অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বুধবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২২

অণুগল্পে তমালী


  



চলাই জীবন
===================
তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
===================

নন্দিতার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। মনখারাপ লাগছে। খুব কান্না পাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। আবার এক সপ্তাহ বাদে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়... মনখারাপিটা খানিক কেটে যায়।তখন সবই ভালো লাগে। আসলে এই একলাজীবনে মনের কষ্টের কথা কাকেই'বা বলবেন??কেই'বা শুনবে?

শরীরটাও আজকাল বেঁকে বসেছে। নানা ব্যথা কাবু করে দিয়েছে জীবনকে। মনের ব্যথা... শরীরের ব্যথা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ওকে। তাও মাঝেসাঝে একটু হাঁটতে বেরোতো...করোনা কালে তাও বন্ধ...মনটা হাঁপিয়ে ওঠে।

উত্তরে ঘরের জানলাগুলো চেপে বন্ধ করে রাখা আছে...না'হলে শুধু এম্বুল্যান্স আর শববাহী গাড়ির সাইরেন বুকটা কাঁপিয়ে দেয়। মন বলে এরপর কার যাওয়ার পালা?!৷ ফোনে আত্মীয়বন্ধুর অসুখ, বিয়োগব্যথার খবরে মনটা বিচলিত হয়...ক্লান্ত হয়। কতদিন কারো সাথে দেখা হয়না...কারোর বাড়ি যাওয়াও হয়না... কেউ আসেওনা।

ঘরে একমাত্র কথা বলার লোক... সর্বক্ষণের সঙ্গী বিমলা...মাঝবয়সী মেয়েটি স্বামী পরিত্যক্তা...গ্রামে ওর ছেলে-বৌমা-নাতি আছে। তাদের জন্য টাকা জমায় ও...মাঝেসাঝে গিয়ে ওদের দেখে আসে...টাকা দিয়ে আসে।মায়ার টান... সবটুকু স্নেহ উজার করে দিতে চায়।

নন্দিতাও ওর বুকের ধন...বিদেশে থাকা সন্তানদের চিন্তায় থাকে।ওদের থেকে কিছুই চাওয়ার নেই...শুধু ওরা ভালো থাকলে নন্দিতাও ভালো থাকে।

যদিও চিরকাল হাসিমুখেই থাকার চেষ্টা করে এসেছে নন্দিতা। কিন্তু ওই হাসির মধ্যেই যে কত বেদনা লুকোনো আছে... তার খবর কে রাখে? আসলে সংসার জায়গাটাই এমন... সেখানে যতই অন্যায়,অবিচার, দুঃখ,কষ্ট, বিচ্ছেদ,যন্ত্রণা, না পাওয়ার বেদনা মিশে থাক...সংসারে কেউ কিন্তু সেসব শুনতে বা বুঝতে চাইনি কোনদিন...আসলে সংসার এমন একটা জায়গা যেখানে তুমি কতটা সেবা,যত্ন,কাজ,ক্ষমতা দিতে পারলে...সেটাই শুধু হিসেব হয়... বিনিময়ে তুমি কী পেলে সেটা বড় কথা নয়। আর সবাই শুধু মুখের হাসিটাই দেখতে ভালোবাসে।জলভরা দু'চোখ দেখলে অস্বস্তি হয় সবার...দুঃখ বিলাসিতা বলে এড়িয়েও যায় অনেকে। ছেলেবেলায় বাবার মুখে শোনা "দুঃখে যাদের জীবন গড়া...তাদের আবার দুঃখ কীসের?? "

এই ছেলেবেলাটা কিন্তু ভারী অদ্ভুত!! ভাবতে বসলে এখনো ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। সেসময় কারণে-অকারণেই হেসে গড়াগড়ি দিতো ও আর ওর বন্ধুরা।আর সেই হাসি চট করে থামতোই না...যতক্ষণ না কেউ ধমক দিতো!স্কুলে এমন কতবার হয়েছে ভাবলেও এখন মজা লাগে৷ একবার তো পাড়ার কাকুর দোকানে গিয়ে হাসাহাসি শুরু করতেই দোকানের বিশুকাকু এক ধমক দিয়ে বলেছিলো-- "দুপুরে দু'মুঠো ভাত আর রাত্রিরে দু'খানা রুটি খেয়ে এত হাসি আসে কোত্থেকে??" এখনো কথাটা মনে আছে নন্দিনীর...এবয়সে এসে বুঝতে পারে এই কথার মর্মার্থ ... সত্যিই চারিদিকে তাকিয়ে আজ আর হাসি পায়না কোনকিছুতেই।

যত বয়স বাড়ছে ততই যেন শরীরের ক্ষমতা কমে আসছে...আর মনটাও তত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা তো কবেই ছেড়ে চলে গেছে, সবসময় পাশে থাকা জীবন সঙ্গীও চলে গেছে চিরতরে ... ছেলেমেয়েরাও অনেক দূরে...।

টাকাপয়সা,বাড়ি-গাড়ি,শাড়ি-গয়না কোনোকিছুরই কোন অভাব নেই জীবনে কিন্তু মানুষের বড় অভাব... এই অসুখের পৃথিবীতে মনে শুধু ভয় ... আর আপনজনকে কাছে পাবার ইচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় প্রখর তপ্ত রোদে পুড়ছে ও...একটুও ছায়া নেই...তৃষ্ণার্ত অথচ পিপাসার জল নেই। বড্ড কঠিন এই পথচলা।

তবে আজকাল কিছু হালকা ব্যায়াম, প্রাণায়াম করে ভালো আছে নন্দিতা। আর একাকিত্বকে উপভোগ করতে শিখছে ও।নিজের আর বিমলার জন্য শখের নানারকম আইটেম বানিয়ে দু'জনে মজা করে খায়। মোবাইলে সোস্যাল মিডিয়ায় জুড়ে থেকে বন্ধু পেয়েছে অনেক... বিভিন্ন ভিডিও, লেখা পড়ে, দেখে সময় কাটে বেশ। রোজই নিয়ম করে স্কাইপিতে আড্ডা মারে বিদেশে থাকা ছেলেমেয়ে...নাতিনাতনিদের সাথে।কখনো পুরোনো এলবামে ছবি দেখে হারিয়ে যাওয়া সময়কে খুঁজে পায়।মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় ওর। এছাড়াও বই, গান আর টেলিভিশনে মনটাকে ভাসিয়ে রাখতে ভালো লাগে । আর বাড়ির বাগানের ফুলগাছগুলো ওর প্রাণ... নিজের সন্তানের মত পরিচর্যা করে ওদের...আর ওরাও ফুল ফুটিয়ে আনন্দ দেয় ওকে। আর কত প্রজাপতি, পাখী আনাগোনা করে সকাল থেকে...পাখীরা গান শোনায় ওকে। ইদানিং ওদের জন্যও দানাপানি আর জলের ব্যবস্থা রেখেছে ও। শুধুমাত্র নিজেকে ভালো রাখার জন্য এই শখগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে নন্দিতা আর অপেক্ষা করে আছে অসুখহীন সেই সুন্দর পৃথিবীর যেখানে মানুষ মানুষকে ছুঁতে পারবে সহজেই।।




1 টি মন্তব্য: