল সহজধন তখনই পবিত্র, যখন তা শ্রমে অর্জিত, সংযমে ব্যবহৃত।
আজ ধন এসেছে লুটে, প্রতারণায়, ক্ষমতার বাণিজ্যে।
রাজ্যে রাজ্যে কর আদায়ের নামে বাড়ছে বৈষম্য, আবার একই রাজ্যে নারীর রক্তে রঙিন হচ্ছে পাথর।
দেবী যদি সত্যিই জাগ্রত থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই এই রাজ্যের আকাশে আর নামেন না।
এই পূজার আগে ঘর ঝাড়পোঁছ করা ছিল ঐতিহ্যময়লা ঝেড়ে ফেলা, মনের ধুলো ধোয়া।
কিন্তু সমাজের এই ময়লা আমরা কোথায় ফেলব?
যেখানে অপরাধীর মুখেই ধর্মের বুলি, যেখানে ন্যায়বিচার হয় বিলম্বের বন্দি, সেখানে পূজার আলপনা কেবল বাহ্যিক সাজ।


নারীর ভূমিকাপ্রতিমা থেকে প্রতিবাদে

এই পূজায় নারী ছিলেন দেবীর প্রতিমূর্তিতিনি আলো জ্বালাতেন, সংসার সাজাতেন। আজ তাঁকেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অন্ধ অমানবিকতায়।
এই পূজার প্রতিটি মন্ত্র আজ যেন একেকটি আর্তনাদ
ওঁ মহালক্ষ্ম্যৈ নমঃ”—
মানে আজ যেন দাঁড়িয়ে আছে
হে দেবী, তুমি কোথায়? তোমার কন্যারা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
তবু, এখনও কিছু নারী আছেন, যারা এই সমাজের শ্বাসরোধের ভিতরেও প্রদীপ জ্বালান।
তারা পূজার মন্ত্রে নয়, বাস্তবের প্রতিবাদে জেগে ওঠেন।
তারা আলপনা আঁকেন না, কিন্তু আঁকেন নতুন ভবিষ্যতের মানচিত্র।
এই নারীরাই আজকের সত্যিকারের লক্ষ্মীযাঁরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আলো তৈরি করেন।


গৃহস্থের বার্তাভোগ নয়, ভক্তি

কোজাগরি পূজার আদর্শ গৃহস্থের শিক্ষা দেয়
যে গৃহে পরিশ্রম আছে, স্নেহ আছে, সংযম আছে, সেই ঘরেই দেবী আসেন।
কিন্তু আজ আমাদের ঘর ভরে উঠেছে প্রতিযোগিতা, অহংকার, ভোগবাদে।
আমরা ধন চাই, কিন্তু ন্যায়ের আলো চাই না।
আমরা দেবীর পূজা করি, কিন্তু নারীকে অপমান করি।
এই দ্বিচারিতার রাজ্যে দেবী কীভাবে আসবেন?
তিনি তো চঞ্চলাসেখানে যান না যেখানে অন্যায় বাসা বাঁধে, যেখানে নারীর চোখে ভয়, মুখে নীরবতা।


লক্ষ্মীর আহ্বানআলোয় নয়, বিবেকে

পূর্ণিমার এই রাতে প্রদীপ জ্বালানোর মানে কেবল সৌন্দর্য নয়এটি এক প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত।
প্রতিজ্ঞা যে, আমরা অন্যায়ের পাশে নীরব থাকব না।
যে, আমরা নারীকে দেবী বলে পূজা করব না, মানুষ বলে সম্মান করব।
যে, আমরা বুঝবলক্ষ্মী কেবল সম্পদের দেবী নন, তিনি ন্যায়ের প্রতীক।


দেবী যেন আজও আকাশে সেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন
কে জাগো?”


আর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কেবল সেই সমাজ, যেখানে নারী অবমাননা থেমে যায়, যেখানে অর্থ নয়, ন্যায়ই প্রধান, যেখানে ভোগ নয়, বিবেকই পূজা।


তাই শেষ কথা

কোজাগরি লক্ষ্মী পূজা একসময় ছিল গৃহের পবিত্রতার প্রতীক; আজ এটি হয়ে উঠেছে আত্মজিজ্ঞাসার আয়না।
এই আয়নায় আমরা দেখতে পাই নিজেদের মুখক্লান্ত, মলিন, কিন্তু এখনও আলোর আশায়।
যদি সত্যিই দেবীর কৃপা চাই, তবে প্রদীপের আলোয় নয়, অন্তরের আলোয় ফিরতে হবে।
নারীকে পণ্য নয়, প্রেরণা হিসেবে দেখতে শিখতে হবে।
তাঁর স্নেহ, তাঁর শ্রম, তাঁর প্রতিবাদএই তিনিই আজকের সমাজের প্রকৃত ধন।
যে ঘরে এই তিনটির মর্যাদা থাকবে, সেই ঘরই হবে লক্ষ্মীময়, আর সেই সমাজই হবে জাগ্রত।