সম্পাদকীয়
======================= == =
বাংলা কবিতায় বর্ষা ঋতুর প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বৈচিত্র্যতা তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। মধ্যযুগের বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিভিন্ন কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনা এসেছে। কবি কালিদাস, কবি জয়দেব ,কবি বড়ু চন্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণকীর্তনে, কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রায়শেখর, মনোহরদাস, বাসুদেব ঘোষ এদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় বর্ষার অপরূপ রূপ বা সৌন্দর্য উঠে এসেছিল। কালিদাস বর্ষাকে অনুভব করেছেন অনুরাগের গভীরতায়। কালিদাসের দৃষ্টিতে বর্ষার সৌন্দর্য-সখা যে মেঘ, সেই মেঘকে কবি লোভনীয় সম্ভোগের আভাস দিয়ে যক্ষের সহচররূপে যক্ষ প্রেমিকার কাছে পাঠান। সেখানে মেঘ সঙ্গত কারণেই প্রেমের বার্তাবহ দূতরূপে চিহ্নিত হয়। মেঘের সঙ্গে প্রেম আর বিরহের একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কালিদাস তার কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করে বর্ষার অনুভূতিকে আরও মোহময় করে তুলেছেন ।
তিনি বলেছেন - ‘কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/যক্ষ অতএব কুড়চিফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’
মধ্যযুগের আর এক জন কবিপ্রতিভা কবিকঙ্কন উপাধিখ্যাত মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন:
‘আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুড়ে॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি॥’
বাংলা সাহিত্যের প্রাণপরুষ বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর হাত ধরেই কবিতার মাধ্যমে বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর কবিতায় বর্ষার রূপ বৈচিত্র প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তাঁর ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
‘আষাঢ়’ কবিতায় তিনি মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে আষাঢ় মাসের গ্রামবাংলার একটি নিটল বর্ণনা তাঁর কবিতার দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে। আউশের খেত, কালিমাখা মেঘ, ধেনু ও ধবলীর বর্ণনায় গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে।
‘সোনার তরী’ কবিতার দৃশ্যকল্পে আকাশে মেঘ গর্জন করছে, চারিদিকে বর্ষার থৈথৈ জল, খরস্রোত বয়ে চলছে, জমির ধান কেটে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে।
প্রেমের
কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রেমের জারক হিসাবে। প্রিয়ার বিরহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বাদল
দিনের মেঘ। বাদল ধারা প্রিয়ার আগমনী সুরকে বিদায়ী সুরে পরিণত করেছে। বাদল
রাতের বর্ষণ সিক্ত রাতের পাখি হয়ে ওঠে কবির বেদনা সিক্ত হৃদয়ের চিত্রল প্রতীক।
বিরহ কাতর পাখিকে কবি তাই বলছেন, তুমি যার জন্যে কাঁদছো সে তো তোমার
জন্যে কাঁদে না।
উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’
কবি বর্ষার এই রাতে পাখিকে বন্ধু ভেবেছেন। পাখির বিরহের সাথে নিজের বিরহ একাকার করেছেন। আসলে সকল কোলাহল ছেড়ে কবি বর্ষার নির্জনতায় প্রেমের প্রকৃত মূর্তি গড়েন। অন্যদিকে তিনিই আবার বর্ষার বিদায় মুহূর্তে ব্যথিত ওঠেন।
কবি বর্ষাকে বলেছেন,
তোমার বিদায়ের কথা শুনে কেয়া রেণু পান্ডুর হয়েছে, প্রণয় অশ্রম্নসম শিশিরভেজা শেফালি ঝরছে আজ। ঝরে কদমের কেশর।
‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষা-বিদায়’ কবিতায় কবি তাই বলেছেন:
‘সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি’
চলিতে চলিতে চমকি’ উঠ না কবরী উঠে না দুলি’!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!’
পল্লী কবি জসিম উদদীন বর্ষায় দেখেছেন গাঁয়ের কৃষক-মুঠেরা কি করে তাদের এ আলস্য সময়ে। দাওয়ায় বসে গল্প, গান কিংবা গৃহস্থালী কিছু উপকরণ তৈরির দৃশ্য। যেমনটি পল্লী-বর্ষা কবিতায় গাঁয়ের চিত্র বর্ণনায় লিখেছেন:
‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পের গানেকি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।’
আদিকাল থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বর্ষাঋতু নিয়ে রয়েছে উচ্ছ্বসিত বন্দনা, অনুরাগ ও স্তুতি। রহস্যময়ী এ বর্ষার রূপ, বৈচিত্র্য, চমক, বর্ণচ্ছটা এবং আকাশ- প্রকৃতির গভীর মিতালী শিল্প-সাহিত্যের সরস উপকরণ হিসেবে আবহমানকাল থেকেই অনুপ্রাণিত ও স্পন্দিত করছে শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, সেখানেও দেখতে পাই তিনি বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসাবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যার সাথে একাত্ব ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। মধুসূদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা হয়েছে এভাবেই:
‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমনীর মন লয়ে/সুখে কেলি করে/দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।’
বৈশাখের তপ্ত খরতাপের পরে আসে বর্ষা। বর্ষার নতুন জল ধারায় প্রাণে জাগে স্পন্দন। সজীবতায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ব-ব্রহ্মা। ঝড়ের রুদ্রমূর্তির পরে সরস বর্ষার যে রূপের সন্ধান মেলে,
বর্ষাকাল মানেই আকাশ কালো করা ঘন মেঘের আনাগোনা, যখন তখন ঝমঝমিয়ে পড়ে বৃষ্টি। পথে ঘাটে কাদাজল। ঘরে স্যাঁতসেঁতে ভাব।
তাই তো কবি শামসুর রাহমান বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন:
‘হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে,
কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে।
ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি
ঝরে।’
এছাড়াও কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ, কদমফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের আবাহন থাকে এই আষাঢ়েই।
তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ আষাঢ়কে বলেছেন- ‘ধ্যানমগ্ন বাউল- সুখের বাঁশি’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন