তারস্বরে মাইকে বাজছে " ঢাকের তালে কোমর দোলে / খুশিতে নাচে মন "। পাড়ার পাড়ায় ব্যাস্ততা শেষ পেরেকের। কোথাও রাতারাতি তৈরী হচ্ছে তাজমহল, জেগে উঠছে কোনার্কের সূর্য মন্দির , কোথাও'বা অজন্তা ইলোরা। চারিদিকে আলোর রোশনাই, রাত পোহালেই পঞ্চমী। মনটা আজ মাতৃবোধনে উদ্বেল হয়ে উঠেছে।
সপরিবারে বাজার থেকে নতুন জামাকাপড় ও চিকেন বিরিয়ানি কিনে বাড়ি ফেরার পথে, কোত্থেকে হঠাৎই তেড়ে আসে প্রায় আমার ছেলেরই বয়সী দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে ওঠে। তাকিয়ে আছে আমার হাতে ধরা খাওয়ারের প্যাকেটের দিকে ফ্যালফ্যাল করে। খাওয়ারের জন্য হাত পাতে, কাকুতিমিনতি করে। আমি সাথে সাথে ভর্ৎসর্না করে তাড়িয়ে দিতে চাইলেও বাচ্চা দুটো নাছোড়বান্দা।
শহরে প্রতিদিনই এমন ভিখারী আর পাগলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফুটপাথে, বড়ো রাস্তার ধারে, অলিতে গলিতে, ফ্ল্যাটের নিচে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ন্যাংটো-কালো বাচ্চা, জট পাকানো চুল-দাঁড়ি নোংরা-কালো-বিচ্ছিরি পুরুষ-মহিলা। এরা কি কেউ সমাজ-সভ্যতার মানে বোঝে? এরা জানেনা শহরের মাঝে একটা টু-বিএইচকে ব্যাঙ্ক লোনের ফ্ল্যাটবাড়ির মাসিক ই-এম-আয় কত ! এরা বোঝেনা ক্রেডিট কার্ড এর মারপ্যাঁচ, বোঝেনা রক্তচাপ বাড়ানো শেয়ার বাজারের ওঠা নামা। পেট্রল, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে এদের কিছুই আসে যায় না। এদের আইডিয়া নেয় একটা গাড়ির কত দাম হতে পারে। বৌ-এর পার্লার, সন্তানদের স্কুল ও টিউশন ফি বাবদ কত খরচ হয় ওরা জানে? এমনকি একটা মোবাইল কিংবা পুজোর শপিং এ শাড়ি-জামাকাপড়ের খরচও যে লাখ টাকা হতে পারে এদের সেই সেন্সটুকু নেয় ! এরা জানেনা একটা আপাত সুখী দাম্পত্যের জন্য কত দাম পত্তর দিতে হয় জীবনে। ভয় হয় যদি কোনো একদিন সকালে উঠে জানতে পারি যে আমার চাকরিটা চলে গেছে ! সেদিন কি হবে? ভয় হয় এতো দাম পত্তর দিতে দিতে যদি আমিও একদিন আমার বৌ-বাচ্চা চিনতে না পেরে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে শুয়ে পরি ওই ফুটপাথে ওদের সাথে ! যদি হঠাৎই ক্ষেপে যায় কিংবা কখনো কাঁদি নিশ্চুপে অথবা হেসে উঠি খিলখিলিয়ে কারণে-অকারণে ওদেরই মতো!
তখনও কি নৈরিতা বুকে টেনে নিবে আমায়? অগোছালো চুল দাঁড়ি যত্নে কেটে সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দেবে? ভালোবাসা সোহাগে আদরে ভরিয়ে আমাকে ফেরিয়ে আনবে স্বাভাবিকতায়? নাকি আমার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে ঘর বাঁধবে অন্য কারোর সাথে? আমি ছাড়া আর কে এতো খুশি রাখতে পারবে নৈরিতা কে? তাহলে কি অনিরুদ্ধই ফের ফিরে আসবে ওর জীবনে? শুনেছি অনিরুদ্ধ মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়েছে ওর স্ত্রী'র কাছে মনোমালিন্যর কারণে। আর স্কুল লাইফে অনিরুদ্ধ-নৈরিতার প্রেম কে না জানতো! প্রথম প্রেম সবসময়ই স্পেশাল হয়, ভোলা যায়না প্রথম হাতে হাত ছোঁয়ার সাথে সাথে শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ। ভোলা যায়না প্রথম চুম্বন, প্রথম শরীর ছোঁয়া সে হরমোনের উচ্ছাস সহজে। অনি বোধহয় এমনটাই চেয়েছিলো, এই সুযোগে সে নিশ্চয় ফেরত আসবে নৈরিতার জীবনে। প্রথমে সান্তনা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে নিশ্চয় তারপর একদিন নৈরিতা সোহাগে মাথা গুঁজে লতিয়ে উঠবে অনির বুকে, ঠোঁট ছোঁবে ঠোঁট। ঠিক যেমনটা স্কুলের ফাঁকা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রুমে লুকিয়ে দেখে ফেলেছিলাম আমি প্রায় দু-দশক আগে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে অনি বিএসসি পড়তে চলে যায় কলকাতার আশুতোষ কলেজে। এদিকে আমি আর নৈরিতা ভর্তি হই শহরেরই মালদা কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স কোর্সে। অনির সাথে নৈরিতার যোগাযোগ যত কমে আসতে শুরু করে ঠিক ততোটায় আমার সাথে নৈরির সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। নৈরি অনিকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানানোর পরে সে খুব ভেঙে পড়েছিলো। এতো কেঁদেছিলো যে নৈরিও ওর প্রতি ফের দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এদিকে কলেজ শেষ করে চাকরিটা পেতে আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এরপরই চটজলদি বিয়েটা সেরে ফেলি নৈরির সাথে। আমরা অনিকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলাম বটে , কিন্তু সে আসেনি। উল্টে কুরিয়ার মারফত একটা আশ্চর্য গিফট পাঠিয়েছিলো সে। বাক্সের মধ্যে একটা ছোট্ট খেলনা চাবি দেওয়া কাঠের নাগরদোলা। সে নাগরদোলার ছয়টি বসার প্রকষ্ঠে ছয়টি ছোট ছোট টেডি বেয়ার বসানো ছিলো যার মধ্যে ওপর নিচে মাত্র দুটিকে রেখে বাকিগুলো ইচ্ছাকৃত খুলে ফেলা হয়েছিলো। সেদিনের সেই গিফটের মর্ম আমি আজ বুঝতে পারছি। অনি জানতো যে নাগরদোলা ঘুরলেই সেও একদিন উপরে উঠবে আর আমি পরে থাকবো নিচে।
সপরিবারে বাজার থেকে নতুন জামাকাপড় ও চিকেন বিরিয়ানি কিনে বাড়ি ফেরার পথে, কোত্থেকে হঠাৎই তেড়ে আসে প্রায় আমার ছেলেরই বয়সী দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে ওঠে। তাকিয়ে আছে আমার হাতে ধরা খাওয়ারের প্যাকেটের দিকে ফ্যালফ্যাল করে। খাওয়ারের জন্য হাত পাতে, কাকুতিমিনতি করে। আমি সাথে সাথে ভর্ৎসর্না করে তাড়িয়ে দিতে চাইলেও বাচ্চা দুটো নাছোড়বান্দা।
শহরে প্রতিদিনই এমন ভিখারী আর পাগলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফুটপাথে, বড়ো রাস্তার ধারে, অলিতে গলিতে, ফ্ল্যাটের নিচে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ন্যাংটো-কালো বাচ্চা, জট পাকানো চুল-দাঁড়ি নোংরা-কালো-বিচ্ছিরি পুরুষ-মহিলা। এরা কি কেউ সমাজ-সভ্যতার মানে বোঝে? এরা জানেনা শহরের মাঝে একটা টু-বিএইচকে ব্যাঙ্ক লোনের ফ্ল্যাটবাড়ির মাসিক ই-এম-আয় কত ! এরা বোঝেনা ক্রেডিট কার্ড এর মারপ্যাঁচ, বোঝেনা রক্তচাপ বাড়ানো শেয়ার বাজারের ওঠা নামা। পেট্রল, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে এদের কিছুই আসে যায় না। এদের আইডিয়া নেয় একটা গাড়ির কত দাম হতে পারে। বৌ-এর পার্লার, সন্তানদের স্কুল ও টিউশন ফি বাবদ কত খরচ হয় ওরা জানে? এমনকি একটা মোবাইল কিংবা পুজোর শপিং এ শাড়ি-জামাকাপড়ের খরচও যে লাখ টাকা হতে পারে এদের সেই সেন্সটুকু নেয় ! এরা জানেনা একটা আপাত সুখী দাম্পত্যের জন্য কত দাম পত্তর দিতে হয় জীবনে। ভয় হয় যদি কোনো একদিন সকালে উঠে জানতে পারি যে আমার চাকরিটা চলে গেছে ! সেদিন কি হবে? ভয় হয় এতো দাম পত্তর দিতে দিতে যদি আমিও একদিন আমার বৌ-বাচ্চা চিনতে না পেরে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে শুয়ে পরি ওই ফুটপাথে ওদের সাথে ! যদি হঠাৎই ক্ষেপে যায় কিংবা কখনো কাঁদি নিশ্চুপে অথবা হেসে উঠি খিলখিলিয়ে কারণে-অকারণে ওদেরই মতো!
তখনও কি নৈরিতা বুকে টেনে নিবে আমায়? অগোছালো চুল দাঁড়ি যত্নে কেটে সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দেবে? ভালোবাসা সোহাগে আদরে ভরিয়ে আমাকে ফেরিয়ে আনবে স্বাভাবিকতায়? নাকি আমার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে ঘর বাঁধবে অন্য কারোর সাথে? আমি ছাড়া আর কে এতো খুশি রাখতে পারবে নৈরিতা কে? তাহলে কি অনিরুদ্ধই ফের ফিরে আসবে ওর জীবনে? শুনেছি অনিরুদ্ধ মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়েছে ওর স্ত্রী'র কাছে মনোমালিন্যর কারণে। আর স্কুল লাইফে অনিরুদ্ধ-নৈরিতার প্রেম কে না জানতো! প্রথম প্রেম সবসময়ই স্পেশাল হয়, ভোলা যায়না প্রথম হাতে হাত ছোঁয়ার সাথে সাথে শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ। ভোলা যায়না প্রথম চুম্বন, প্রথম শরীর ছোঁয়া সে হরমোনের উচ্ছাস সহজে। অনি বোধহয় এমনটাই চেয়েছিলো, এই সুযোগে সে নিশ্চয় ফেরত আসবে নৈরিতার জীবনে। প্রথমে সান্তনা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে নিশ্চয় তারপর একদিন নৈরিতা সোহাগে মাথা গুঁজে লতিয়ে উঠবে অনির বুকে, ঠোঁট ছোঁবে ঠোঁট। ঠিক যেমনটা স্কুলের ফাঁকা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রুমে লুকিয়ে দেখে ফেলেছিলাম আমি প্রায় দু-দশক আগে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে অনি বিএসসি পড়তে চলে যায় কলকাতার আশুতোষ কলেজে। এদিকে আমি আর নৈরিতা ভর্তি হই শহরেরই মালদা কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স কোর্সে। অনির সাথে নৈরিতার যোগাযোগ যত কমে আসতে শুরু করে ঠিক ততোটায় আমার সাথে নৈরির সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। নৈরি অনিকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানানোর পরে সে খুব ভেঙে পড়েছিলো। এতো কেঁদেছিলো যে নৈরিও ওর প্রতি ফের দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এদিকে কলেজ শেষ করে চাকরিটা পেতে আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এরপরই চটজলদি বিয়েটা সেরে ফেলি নৈরির সাথে। আমরা অনিকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলাম বটে , কিন্তু সে আসেনি। উল্টে কুরিয়ার মারফত একটা আশ্চর্য গিফট পাঠিয়েছিলো সে। বাক্সের মধ্যে একটা ছোট্ট খেলনা চাবি দেওয়া কাঠের নাগরদোলা। সে নাগরদোলার ছয়টি বসার প্রকষ্ঠে ছয়টি ছোট ছোট টেডি বেয়ার বসানো ছিলো যার মধ্যে ওপর নিচে মাত্র দুটিকে রেখে বাকিগুলো ইচ্ছাকৃত খুলে ফেলা হয়েছিলো। সেদিনের সেই গিফটের মর্ম আমি আজ বুঝতে পারছি। অনি জানতো যে নাগরদোলা ঘুরলেই সেও একদিন উপরে উঠবে আর আমি পরে থাকবো নিচে।
কিন্তু তায় বলে বাবান কি মেনে নেবে অনিকে ওর বাবা হিসাবে? না, কক্ষনো সে হতে পারেনা। কিন্তু বাবান তো এখনো খুব ছোট। ওর প্রতিবাদ আদৌ কি কেউ গ্রাহ্য করবে! উল্টে লাজুক প্রকৃতির বাবান হয়তো কিছুই বলবেনা কিন্তু মনে মনে ভীষণ কষ্ট পাবে আর সারাজীবন সেই দুঃখ মনের গভীরে বয়ে বেড়াবে। স্কুলের বন্ধুরা ওকে খ্যাপাবে। অনি নিশ্চয় ওকে আমার মতো আদর যত্নে মানুষ করবে না। ওর ভবিষ্যতটা স্পয়েলড হয়ে যাবে পুরোপুরি।
আমার ভয় আমার মধ্যে প্রচন্ড ক্রোধের জন্ম দেয়। আমি এবারে নাছোড়বান্দা বাচ্চা দুটোকে তাড়ানোর জন্য মারমুখী ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠতে যাবো এমন সময় বাচ্চা দুটো হঠাৎই দৌড় লাগায় বিশ ফুটেক দূর থেকে হেঁটে আসা পাউরুটির প্যাকেট হাতে এক মলিন ছেঁড়া শাড়ি পরিহিতা মধ্যবয়স্কার দিকে। আমাকে হতবাক করে দিয়ে আনন্দে বাচ্চা দুটো সমস্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে - 'মা আসছে - মা আসছে'।
ঠিক তখনি পাশের মণ্ডপে উলুধ্বনি-শাঁখ সহযোগে ঢাক বাজতে শুরু করে প্রতিমা বোধনের...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন