অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অসুর আখ্যান: মহিষাসুরের স্মৃতি, জাতিচেতনা ও সংস্কৃতির দ্বৈরথ

 


======================================

ভাস্কর পাল

======================================

"অসুর থাকবে কতক্ষণ, অসুর যাবে বিসর্জন।"— এই যে পঙ্‌ক্তি, যা বাঙালির পূজামণ্ডপে বিজয়োল্লাস ও আনন্দের আগমনী বার্তা বহন করে, ঠিক তার তলায় চাপা পড়ে আছে এক ভিন্ন সুর। এই সুর হলো ভারতের প্রান্তিক জনজাতির দীর্ঘশ্বাস ও বঞ্চনার, এক ঐতিহাসিক পরাজয়ের করুণ স্মারক। আপনার প্রদত্ত তথ্যসম্ভার সুস্পষ্টভাবে দেখায়, কীভাবে পৌরাণিক আখ্যানের অশুভ অসুর আজ বাস্তবের অসুর উপজাতির কাছে এক মহান পূর্বপুরুষ এবং তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক। এটি কেবল ধর্মীয় বিতর্ক নয়, বরং নৃতাত্ত্বিক চেতনার পুনর্জাগরণ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ।

 

ঐতিহ্যের ভার: লৌহ কারিগর থেকে বিপন্ন আদিবাসী

অসুর উপজাতি হলো ভারতের একটি ক্ষুদ্র, অস্ট্রো-এশিয়াটিক আদিবাসী গোষ্ঠী (PVTG), যাদের ভৌগোলিক অবস্থান মূলত ঝাড়খণ্ড (ঘুমলা, লাতেহার) এবং পশ্চিমবঙ্গের (মালদা, ডুয়ার্স) পার্বত্য অঞ্চলে। তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কেবল ভূমিপুত্র হিসেবে নয়, বরং লৌহ গলানোর আদিম কারিগর হিসেবেও।

১. পরিচয় ও প্রযুক্তি: সংস্কৃতিতে প্রোথিত লৌহ

ঐতিহ্যগতভাবে, অসুরদের লোহা গলানোর পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উন্নত। অসুর নারীদের গান গেয়ে চুল্লিকে 'গর্ভবতী মায়ের' সঙ্গে তুলনা করার এই প্রথা তাঁদের সংস্কৃতিতে জীবন, শিল্প ও প্রজননের এক গভীর সংযোগকে তুলে ধরে। এটি তাঁদের সাংস্কৃতিক সত্তার মূল ভিত্তি। অসুর উপজাতির লোকগাথায় যে মহিষাসুর বা হুদুড়দুর্গা স্থান পেয়েছেন, তিনিও কেবল রাজা নন, বরং ধাতুবিদ্যায় পারদর্শী এক আদিম পূর্বপুরুষ। এই ঐতিহ্যই তাঁদের পৌরাণিক পরিচয়কে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, যেখানে অসুররা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে দাবি করেন।

তবে আজকের অসুর সমাজ এক চরম সংকটের মুখে। তাদের ভাষা 'আসুরি' মুন্ডা ভাষা গোষ্ঠীর অংশ হলেও, ইউনেস্কো কর্তৃক এটি 'নিশ্চিতভাবে বিপন্ন' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মূলধারার সমাজে একীভূত হওয়ার তাগিদ তাঁদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ম্লান করে দিচ্ছে।

২. অর্থনৈতিক রূপান্তর: উন্নয়নের দ্বন্দ্ব (Development Paradox)

অসুরদের জীবনে সবথেকে বড় আঘাতটি এসেছে অর্থনীতির দিক থেকে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি এবং আধুনিক বাজারের কাছে পরাস্ত হয়ে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী লৌহ গলানোর শিল্প ধ্বংস হয়েছে। বর্তমানে অসুরদের ৯১.১৯ শতাংশই কৃষিকাজে জড়িত, অথচ তাঁদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাঁদের জীবনকে আরও করুণ করে তুলেছে; মালদা বা কোচবিহারের 'অসুর গ্রাম'-গুলিতে (যেমন শুকানুকুটি) এখনও ডাল-ভাত জোটে কিছুদিন পর পর।

তাঁদের এই করুণ অবস্থার কারণ নিছক দারিদ্র্য নয়, বরং রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া 'উন্নয়নের দ্বন্দ্ব'। ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার খনিজ ভাণ্ডারে বক্সাইট উত্তোলনের জন্য ডিনামাইট ফাটিয়ে তাঁদের মারাংবুরুর প্রতীক পাহাড়গুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংবিধানের পঞ্চম তপসিল উপেক্ষা করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটি কেবল ভূমি উচ্ছেদ নয়, বরং হাজার বছরের অস্ট্রিক দেবতাকে ধ্বংস করার এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যখন উন্নয়নের নামে বাস্তুচ্যুত আদিবাসীরা ক্ষতিপূরণের বদলে রাষ্ট্রের 'রাষ্ট্রদ্রোহী'র তকমা পায় (যেমন সালওয়া জুডুম বা অপারেশন গ্রিন হান্টের শিকার), তখন তাঁদের মধ্যেকার অসহায়তা তীব্র রাজনৈতিক ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়।

 

শোকের আচার: দাশাই পরব ও সাংস্কৃতিক প্রতি-আখ্যান

দুর্গাপূজার সময় অসুরদের 'দাশাই পরব' পালন কেবল লোকরীতি নয়, এটি মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত নীরব প্রতিরোধ এবং সাংস্কৃতিক প্রতি-আখ্যান (Counter-Narrative) নির্মাণের প্রচেষ্টা।

১. মহিষাসুর: অযৌক্তিক বধের শিকার

হিন্দু পুরাণের বিপরীত, অসুর সম্প্রদায় মহিষাসুরকে তাঁদের 'দয়ালু ও পরাক্রমশালী রাজা' হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তাঁদের বিশ্বাস, বিদেশী আর্য দেবতারা ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাঁদেরই মেয়ে দুর্গাকে (মুন্ডা, কোল, হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দাবি) ব্যবহার করে তাঁদের রাজাকে হত্যা করেছে। এটি 'অযৌক্তিক বধ' (unjust butchering)। এই আখ্যান হিন্দু পুরাণের 'অশুভের উপর শুভের বিজয়'-এর বিপরীতে এক নৈতিক প্রশ্নচিহ্ন স্থাপন করে।

 

বৈশিষ্ট্য

হিন্দু/ব্রাহ্মণ্যবাদী আখ্যান

অসুর/আদিবাসী আখ্যান

ভূমিকা/পরিচয়

দুষ্ট, ছলনাময় রাক্ষস

দয়ালু, শক্তিশালী রাজা, আদিম পূর্বপুরুষ

পরিণতি

দেবী দুর্গার হাতে ন্যায়সঙ্গতভাবে নিহত

একজন গৌরবর্ণা নারীর ছলনায় অন্যায়ভাবে নিহত

প্রতীকবাদ

অশুভের উপর শুভের বিজয়

আদিবাসী সার্বভৌমত্ব ও বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

২. শোকপালন ও প্রতিরোধের ভাষা

দুর্গাপূজার এই দিনগুলিতে অসুররা শোক পালন করেন। এই শোকের অংশ হিসেবে তাঁরা অরন্ধন পালন করেন, এবং পূজার ঢাকের আওয়াজ বা মন্ত্র যাতে কানে না যায় তার জন্য ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাঁদের এই আচার প্রমাণ করে, মূলধারার সংস্কৃতি যেখানে আনন্দের প্রবাহ সৃষ্টি করে, সেখানে প্রান্তিক মানুষের জন্য তা 'অশৌচকাল'

এই শোকের সবচেয়ে প্রতীকী প্রকাশ ঘটে দাসাই নাচে, যেখানে পুরুষ যোদ্ধারা নারী ছদ্মবেশ ধারণ করে হাতে শস্ত্রের পরিবর্তে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রাজাকে খুঁজে বেড়ান। এই আচার সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে ধারণ করে, যখন পরাজিত আদিবাসী যোদ্ধারা নারীর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের বুক চাপড়ে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে ভেসে আসা "হায়রে-ও হায়রে" আওয়াজ স্বজন হারানোর, সমাজে লাঞ্ছনার ও বেদনার প্রতীক।

 

জাতিচেতনার স্ফূরণ: হুদুড় দুর্গা ও সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা

দীর্ঘদিনের এই চাপা ক্ষোভ ও বঞ্চনা আজ এক সংগঠিত সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় রূপ নিয়েছে। এই আন্দোলনকে কেবল ধর্মীয় বিরোধ হিসেবে দেখলে তার গভীরে প্রবেশ করা যাবে না। এটি মূলত দলিত-আদিবাসী-বহুজন সমাজের আত্মমর্যাদার এক পুনর্নির্মাণ।

১. আত্মমর্যাদার নতুন প্রতীক: মহিষাসুর শহিদ দিবস

আদিবাসী সমাজের শিক্ষিত তরুণরা বুঝতে পারছেন, এই অসম লড়াইয়ে অখন্ড জাতিচেতনা অপরিহার্য। তাই একসময় কেবল ক্ষুদ্র 'অসুর' গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মহিষাসুরকে বীর পূর্বপুরুষ হিসেবে পূজা করা— তা আজ সাঁওতাল, মুন্ডা-সহ বৃহত্তর আদিবাসী সমাজের অহংকার

·         প্রতিবাদের মঞ্চ: পুরুলিয়ার ভুলুরডি থেকে দিল্লির জেএনইউ পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। 'মহিষাসুর শহিদ দিবস' বা 'হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা'-র মতো আন্দোলনগুলি হিন্দুত্বের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার একটি সচেতন প্রচেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গে এই স্মরণসভার সংখ্যা ২০০ থেকে বেড়ে ৩,৫০০-এর বেশি হয়েছে। এই সংখ্যাগত বৃদ্ধি প্রমাণ করে, এটি কেবল শোক নয়, বরং অখন্ড জাতিচেতনার নির্মাণের এক সফল রাজনৈতিক প্রয়াস।

·         সংঘাত ও বৈধতা: এই আন্দোলন যখন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদী শক্তির দ্বারা 'দেবী দুর্গার অপমান' হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন তা সরাসরি গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। কারণ, অসুরদের দাবি স্পষ্ট— মহিষাসুরকে তাঁদের বীর পূর্বপুরুষ হিসেবে পূজা করা হবে, কিন্তু তাঁকে কোনো দেবীর পায়ের তলায় অপমানিত করা হবে না।

২. প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ও সংবেদনশীলতা

তবে আধুনিকীকরণ ও মূলধারার সমাজের প্রভাবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই শোকপালনের প্রথা থেকে সরে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা দুর্গাপূজার মেলা ও প্যান্ডেলে যেতে আগ্রহী। বয়স্করা এই পরিবর্তনের কারণে তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানোর ভয় করছেন। এই প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতের অসুর পরিচয়ের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এই পরিস্থিতিতে বৃহত্তর সমাজের উচিত, তাঁদের বিশ্বাস ও আচার-আচরণের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া।

 

বহুত্ববাদ ও মানবিকতার দাবি

অসুর উপজাতির জীবন ও সংগ্রাম ভারতীয় সমাজের সেই জটিল সত্যকে উন্মোচন করে, যেখানে 'উন্নয়ন' ও 'ধর্ম' প্রায়শই প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করে। তাঁদের হুদুড় দুর্গা আখ্যান কেবল অতীতকে ধরে রাখার নয়, বরং মানব হত্যার মন্ত্রকে ধর্মীয় মোড়কে পরিবেশন করার বিরুদ্ধে মানবতার পূজা। এই আন্দোলন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কেবল বিজয়ী নয়, বিজিতেরও ইতিহাস আছে।

আইনি সুরক্ষা, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পুনরুজ্জীবন এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা— এই ত্রিবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমেই এই জনগোষ্ঠীর প্রতি ন্যায় নিশ্চিত করা সম্ভব। অসুরদের এই সংগ্রাম এক সুদূর ভবিষ্যতের দাবি, যেখানে ভারতের সংস্কৃতি তার চিরন্তন বহুত্বকে সম্মান জানাবে এবং কোনও জনগোষ্ঠীকে তাদের পরিচয়ের জন্য লাঞ্ছিত হতে হবে না।

এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইতিহাস সবলে উঠে এসে কৈফিয়ত আদায় করে ছাড়ছে, এবং এই ঘটনা ভারতীয় সমাজকে তার মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করছে।


তথ্য সুত্রঃ

 

en.wikipedia.org

Asur people - Wikipedia

Opens in a new window

Endangered Traditions: The Decline of Asur Culture in Modern India - IJIRT

The Tribe Of Chotanagpur: A Case Study On Asur Tribe ... - IJCRT.org

researchgate.net

Ecopolitics, Extractivism and Indigenous People: Development ...

anandabazar.com

মহিষাসুর  হুদুড় দুর্গা - Anandabazar

zeenews.india.com

Durga Puja 2022: না জেনেই বরাবর অসুর সম্প্রদায়কে অপমান করে এসেছি আমরাএবার বন্ধ হোক

bangla.dhakatribune.com

আজও দুর্গাপূজার সময় মহিষাসুরের অনুসারীরা পালন করেন শোক

হুদুড় দুর্গা - উইকিপিডিয়া

 

 

 


 

 















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন