অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বুধবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২২

অণুগল্পে রথীন্দ্রনাথ

  


দগদগে ঘা
=====================
রথীন্দ্র নাথ রায়
=====================



বাসস্ট্যান্ড থেকে বের হওয়ার মুখেই বসে থাকে লোকটা । প্রায় প্রতিদিনই । দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই । আমার মতো অনেকেই । কেউ কেউ দুটো -- একটা অথবা পাঁচ টাকার কয়েন ছুঁড়ে দেয় । লোকটা কপালে হাত ঠেকিয়ে কুড়িয়ে নেয় । লোকটার ডান পায়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত দগদগে ঘা । মাছি ভনভন করছে । সেগুলোকে তাড়াবার চেষ্টা করেও পারেনা । বেয়াড়া মাছিগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসে । যণ্ত্রণায় কাতরায় লোকটা ।

একটু দাঁড়ালাম । ভালো করে জরিপ করলাম । লোকটাকে । শীর্ণকায় । বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের কোঠায় । অথবা কমও হতে পারে । না খেতে পাওয়া চেহারা । ধীরে ধীরে কাছে গেলাম । বললাম , আচ্ছা আপনার পায়ে যে এই ঘা -- এটার চিকিৎসা করাননি ?

লোকটা শীর্ণ দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখল । বলল , কে নিয়ে যাবে আমাকে ?

-- যদি আমি নিয়ে যাই ?

-- না বাবু । তাহলে আমার রোজগার হবেনি । ওরা খেতে পাবেনি ।

-- ওরা বলতে ?

-- আমার মেয়ে, বউ ।

-- দেখো তোমার পা টা যদি ভালো হয়ে যায় তাহলে তুমি কাজ করতে পারবে । মেয়ে- বউকেও খাওয়াতে পারবে ।

-- না বাবু , সে হবেনি । একসময় আমার পা টো ভালো ছেলো । হোটেলে কাজ করতম । একদিন সন্ধ্যেবেলায় গরম ফ্যানের মধ্যে পইড়ে গেলম । ফোস্কা পড়ল । গলে গিয়ে ঘা হল । মালিক দুএকদিন ওষুধ দিল । ভালো হলনা । মালিক বললে, বাড়ি যা । পা ঠিক হলে আবার আসবি ।

বাড়ি গেলম । কিন্তু মেয়ে বৌ তেমন গ্রাহ্য করলনা । ডাক্তার দেখাবার ব্যাবস্থাও করল না । আমার পায়ে তখন দগদগে ঘা । তা দেখে ওরা আমায় ঘেণ্ণা করত । আমি বাড়ির বাইরে পড়ে থাকতম । ক্ষিধের জ্বালায় কাঁদতম। তারপর একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে পৌঁছালাম এই বাসস্ট্যান্ডে । আমার পায়ে দগদগে ঘা দেখে লোকেদের দয়া হল । তারা দুটাকা, পাঁচটাকা ছুঁড়ে দিতে লাগল । ক্ষিধেটা মিটল । খবর পেয়ে মেয়ে একদিন এল বাবাকে খুঁজতে । আমি ওকে কিছু টাকা দিলম । ও চলে গেল । আমি চোখের জল ফেললম । এখন ও দুদিন অন্তর আসে । টাকা নিয়ে যায় । বেশ ভালো আছে ওরা । আমি ভয় পাই । যদি আমার পায়ের দগদগে ঘা টা ভালো হয়ে যায় তাহলে কেউ আমাকে ভিক্ষে দেবেনা । তখন আমিও খেতে পাবোনা, ওরাও খেতে পাবেনা ।

লোকটা হাত জোড় করে বলল , দোহাই আপনার, আমাকে এখানেই থাকতে দিন ।

আমি নির্বাক বিষ্ময়ে ওর দিকে চেয়ে আছি । একটা দগদগে ঘা এদের বেঁচে থাকার উপায় ভেবে শিউড়ে উঠছি । চোখের সামনে দুটো মুখ ভেসে উঠছে । একটি মেয়ের অপরটি স্ত্রীর । পরম নির্ভরতার । অথচ তারা আজ কতটা হৃদয়হীন ! আর কতটা হৃদয়হীন হলে দগদগে ঘা কে বেঁচে থাকার উপায় করতে পারে ?






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন