ইতিহাসের অনিবার্য দ্বৈরথ: গান্ধীর প্রবাহ বনাম আরএসএসের প্রতিস্থাপন
================================================
ভাস্কর
পাল
================================================
গান্ধীকে যদি আমরা কেবল একজন মানুষ বলে চিহ্নিত করি, তবে তাঁর বিশাল বিস্তারকে সংকীর্ণ করি। তিনি আসলে এক প্রবাহ—অন্তহীন, নিরন্তর, অবিরাম। ইতিহাসের আঙিনায় তিনি হেঁটে গিয়েছেন নীরব পায়ে, অথচ তাঁর পদচিহ্ন আজও পৃথিবীর বুক জুড়ে প্রতিধ্বনিত। সত্য ও অহিংসা—এই দুই শব্দ তাঁর হাতের দু’টি প্রদীপ, যে আলোয় ভারত জেগেছিল, জেগেছিল মানুষের অন্তর্নিহিত সাহস। তিনি শিখিয়েছিলেন, শক্তি আসে না অস্ত্র থেকে, আসে আত্মবিশ্বাস থেকে।
গান্ধী ছিলেন না কোনো ক্ষণস্থায়ী
ঝড়; তিনি ছিলেন নদীর মতো—ধীরে ধীরে বয়ে চলা, অথচ অবশেষে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া। তাঁর স্রোতে ছিল শান্তির সুর, আবার ছিল জেগে ওঠা মানুষের তীব্র ডাক। রাজনীতি তাঁর হাতে কখনো ক্ষমতার খেলায় নামেনি; রাজনীতি ছিল মানুষের আত্মমুক্তির পথ। তাঁর জীবন এক আন্তর্জাতিক
নদী—যার প্রবাহ ছুঁয়ে গেছে আফ্রিকা, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহ; মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা—তাঁদের কণ্ঠে শোনা যায় গান্ধীর স্রোতের প্রতিধ্বনি।
২ অক্টোবর ও ২৭ সেপ্টেম্বর: এক আদর্শগত মেরুকরণ
আজ ইতিহাস এক অনিবার্য দ্বৈরথকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। সময় আমাদের দুই ভিন্ন মেরুকে মুখোমুখি করেছে—একটি উৎসারিত হয় ২ অক্টোবর-এর আলোয় (গান্ধীর জন্ম), অন্যটির জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫-এর ছায়ায় (আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা)। একদিকে মহাত্মা গান্ধী—অহিংসা, সত্যাগ্রহ, এবং মানবিকতার অক্ষয় বটবৃক্ষ। অন্যদিকে, আরএসএস—হিন্দুত্ববাদী এককত্বের বীজতলা।
এই দ্বন্দ্বে আজকের রাজনীতি নিছক ক্ষমতার খেলা নয়, এ হলো ভারতের আত্মার সন্ধানে এক মহাকাব্যিক টানাপোড়েন। স্বাধীনতা সংগ্রামে কার্যত অনুপস্থিত থেকেও আরএসএস আজ শতবর্ষপূর্তিতে রাষ্ট্রের শীর্ষে নিজেদের অবতারণা ঘটিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গান্ধী যখন জনগণকে সত্যাগ্রহ ও অসহযোগের মন্ত্রে জাগাচ্ছেন, তখন আরএসএস সীমাবদ্ধ ছিল নিজেদের হিন্দুত্ববাদী ছক গড়তে।
ঠিক এই ঐতিহাসিক ও নৈতিক প্রেক্ষাপটে, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে কেন্দ্র সরকারের আরএসএস-এর ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারক কয়েন ও ডাকটিকিট প্রকাশের সিদ্ধান্ত—স্রেফ একটি স্মারক পদক্ষেপ নয়—রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে তা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
স্মারক
মুদ্রা: প্রতিস্থাপনের প্রতীকী সঙ্কেত
এই স্মারক কয়েন একটি নিছক ধাতুর টুকরো নয়; এটি হলো রাষ্ট্রচেতনার
মূলস্রোতকে এক নতুন রূপে প্রতিস্থাপনের প্রয়াস।
গান্ধীর জীবনে স্বাধীনতা, সত্য ও অহিংসার যে মূল্যবোধ ছিল, তা আজকের ভারতের শাসক গোষ্ঠীর ভাবমূর্তি ও আরএসএস-ভক্তির প্রকল্পের সঙ্গে এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতা ও বৈপরীত্য তুলে ধরে। গান্ধীজীর জন্মদিনের দিনেই আরএসএস-কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যা আসলে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসকে ধোঁয়াশা করার চেষ্টা। স্বাধীনতার মূল ধারার আন্দোলনকে আড়াল করে হিন্দুত্ববাদী
সংগঠনকে সামনে আনা হচ্ছে।
এই বৈপরীত্যই আজকের ভারতের সবচেয়ে তীব্র রাজনৈতিক সত্য:
·
গান্ধীর ভারত ছিল বহুত্বের ভারত, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান একসঙ্গে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল।
·
আরএসএসের ভারত সেই বহুত্বকে অস্বীকার করে এককেন্দ্রিক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র নির্মাণে বিশ্বাসী।
ইতিহাস সাক্ষী, গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে আরএসএসের ভাবধারার সন্তান। আজ যখন গান্ধীর জন্মদিনে আরএসএস শতবর্ষ উদযাপন করছে, তখন সেটি নিছক কাকতালীয় নয়—বরং রাষ্ট্রীয় আদর্শের মৌলিক বাঁক গ্রহণের চূড়ান্ত ইঙ্গিত।
একজন স্বাধীন প্রগতিশীল মানসিকতা থেকে এই পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয়:
১. রাষ্ট্র ও আদর্শের
সংমিশ্রণ
ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার উপর দাঁড়ানো। কিন্তু আরএসএস-কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া মানে রাষ্ট্রের আদর্শগত ঝোঁককে এক বিশেষ ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া। সংবিধানপ্রণেতা
আম্বেদকর স্পষ্ট করেছিলেন: "হিন্দুত্ব রাষ্ট্র হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।" আজ এই আশঙ্কা যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
২. আদর্শগত সংঘাতের গভীরতা
গান্ধীর আন্তর্জাতিক
অহিংসা দিবস বনাম আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন—এ এক প্রতীকী মেরুকরণ। প্রগতিশীল দৃষ্টিতে এটি কেবল সাংস্কৃতিক নয়, ভারতের গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদী সমাজকাঠামোর উপর সরাসরি আঘাত। শিক্ষা থেকে বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম
থেকে সংসদ—সবখানে আরএসএসের এক-রৈখিক হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ঢুকে পড়ছে।
৩. জনগণের দৃষ্টি ঘোরানো
ও আলঙ্কারিক
গান্ধী
বেকারত্ব, কৃষি সঙ্কট, বৈষম্য, ধর্মীয় দাঙ্গা—এসব বাস্তব সমস্যা থেকে মনোযোগ সরাতে প্রতীকী রাজনীতি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজেপি-আরএসএসের আজকের রাজনীতি গান্ধীর ভাবমূর্তিকে
ব্যবহার করছে কেবল আলঙ্কারিকভাবে। বক্তৃতায়, বিজ্ঞাপনে, পাঠ্যপুস্তকের পাতায় গান্ধীর নাম থাকবে, কিন্তু তাঁর আদর্শ—অহিংসা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শোষণবিরোধী সংগ্রাম—ক্রমশ মুছে যাবে। রাষ্ট্রধর্ম হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ।
৪. নদী বনাম খাল: ভবিষ্যতের মানচিত্র
গান্ধীর ভারত ছিল বৈচিত্র্যের স্রোতস্বিনী নদী—সবার জন্য প্রবাহিত, সবার তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন জাতি—সবাই মিলে গড়বে স্বাধীনতার নতুন মানচিত্র। আরএসএসের দর্শন হলো এক সংকীর্ণ একমুখী খাল—যেখানে ভিন্নতার জন্য কোনো জায়গা নেই। তাদের কাছে ভারত মানে কেবল হিন্দুত্বের একক চেতনা।
ঐতিহাসিক
সন্ধিক্ষণ ও আমাদের শপথ
আজ ভারতের সামনে প্রশ্ন তাই অনিবার্য—
আমরা কি গান্ধীর সেই অন্তহীন স্রোতে ভেসে চলব, যেখানে মানুষ বড়, ধর্ম ছোট? নাকি আরএসএসের সংকীর্ণ স্রোতে বন্দি হব, যেখানে ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে গড়ে তোলা হবে এককেন্দ্রিক, বৈচিত্র্যহীন ভারত?
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি—
"যে দিন মানুষের উপর মানুষের অমানবিকতা বাড়ে, সে দিনই সভ্যতার শ্মশান জ্বলে ওঠে।"
আজকের ভারত যদি সত্যিই গান্ধীকে মানে, তবে আমাদের দাঁড়াতে হবে সেই অন্তহীন স্রোতের পাশে, যে স্রোত বিভাজন নয়, মিলনের স্বপ্ন দেখেছিল। আজ গান্ধীকে কেবল ফুলের মালা নয়, তাঁর স্বপ্নের ভারতকে পুনর্গঠনের অঙ্গীকার দিতে হবে। নইলে ইতিহাস আমাদের প্রজন্মকে ক্ষমা করবে না।
আমরা কি এই আদর্শগত যুদ্ধে নিজেদের বিবেককে বাঁচাতে প্রস্তুত?
আজকের অবস্থার বাস্তব প্রকাশ।
উত্তরমুছুনআপনার লেখাটা পড়লাম।আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করছি। চেষ্টা করবেন উত্তরটা দেবার। ১)যে ইতিহাসটা আমরা স্বাধীনতার পর থেকে পড়ে এসেছি সেটা সঠিক না বেঠিক। ২) গণতান্ত্রিকভাবে হওয়া নির্বাচনে গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী সিতারাময়া নেতাজির কাছে হেরে যাওয়ার পরে, এটা আমার পরাজয় বলাটা উচিত না অনুচিত ৩) খিলাফত আন্দোলন, যার থেকে দেশভাগের বীজ বপন হয়েছিল গান্ধীর সেটার বিরোধিতা না করাটা ঠিক হয়েছে না বেঠিক হয়েছে ৪) ভগৎ সিং এর ফাঁসিকে কোনভাবে আটকানোর চেষ্টা না করা ঠিক হয়েছে না বেঠিক হয়েছে। ৫) জহরলাল এক ভোট বল্লভ ভাই প্যাটেল ১১ ভোট, তবুও জোর করে ও গণতান্ত্রিকভাবে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করাটা ঠিক হয়েছে না বেঠিক হয়েছে ..... ফোন নম্বর পাঠালে আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারব, দেশভাগ এর মূল কারণ গান্ধী
উত্তরমুছুন