অথ শঙ্খিনী কথা
=========================
সুদর্শন ব্রহ্মচারী
================ =========
শ্রীমতী আমার কোলে মাথা রেখে কুড়ি বছর আগের গল্প বলছে, ‘তখন সবে মাটি আঁকড়ে পৃথিবীটা দেখতে শুরু করেছি। যা কিছু দেখি শুনি ছবি এঁকে এঁকে সব মুখস্ত করে রাখি। সারাক্ষণ মায়ের গন্ধ ঘিরে রাখে। মায়ের ঠোটের আদর ছাড়া কিছুই ভাল্লাগে না। মা গুন গুন করে নেচে বেড়ায়। যদ্দূর দেখতে পাই ততটুকুই আমার পৃথিবী।’
খানিক থেমে সে চিত হয়ে আমার ঠোঁটে আঙ্গুলের টোকা দিয়ে বলল, ‘পৃথিবীটা তখন বড়ো অদ্ভুত ছিল।’ আমি তার আঙ্গুল চুষে বললাম, ‘তোমাকে দেখলেই বড়ো টগর ফুলের আধফোটা কুঁড়ি ভেসে ওঠে।’ সে ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল জড়ো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছে, ‘এমনি করেই কি তোমার টগর ফোটে?’ আমি সত্যি সত্যি তার হাতে টগর ফুলের না-ফোটা কুঁড়িই দেখতে পাচ্ছি। সে প্রশ্ন করল, ‘আধফোটা কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখনও টগরফুল ফুটতে দেখেছ?’ সে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ।’ আমি বললাম, ‘তাহলে বলো দিকি কি ভাবে পাপড়ি খোলে?’ সে দু হাতের আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফুল ফোটানোর অভিনয় করে বলল, ‘একটু একটু ঠেলে বের করে দেয়।’
-যদি ভাবি কেউ টেনে টেনে বের করে আনে?
-কে টানে? দুঃশাসন? দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে টানাটানি? হুঁ! অত কল্পনা কেন করো?
সে উঠে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, ‘ফুল ফোটায় তো শুধু আনন্দ, যুদ্ধের কথা ভাবছ কেন?’
-কই না তো, যুদ্ধের কথা তো ভাবি না।
-তবে টানাটানি করো না, যে খোলে সে আপনিই খোলে।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি সে কী বলতে চায়। সে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি ভেবেই চলেছি। আচমকা সে এক ঝটকায় গায়ের কাপড় খুলে ফেলল। তার নিরাবরণ রূপ আমাকে গ্রাস করছে। ভ্রূয়ের মধ্যিখানে নীল টীপ, পায়ে রূপোলি নুপুর, গলায় জুঁই ফুলের মালা আর কোমরে রূপোলি বিছে-হার ছাড়া আর কোন আভরণও নেই। দেখতে দেখতে তার বুকে একজোড়া সাদা শাঁখ ফুটে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটাও দুপুরের শ্বেত শতদলের মতো হয়ে গেল। তার চোখে মুখে স্বর্গীয় হাসি। ছোট ছোট দাঁত উঁকি দিচ্ছে। আমার চোখ ফেরাতে পারছি না। সেও অপলক তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে তার মেরূদন্ড খুলে নিয়ে বাঁশির মতো বাজাতে শুরু করলাম। তার দু চোখে হাজারো কথা থৈ থৈ করে নাচছে। দেখতে দেখতে চারিদিকে সাদা সাদা ফুল ফুটে উঠল। সুগন্ধে সুগন্ধে আমার রক্তে আগুন লেগে গেল। বনভূমি জুড়ে টগরফুলের মেলা। আকাশ অন্ধকার করে যেন লক্ষ তারার বাতি জ্বলে উঠেছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
তার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শ্রীমতী, কোন দিন নিজের দিকে তাকিয়েছ?’ সে মেরূদন্ড টানটান করে সোজা হয়ে বসে আমার দখল নিয়ে বলল, ‘দেখি তো। কখনও কখনও গভীর রাতে সব যখন নীল হয়ে আসে আমি বহুদূরে নিজেকে দেখতে পাই। একটা হাঁ করা মুখ আগুনের মতো এগিয়ে আসে। যেন চারিদিকে দাঙ্গা লেগেছে। চৈত্রের দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।’ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গভীর রাতে পাকা গমের ক্ষেতে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সে চুপ করে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘টগরর পাকা ফল দেখেছ?’
-উঁহু।
সে মাথা নাড়াচ্ছে। বললাম, ‘হাঙ্গরের মতো হাঁ; দাঁত বের করে তাকিয়ে থাকে।’ সে দু বার হাঁ করে জিভ দেখিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘রঙ কি আমার জিভের মতো?’
- গাঢ় রক্তের প্রবাহ যেমন।
আমার কথা শুনে সে অন্য মনস্ক হয়ে পড়ল। খানিক ভেবে বলল, ‘জানো, আমাকেও আগুনের গোলাটা গিলতে আসে। বড্ড ভয় করে।’ আমি তার চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করছি। সে আমার বুকে মুখ গুঁজে ‘উঁহুঁহুঁউঁউঁ’ করতে করতে কামড়ে দিল। আমার মন বলছে সে নিশ্চয়ই পঞ্চমুখী শংখিনী। কথাটা তাকে বললাম। সে অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি শংখিনী?’ সে বোধ হয় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমারও চোখের পাতা পড়ছে না। কোন এক সময় সে বুকে হাত বুলোতে বুলোতে জীজ্ঞেস করল, ‘পঞ্চমুখী? অমন কেন দেখ?’
সে আমার দু দিকে পা ছড়িয়ে বসল। তার মুখে থৈ থৈ কথা। আমি ডান হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে তার মুখে আগল দিলাম। সেও বাঁ হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরল। দু জনেই ঠোঁট চেপে হাসছি। অজানা বাতাস বইছে। সে আমাকে ধরে লতাপাতার মতো মাথা তুলে আকাশে উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি নিজেকে কি ভাবে দেখ?’ সে বলল, ‘যেদিন হঠাৎ করেই কুড়ি বছর টপকে গেলাম মা বলল, ‘এই বয়েসটা অন্যরকম। সবকিছুই নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু যাই করো দেখেশুনে চলবে।’ তখন তো সারাক্ষণ আমার গায়ে বিদ্যুৎ খেলছে। বন্ধুরা বলল, "চল শ্রীমতি, একটা বিপ্লব করে দেখাই।’ সেই নিজেকে দেখা শুরু। তারপর থেকে আজও দেখেই চলেছি।
-কি বিপ্লব করলে?
-নিজেকে পালটে ফেলেছি। দেখছ না?
-সেই জন্য তো ষোড়শী বলি।
সে হো হো হো করে হাসতে হাসতে উপুড় হয়ে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, ‘নতুন কি আর বললে? কুড়ি বছর বয়েসটা ও রকমই। সব্বাইকে বিপ্লবী করেই ছাড়ে।’
- খুব ইচ্ছে করত, সমাজটাকে তছনছ করে দিই। কিন্তু-
-কিন্তু কি?
- ভাঙতে ভাঙতে বুঝলাম বিপ্লবটা আগে নিজের ভেতরেই হওয়া দরকার।
সে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি তার টলমল যৌবনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছি না। তার ভেতর দিয়ে আমি পদ্মের মৃণালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি আর সে গোলাপি পদ্মের মতো আমার মাথায় ফুটে উঠছে। চারপাশে কিসের যেন গুনগুন। পৃথিবীটা অজানা তরঙ্গে নাচছে। সে বলল, ‘এই বয়সেই আমার মা, মায়ের মতো চলতে-ফিরতে শুরু করেছিল। মা ভাবত, বাচ্চা বড়ো করছি, এবার নিশ্চয়ই সবাই হাত বাড়িয়ে দেবে। খড় কুটোটি ভাঙ্গতে হবে না।’ আমি বললাম, ‘সবার মা এ রকমই ভাবে।’ সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে হাত দুটো হাঁটুর ওপর রেখে বলল, ‘আগে মা কী যে ছিল, ভাবতেই পারবে না।’ আমার মন আকাশে টসটসে আম ভেসে উঠছে। সোনার বরণ আম রসে টইটম্বুর। দু হাতে শ্রীমতীর কোমরটা চেপে ধরতেই সে টানটান হয়ে বসল। যেন একটা বনসাই টব ছেড়ে মাটিতে পা রাখল। তার যৌবনের দীপ্তি খুলছে। আমি একমনে তাকে দেখছি। সে মৃদু হেসে বলল, ‘একেকটা জীবন মানেই একেকটা স্রোত, তাই না?’
-জীবন মানে নদী আর নদী মানে গল্পের স্রোত।
সে চোখ বুজে মাথা নাড়ছে। তাকে বুকে টেনে নিলাম। দু-জনে হাড়ে-মাসে মিশে যাচ্ছি। শিরায় শিরায় নাচনকোদন শুরু হয়ে গেছে। তার মাথার চুল ঝর্ণার স্রোতের মত এঁকেবেঁকে নেমেছে। আমি আলতো করে তার চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিলাম। তার দু চোখ হাসি ফুটছে। আমি চোখ সরাতেই পারছি না। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে রক্তজবার মতো পাপড়ি মেলে আমাকে পাঁচ দিক থেকে ঘিরে ফেলল। আমার পঞ্চেন্দ্রিয় পথরুদ্ধ হয়ে ছটফট করছে। তার মুখ থেকে রক্তরঙা জিভ বেরিয়ে আসছে। জিভের ডগায় অজস্র সোনালি মুকুর। সে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। যেন সে এক মনস্তাত্বিক আক্রমনে উদ্যত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আমার তো লড়াই করার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি বুঝতে পারছি রক্তের স্বাদ না নিয়ে সে ছাড়বেই না। তবুও তার কাছে হেরে যেতেই ইচ্ছে করছে। তাতেই যেন আমার আনন্দ। কিন্তু যেই না নিজেকে ছেড়ে দিলাম সে হঠাত মৃদু হেসে আমার মাথার চুল ক'টা ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘তুমি কুড়ি-কুড়িটা বছর এগিয়ে আছ। ক-জনের সাধ্য তোমাকে ধরে?’ তারপর বিরাট নৈঃশব্দ্য।
আমি একটু একটু করে তার ভেতরে সিঁড়ি নামিয়ে বছরের পর বছর নেমেই চললাম। আর সেও ধাপে ধাপে উঠে এলো। আমরা যখন একুশে থিতু হলাম সে তার মাথার ঘন চুলে আমার মাথা ঢেকে দিল। অন্ধকারে লাল গোলাপের মতো পাপড়ি খুলতে খুলতে সে হঠাতই সূর্যমুখীর মতো হেসে উঠল। আমি সুর্য হতে হতে ছলকে উঠেছি। সে তখন জাফরানি ক্ষেতের মতো আদিগন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ছুটে ছুটে সমস্ত পাপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৌমাছির মত হূল ফুটিয়ে দিলাম। তার হৃদয় উথলে উঠলো। বেগুনি-নীল রক্ত ছলকে পড়ছে। সমস্ত শিরা-উপশিরা শীতের পাতাঝরা গাছের ডালের মতো রক্ত চুষে চুষে নীল হয়ে উঠছে। তার শরীরজুড়ে গভীর রাত্রি। আমি গাছের মতো মাথা তুলে আকাশ খুঁজছি। সে লতার মতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। আমি খুঁজছি নক্ষত্রপুঞ্জ। কিন্তু সে জোনাকির স্রোত বইয়ে দিল। উজ্জ্বল জোছনায় নীল তরঙ্গ বইছে। ফুরফুরে মেজাজ। বিকেলের সোনালি আকাশে কমলা রঙের হাওয়ায় আমি রামধনুর মতো ভাসতে চাইছি। কিন্তু সে তার সমস্ত চুল বাঁদিকে টেনে এনে গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। তার পুরুষ্টু ঠোঁটে সাদা সাদা দাঁত গোলাপি দাগ এঁকে বসে আছে। নাকের ওপর কালো তিলটা অন্ধকারে লাইটহাউসের মতো জ্বলছে। এ যেন তার ঔদ্ধত্য। আমি তার প্রশংসা না করে পারছি না। তার দু'চোখ জুড়ে অচেনা দিগন্ত। বহুদূরের আকাশ ভেসে আসছে। আমি তার মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ষোড়শী, কি এত ভাবছো?’ সে মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে দু হাত কোলে নামিয়ে পিঠ টানটান করে বসলো। তার মুখটা বিকেলের পদ্মের মতো ফুটে উঠল। মাথার চুল বুকের ওপর টেনে এনে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে সে আমার চোখে চোখ রাখলো। তার দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন। আমি এ ফুল ও ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার ভেতরে ছুটে বেড়াচ্ছি। কি যে খুঁজছি, খুঁজতে খুঁজতে সবই ভুলে গেছি। সে বলছে, চল্লিশের কোঠায় চাহিদা অন্যরকম। মা বলেছিল, ‘চল্লিশ ছুঁলেই চালসে ধরে। শুধু মনে হয়, আমি যা চাইছি তা কেন পাব না?’
-নিরাপত্তাহীনতা?
আমি প্রশ্ন করলাম। সে এক দিকের বিনুনি শেষ করে আরেক দিকে বাঁধতে শুরু করে বলল, ‘না, ঠিক তা নয়। অনেকটাই হারাই-হারাই ভাব।’
-সে তো কম বয়েসে হয়। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিতে হয় নিজেরটা ঠিক আছে কিনা।
- দেখবে, চল্লিশে এসে তোমার ষোড়শীও পাল্টে যাবে।
শ্রীমতীর ঠোঁটে মৃদু হাসি। দু গালে টোল পড়েছে। নাকের সেই কালো তিলটা তার সারা মুখ আলো করে তাকিয়ে আছে। অপরূপ সৌন্দর্য। বিজ্ঞ-বিজ্ঞ ভাব করে বললাম, ‘সে তো হরমোনের প্রভাব।’
-তাই হবে! কেন যেন সকলেই ভাবতে শুরু করে সবকিছু আত্মসাৎ করার হক তার একারই। মা ভাবতে শুরু করল আমি শুধু তারই, বাবার কেউ না। বাবার ভাবনাও ঠিক একই রকম। আমি যেন দু’জনের মাঝখানে নিতান্ত একটা সম্পদ।
সে ঠোঁট টিপে আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কি বলবে বা করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমনটা আমার হতো সূর্যাস্তের পরে। সব রঙ নিভে গেলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে যেত। কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম, ‘সব মা-বাবাই সন্তানকে আগলে রাখতে চায়।’
-না, আঁকড়ে ধরার ইচ্ছা। আগলে রাখা তো ষোলয় পা দিতে না দিতেই শুরু হয়েছিল। কেমন বন্দি বন্দি লাগত।
-নাইট কুইন ফুটতে দেখেছ? দুপুর রাতে মালকোষের তালে তালে ফুটতে শুরু করে। যেই না সোহিনী রাগ থেমে যায়, ভোরবেলা গুটিয়ে যায়। যে রাত জাগে না সে জানেই না সে ফুলই বা কেমন বা আর তার সুগন্ধও বা কেমন।
-আমি কিন্তু নিশাচর। নীল অপরাজিতার মতো বসে বসে পাঁচমিশেলি গন্ধ শুঁকি।
-নীল অপরাজিতা? আহা! তার মধ্যিখানের হাঁ-করা সেই কলসিটা দেখলেই তো আমি হারিয়ে যাই।
শ্রীমতী মুচকি হেসে আড়চোখে আমাকে মাপতে মাপতে বিনুনি জোড়া বুকের ওপর ফেলে পিছনে হাত দুটো নামিয়ে দিয়ে টানটান করে আকাশের দিকে তাকালো। আস্তে করে বললাম, ‘বড়ো সুন্দর লাগছে।’ সে ঝট করে আমার দিকে ফিরল। ডালিয়া ফুলের মতো তার উদ্ধত বুক। সরু কোমর। গালের নীল নীল শিরা গলা বেয়ে বুকের ওপর নেমে এসেছে। আমার মন বলছে বুকের উদ্ধত্যই তার ঐশ্বর্য। সে বলল, ‘চল গাছের ছায়ায় বসি।’ তার এই জিরিয়ে নেবার ইচ্ছেতেই সে শীত আর বসন্তের মাঝামাঝি আটকে রইল। না-ফোটা কুঁড়ির গায়ে একটু গরম হাওয়ার মতো দৃষ্টি মেলে দিলাম। সে ছুটতে ছুটতে আরো কুড়িটা বছর পেরিয়ে গেল। ফোটা ফুলের মতো সেও শুকোতে শুরু করেছে। বসন্তের জোর হাওয়ায় তার গা থেকে একটা একটা করে শুকনো পাপড়ি খসে পড়ছে। চৈত্রের দুপুরের কথা ভেবে ভেবে সে অস্থির। মাথার চুল ক-টা পুঁটলির মত বেঁধে কোলের বালিশে কনুই ঠেকিয়ে সে গালে হাত দিয়ে বসল। তার দৃষ্টিতে নদীর উজান যাত্রা। পাথর ঠেলে ঠেলে নদী আর পিছোতে পারে না। তার চোখে মুখে বড়ো কষ্টের ছাপ। একদিন বললাম, ‘শ্রীমতী চলো না, নিরিবিলিতে দু দিন কাটিয়ে আসি।’ সে আমার হাত ধরে সবুজ ঘাসের উপর গিয়ে বসল। সামনেই ছোট নদী তিরতির করে বইছে। আকাশটা বড়ো শান্ত। নদীর শব্দ শুনতে শুনতে সে উপুড় হয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। মাথার চুলে মুখ ঢাকা। সে বলল, ‘চুপ! মাটির কথা শুনি।’ রোদ্দুরে তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অন্যরকম ছায়া পড়ছে। অন্তর্বাসে ঢাকা জায়গাগুলো তখনো বেশী উজ্জ্বল। দু হাতে তেল নিয়ে তার সারা গায়ে মাখাতে মাখাতে ভূষণ্ডির মাঠের সেই দাঁড় কাকের মত আমিও তার গায়ের প্রতিটি রোমকূপের গল্প মুখস্থ করছি। দেখতে দেখতে মাটির রস আর রোদের তেজ নিয়ে সে বাদামী রঙের দম দেওয়া পুতুলের মত লাফিয়ে উঠলো। আমার মাথাটা টেনে নিয়ে বলল, ‘কুড়ি কুড়ি বছর পথ হেঁটে মানুষ কি আবার কুড়িতে ফিরতে পারে?’
-আমি তো একুশেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছি। পৃথিবীটাই পালটে যাচ্ছে।
-জীবন বড় অদ্ভূত!
কিছুক্ষণ নির্বিকার তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নদীতে নেমে এপার ওপার করতে লাগল। ঠিক যেন বিরাট একটা শাঁখ চিত সাঁতার কেটে ছুটছে। আমি এদিক সেদিক করতে করতে সাদা সাদা টগর ফুল দেখে এগিয়ে গেলাম। একটা ফুল পাপড়ি খুলতে খুলতে আটকে গেছে। ফুলটা বোঁটা থেকে ছিঁড়ে নিলাম। কেন যেন তাকে আর ফুটতে দিতে চাইছি না। শ্রীমতী জলে পাক খেতে খেতে ফুঁ দিয়ে আকাশে জল ছুঁড়ে দিল। নদীটা ছুটতে ছুটতে সমুদ্র হয়ে গেল। সমুদ্রের ডাক যেন হাজারটা শাঁখের গর্জনের মতো চারিদিক কাঁপিয়ে দিল। সেই মহাজাগতিক ধ্বনি শুনতে শুনতে ধূসর বেলাভূমিতে বসে বসে টগরের সাথে তাকে মিলিয়ে দেখছি। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কি অত দেখ?’ ফুলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ফুল হাতে নিয়ে বলল, ‘এখনও তো পুরোটা ফুটে ওঠে নি। গন্ধ ছাড়বে কখন?’
-তাই তো ভাবছি, শ্রীমতী না শংখিনী কে আগে ফুটবে?
-ফুটলেই তো নাটকের climax, তারপরেই নাটকের যবনিকা পতন। তরতর করে আশি ছুঁয়ে একশ, অকল্পনীয়! কে আর বুড়ি হয়ে মরতে চায়?
-ভয় নাই, আমি আছি তো।
-আহা আমার বার্দ্ধক্যের বারাণসী রে!
আমার সারা মুখে নাক-মুখ ঘষে ঘষে সে যেন মিলিয়ে যেতে চাইছে। তার কোমর ধরে তাকে শূন্যে তুলে ধরলাম। সত্যি সত্যিই সে তো শিশুর মতোই খিলখিল করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। তার বুকের কাঁপুনীতে যৌবনের উদ্দীপনা। মেঘে মেঘে আকাশটা ঢাকা পড়ছে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘বৃষ্টি হবে নাকি?’
-মনে তো হয় ঝড় উঠবে। বৃষ্টি হলে ভিজব, মজা হবে।
-আর যদি উড়িয়ে নিয়ে যায়?
-প্রাণ উড়ে যাবে কিন্তু মন তো যাবে না।
সে আমার বুকে মুখ গুঁজে জাপটে ধরে বলল, ‘আমার কিন্তু ভয় করে।’ আমি তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে গোছা চুল সরিয়ে তার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বললাম, ‘ভয় নাই, আমিও উড়ে উড়ে ঠিক উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনব।’ সে আমাকে ঠেলে দিয়ে হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঐ দেখ ময়ূর ডাকছে!’ সত্যি সত্যি নদীর উল্টোদিকে ময়ূরের দল। কেউ কেউ আবার পেখম তুলে নাচছে। পুচ্ছের সে কী আস্ফালন! চারিদিকে পাতা খসে খসে পড়ছে। সে হাত বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারে সব চাপা পড়ছে। সে বলছে, ‘জানো তো ময়ূর ময়ূরী আড়াল ছাড়া প্রেম করে না?’ তার দু চোখে হাজার শঙ্খিনীর ডাক। যেন সিঁড়ির দরজা খোলাই আছে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে তার ভেতরে নামছি। সিঁড়ির দু’পাশে দু’পা তুলে মাথা নীচু করে সে বাঁশি বাজিয়েই চলেছে। কালের স্রোত থেমে আছে। সত্যি সত্যি আমার তখন নাচতে ইচ্ছে করছে। বাঁশির সুরে সুরে সবকিছুই নাচছে। তাকে ডাকলাম। সে উঠে এসেই দাঁত দিয়ে টগরফুলের বোঁটা কেটে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার শংখিনী।’ তার মোহিনী মূর্তি ফুটে উঠছে। অলৌকিক শংখধ্বনি আর অতুলনীয় শোভা আমাকে গ্রাস করছে। সে দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। তার দু চোখেই প্রথম দেখা সেই হাজারো নীল তারার নির্বিকার দৃষ্টি। অন্ধকারের ভেতর থেকে তার আয়ত দুটি চোখ লাইটহাউসের প্রদীপের মতো ঘুরে ঘুরে আলোয় আলোয় পথ দেখিয়েই চলেছে।
=========================
সুদর্শন ব্রহ্মচারী
================ =========
শ্রীমতী আমার কোলে মাথা রেখে কুড়ি বছর আগের গল্প বলছে, ‘তখন সবে মাটি আঁকড়ে পৃথিবীটা দেখতে শুরু করেছি। যা কিছু দেখি শুনি ছবি এঁকে এঁকে সব মুখস্ত করে রাখি। সারাক্ষণ মায়ের গন্ধ ঘিরে রাখে। মায়ের ঠোটের আদর ছাড়া কিছুই ভাল্লাগে না। মা গুন গুন করে নেচে বেড়ায়। যদ্দূর দেখতে পাই ততটুকুই আমার পৃথিবী।’
খানিক থেমে সে চিত হয়ে আমার ঠোঁটে আঙ্গুলের টোকা দিয়ে বলল, ‘পৃথিবীটা তখন বড়ো অদ্ভুত ছিল।’ আমি তার আঙ্গুল চুষে বললাম, ‘তোমাকে দেখলেই বড়ো টগর ফুলের আধফোটা কুঁড়ি ভেসে ওঠে।’ সে ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল জড়ো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছে, ‘এমনি করেই কি তোমার টগর ফোটে?’ আমি সত্যি সত্যি তার হাতে টগর ফুলের না-ফোটা কুঁড়িই দেখতে পাচ্ছি। সে প্রশ্ন করল, ‘আধফোটা কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখনও টগরফুল ফুটতে দেখেছ?’ সে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ।’ আমি বললাম, ‘তাহলে বলো দিকি কি ভাবে পাপড়ি খোলে?’ সে দু হাতের আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফুল ফোটানোর অভিনয় করে বলল, ‘একটু একটু ঠেলে বের করে দেয়।’
-যদি ভাবি কেউ টেনে টেনে বের করে আনে?
-কে টানে? দুঃশাসন? দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে টানাটানি? হুঁ! অত কল্পনা কেন করো?
সে উঠে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, ‘ফুল ফোটায় তো শুধু আনন্দ, যুদ্ধের কথা ভাবছ কেন?’
-কই না তো, যুদ্ধের কথা তো ভাবি না।
-তবে টানাটানি করো না, যে খোলে সে আপনিই খোলে।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি সে কী বলতে চায়। সে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি ভেবেই চলেছি। আচমকা সে এক ঝটকায় গায়ের কাপড় খুলে ফেলল। তার নিরাবরণ রূপ আমাকে গ্রাস করছে। ভ্রূয়ের মধ্যিখানে নীল টীপ, পায়ে রূপোলি নুপুর, গলায় জুঁই ফুলের মালা আর কোমরে রূপোলি বিছে-হার ছাড়া আর কোন আভরণও নেই। দেখতে দেখতে তার বুকে একজোড়া সাদা শাঁখ ফুটে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটাও দুপুরের শ্বেত শতদলের মতো হয়ে গেল। তার চোখে মুখে স্বর্গীয় হাসি। ছোট ছোট দাঁত উঁকি দিচ্ছে। আমার চোখ ফেরাতে পারছি না। সেও অপলক তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে তার মেরূদন্ড খুলে নিয়ে বাঁশির মতো বাজাতে শুরু করলাম। তার দু চোখে হাজারো কথা থৈ থৈ করে নাচছে। দেখতে দেখতে চারিদিকে সাদা সাদা ফুল ফুটে উঠল। সুগন্ধে সুগন্ধে আমার রক্তে আগুন লেগে গেল। বনভূমি জুড়ে টগরফুলের মেলা। আকাশ অন্ধকার করে যেন লক্ষ তারার বাতি জ্বলে উঠেছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
তার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শ্রীমতী, কোন দিন নিজের দিকে তাকিয়েছ?’ সে মেরূদন্ড টানটান করে সোজা হয়ে বসে আমার দখল নিয়ে বলল, ‘দেখি তো। কখনও কখনও গভীর রাতে সব যখন নীল হয়ে আসে আমি বহুদূরে নিজেকে দেখতে পাই। একটা হাঁ করা মুখ আগুনের মতো এগিয়ে আসে। যেন চারিদিকে দাঙ্গা লেগেছে। চৈত্রের দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।’ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গভীর রাতে পাকা গমের ক্ষেতে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সে চুপ করে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘টগরর পাকা ফল দেখেছ?’
-উঁহু।
সে মাথা নাড়াচ্ছে। বললাম, ‘হাঙ্গরের মতো হাঁ; দাঁত বের করে তাকিয়ে থাকে।’ সে দু বার হাঁ করে জিভ দেখিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘রঙ কি আমার জিভের মতো?’
- গাঢ় রক্তের প্রবাহ যেমন।
আমার কথা শুনে সে অন্য মনস্ক হয়ে পড়ল। খানিক ভেবে বলল, ‘জানো, আমাকেও আগুনের গোলাটা গিলতে আসে। বড্ড ভয় করে।’ আমি তার চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করছি। সে আমার বুকে মুখ গুঁজে ‘উঁহুঁহুঁউঁউঁ’ করতে করতে কামড়ে দিল। আমার মন বলছে সে নিশ্চয়ই পঞ্চমুখী শংখিনী। কথাটা তাকে বললাম। সে অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি শংখিনী?’ সে বোধ হয় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমারও চোখের পাতা পড়ছে না। কোন এক সময় সে বুকে হাত বুলোতে বুলোতে জীজ্ঞেস করল, ‘পঞ্চমুখী? অমন কেন দেখ?’
সে আমার দু দিকে পা ছড়িয়ে বসল। তার মুখে থৈ থৈ কথা। আমি ডান হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে তার মুখে আগল দিলাম। সেও বাঁ হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরল। দু জনেই ঠোঁট চেপে হাসছি। অজানা বাতাস বইছে। সে আমাকে ধরে লতাপাতার মতো মাথা তুলে আকাশে উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি নিজেকে কি ভাবে দেখ?’ সে বলল, ‘যেদিন হঠাৎ করেই কুড়ি বছর টপকে গেলাম মা বলল, ‘এই বয়েসটা অন্যরকম। সবকিছুই নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু যাই করো দেখেশুনে চলবে।’ তখন তো সারাক্ষণ আমার গায়ে বিদ্যুৎ খেলছে। বন্ধুরা বলল, "চল শ্রীমতি, একটা বিপ্লব করে দেখাই।’ সেই নিজেকে দেখা শুরু। তারপর থেকে আজও দেখেই চলেছি।
-কি বিপ্লব করলে?
-নিজেকে পালটে ফেলেছি। দেখছ না?
-সেই জন্য তো ষোড়শী বলি।
সে হো হো হো করে হাসতে হাসতে উপুড় হয়ে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, ‘নতুন কি আর বললে? কুড়ি বছর বয়েসটা ও রকমই। সব্বাইকে বিপ্লবী করেই ছাড়ে।’
- খুব ইচ্ছে করত, সমাজটাকে তছনছ করে দিই। কিন্তু-
-কিন্তু কি?
- ভাঙতে ভাঙতে বুঝলাম বিপ্লবটা আগে নিজের ভেতরেই হওয়া দরকার।
সে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি তার টলমল যৌবনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছি না। তার ভেতর দিয়ে আমি পদ্মের মৃণালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি আর সে গোলাপি পদ্মের মতো আমার মাথায় ফুটে উঠছে। চারপাশে কিসের যেন গুনগুন। পৃথিবীটা অজানা তরঙ্গে নাচছে। সে বলল, ‘এই বয়সেই আমার মা, মায়ের মতো চলতে-ফিরতে শুরু করেছিল। মা ভাবত, বাচ্চা বড়ো করছি, এবার নিশ্চয়ই সবাই হাত বাড়িয়ে দেবে। খড় কুটোটি ভাঙ্গতে হবে না।’ আমি বললাম, ‘সবার মা এ রকমই ভাবে।’ সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে হাত দুটো হাঁটুর ওপর রেখে বলল, ‘আগে মা কী যে ছিল, ভাবতেই পারবে না।’ আমার মন আকাশে টসটসে আম ভেসে উঠছে। সোনার বরণ আম রসে টইটম্বুর। দু হাতে শ্রীমতীর কোমরটা চেপে ধরতেই সে টানটান হয়ে বসল। যেন একটা বনসাই টব ছেড়ে মাটিতে পা রাখল। তার যৌবনের দীপ্তি খুলছে। আমি একমনে তাকে দেখছি। সে মৃদু হেসে বলল, ‘একেকটা জীবন মানেই একেকটা স্রোত, তাই না?’
-জীবন মানে নদী আর নদী মানে গল্পের স্রোত।
সে চোখ বুজে মাথা নাড়ছে। তাকে বুকে টেনে নিলাম। দু-জনে হাড়ে-মাসে মিশে যাচ্ছি। শিরায় শিরায় নাচনকোদন শুরু হয়ে গেছে। তার মাথার চুল ঝর্ণার স্রোতের মত এঁকেবেঁকে নেমেছে। আমি আলতো করে তার চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিলাম। তার দু চোখ হাসি ফুটছে। আমি চোখ সরাতেই পারছি না। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে রক্তজবার মতো পাপড়ি মেলে আমাকে পাঁচ দিক থেকে ঘিরে ফেলল। আমার পঞ্চেন্দ্রিয় পথরুদ্ধ হয়ে ছটফট করছে। তার মুখ থেকে রক্তরঙা জিভ বেরিয়ে আসছে। জিভের ডগায় অজস্র সোনালি মুকুর। সে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। যেন সে এক মনস্তাত্বিক আক্রমনে উদ্যত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আমার তো লড়াই করার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি বুঝতে পারছি রক্তের স্বাদ না নিয়ে সে ছাড়বেই না। তবুও তার কাছে হেরে যেতেই ইচ্ছে করছে। তাতেই যেন আমার আনন্দ। কিন্তু যেই না নিজেকে ছেড়ে দিলাম সে হঠাত মৃদু হেসে আমার মাথার চুল ক'টা ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘তুমি কুড়ি-কুড়িটা বছর এগিয়ে আছ। ক-জনের সাধ্য তোমাকে ধরে?’ তারপর বিরাট নৈঃশব্দ্য।
আমি একটু একটু করে তার ভেতরে সিঁড়ি নামিয়ে বছরের পর বছর নেমেই চললাম। আর সেও ধাপে ধাপে উঠে এলো। আমরা যখন একুশে থিতু হলাম সে তার মাথার ঘন চুলে আমার মাথা ঢেকে দিল। অন্ধকারে লাল গোলাপের মতো পাপড়ি খুলতে খুলতে সে হঠাতই সূর্যমুখীর মতো হেসে উঠল। আমি সুর্য হতে হতে ছলকে উঠেছি। সে তখন জাফরানি ক্ষেতের মতো আদিগন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ছুটে ছুটে সমস্ত পাপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৌমাছির মত হূল ফুটিয়ে দিলাম। তার হৃদয় উথলে উঠলো। বেগুনি-নীল রক্ত ছলকে পড়ছে। সমস্ত শিরা-উপশিরা শীতের পাতাঝরা গাছের ডালের মতো রক্ত চুষে চুষে নীল হয়ে উঠছে। তার শরীরজুড়ে গভীর রাত্রি। আমি গাছের মতো মাথা তুলে আকাশ খুঁজছি। সে লতার মতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। আমি খুঁজছি নক্ষত্রপুঞ্জ। কিন্তু সে জোনাকির স্রোত বইয়ে দিল। উজ্জ্বল জোছনায় নীল তরঙ্গ বইছে। ফুরফুরে মেজাজ। বিকেলের সোনালি আকাশে কমলা রঙের হাওয়ায় আমি রামধনুর মতো ভাসতে চাইছি। কিন্তু সে তার সমস্ত চুল বাঁদিকে টেনে এনে গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। তার পুরুষ্টু ঠোঁটে সাদা সাদা দাঁত গোলাপি দাগ এঁকে বসে আছে। নাকের ওপর কালো তিলটা অন্ধকারে লাইটহাউসের মতো জ্বলছে। এ যেন তার ঔদ্ধত্য। আমি তার প্রশংসা না করে পারছি না। তার দু'চোখ জুড়ে অচেনা দিগন্ত। বহুদূরের আকাশ ভেসে আসছে। আমি তার মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ষোড়শী, কি এত ভাবছো?’ সে মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে দু হাত কোলে নামিয়ে পিঠ টানটান করে বসলো। তার মুখটা বিকেলের পদ্মের মতো ফুটে উঠল। মাথার চুল বুকের ওপর টেনে এনে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে সে আমার চোখে চোখ রাখলো। তার দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন। আমি এ ফুল ও ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার ভেতরে ছুটে বেড়াচ্ছি। কি যে খুঁজছি, খুঁজতে খুঁজতে সবই ভুলে গেছি। সে বলছে, চল্লিশের কোঠায় চাহিদা অন্যরকম। মা বলেছিল, ‘চল্লিশ ছুঁলেই চালসে ধরে। শুধু মনে হয়, আমি যা চাইছি তা কেন পাব না?’
-নিরাপত্তাহীনতা?
আমি প্রশ্ন করলাম। সে এক দিকের বিনুনি শেষ করে আরেক দিকে বাঁধতে শুরু করে বলল, ‘না, ঠিক তা নয়। অনেকটাই হারাই-হারাই ভাব।’
-সে তো কম বয়েসে হয়। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিতে হয় নিজেরটা ঠিক আছে কিনা।
- দেখবে, চল্লিশে এসে তোমার ষোড়শীও পাল্টে যাবে।
শ্রীমতীর ঠোঁটে মৃদু হাসি। দু গালে টোল পড়েছে। নাকের সেই কালো তিলটা তার সারা মুখ আলো করে তাকিয়ে আছে। অপরূপ সৌন্দর্য। বিজ্ঞ-বিজ্ঞ ভাব করে বললাম, ‘সে তো হরমোনের প্রভাব।’
-তাই হবে! কেন যেন সকলেই ভাবতে শুরু করে সবকিছু আত্মসাৎ করার হক তার একারই। মা ভাবতে শুরু করল আমি শুধু তারই, বাবার কেউ না। বাবার ভাবনাও ঠিক একই রকম। আমি যেন দু’জনের মাঝখানে নিতান্ত একটা সম্পদ।
সে ঠোঁট টিপে আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কি বলবে বা করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমনটা আমার হতো সূর্যাস্তের পরে। সব রঙ নিভে গেলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে যেত। কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম, ‘সব মা-বাবাই সন্তানকে আগলে রাখতে চায়।’
-না, আঁকড়ে ধরার ইচ্ছা। আগলে রাখা তো ষোলয় পা দিতে না দিতেই শুরু হয়েছিল। কেমন বন্দি বন্দি লাগত।
-নাইট কুইন ফুটতে দেখেছ? দুপুর রাতে মালকোষের তালে তালে ফুটতে শুরু করে। যেই না সোহিনী রাগ থেমে যায়, ভোরবেলা গুটিয়ে যায়। যে রাত জাগে না সে জানেই না সে ফুলই বা কেমন বা আর তার সুগন্ধও বা কেমন।
-আমি কিন্তু নিশাচর। নীল অপরাজিতার মতো বসে বসে পাঁচমিশেলি গন্ধ শুঁকি।
-নীল অপরাজিতা? আহা! তার মধ্যিখানের হাঁ-করা সেই কলসিটা দেখলেই তো আমি হারিয়ে যাই।
শ্রীমতী মুচকি হেসে আড়চোখে আমাকে মাপতে মাপতে বিনুনি জোড়া বুকের ওপর ফেলে পিছনে হাত দুটো নামিয়ে দিয়ে টানটান করে আকাশের দিকে তাকালো। আস্তে করে বললাম, ‘বড়ো সুন্দর লাগছে।’ সে ঝট করে আমার দিকে ফিরল। ডালিয়া ফুলের মতো তার উদ্ধত বুক। সরু কোমর। গালের নীল নীল শিরা গলা বেয়ে বুকের ওপর নেমে এসেছে। আমার মন বলছে বুকের উদ্ধত্যই তার ঐশ্বর্য। সে বলল, ‘চল গাছের ছায়ায় বসি।’ তার এই জিরিয়ে নেবার ইচ্ছেতেই সে শীত আর বসন্তের মাঝামাঝি আটকে রইল। না-ফোটা কুঁড়ির গায়ে একটু গরম হাওয়ার মতো দৃষ্টি মেলে দিলাম। সে ছুটতে ছুটতে আরো কুড়িটা বছর পেরিয়ে গেল। ফোটা ফুলের মতো সেও শুকোতে শুরু করেছে। বসন্তের জোর হাওয়ায় তার গা থেকে একটা একটা করে শুকনো পাপড়ি খসে পড়ছে। চৈত্রের দুপুরের কথা ভেবে ভেবে সে অস্থির। মাথার চুল ক-টা পুঁটলির মত বেঁধে কোলের বালিশে কনুই ঠেকিয়ে সে গালে হাত দিয়ে বসল। তার দৃষ্টিতে নদীর উজান যাত্রা। পাথর ঠেলে ঠেলে নদী আর পিছোতে পারে না। তার চোখে মুখে বড়ো কষ্টের ছাপ। একদিন বললাম, ‘শ্রীমতী চলো না, নিরিবিলিতে দু দিন কাটিয়ে আসি।’ সে আমার হাত ধরে সবুজ ঘাসের উপর গিয়ে বসল। সামনেই ছোট নদী তিরতির করে বইছে। আকাশটা বড়ো শান্ত। নদীর শব্দ শুনতে শুনতে সে উপুড় হয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। মাথার চুলে মুখ ঢাকা। সে বলল, ‘চুপ! মাটির কথা শুনি।’ রোদ্দুরে তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অন্যরকম ছায়া পড়ছে। অন্তর্বাসে ঢাকা জায়গাগুলো তখনো বেশী উজ্জ্বল। দু হাতে তেল নিয়ে তার সারা গায়ে মাখাতে মাখাতে ভূষণ্ডির মাঠের সেই দাঁড় কাকের মত আমিও তার গায়ের প্রতিটি রোমকূপের গল্প মুখস্থ করছি। দেখতে দেখতে মাটির রস আর রোদের তেজ নিয়ে সে বাদামী রঙের দম দেওয়া পুতুলের মত লাফিয়ে উঠলো। আমার মাথাটা টেনে নিয়ে বলল, ‘কুড়ি কুড়ি বছর পথ হেঁটে মানুষ কি আবার কুড়িতে ফিরতে পারে?’
-আমি তো একুশেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছি। পৃথিবীটাই পালটে যাচ্ছে।
-জীবন বড় অদ্ভূত!
কিছুক্ষণ নির্বিকার তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নদীতে নেমে এপার ওপার করতে লাগল। ঠিক যেন বিরাট একটা শাঁখ চিত সাঁতার কেটে ছুটছে। আমি এদিক সেদিক করতে করতে সাদা সাদা টগর ফুল দেখে এগিয়ে গেলাম। একটা ফুল পাপড়ি খুলতে খুলতে আটকে গেছে। ফুলটা বোঁটা থেকে ছিঁড়ে নিলাম। কেন যেন তাকে আর ফুটতে দিতে চাইছি না। শ্রীমতী জলে পাক খেতে খেতে ফুঁ দিয়ে আকাশে জল ছুঁড়ে দিল। নদীটা ছুটতে ছুটতে সমুদ্র হয়ে গেল। সমুদ্রের ডাক যেন হাজারটা শাঁখের গর্জনের মতো চারিদিক কাঁপিয়ে দিল। সেই মহাজাগতিক ধ্বনি শুনতে শুনতে ধূসর বেলাভূমিতে বসে বসে টগরের সাথে তাকে মিলিয়ে দেখছি। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কি অত দেখ?’ ফুলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ফুল হাতে নিয়ে বলল, ‘এখনও তো পুরোটা ফুটে ওঠে নি। গন্ধ ছাড়বে কখন?’
-তাই তো ভাবছি, শ্রীমতী না শংখিনী কে আগে ফুটবে?
-ফুটলেই তো নাটকের climax, তারপরেই নাটকের যবনিকা পতন। তরতর করে আশি ছুঁয়ে একশ, অকল্পনীয়! কে আর বুড়ি হয়ে মরতে চায়?
-ভয় নাই, আমি আছি তো।
-আহা আমার বার্দ্ধক্যের বারাণসী রে!
আমার সারা মুখে নাক-মুখ ঘষে ঘষে সে যেন মিলিয়ে যেতে চাইছে। তার কোমর ধরে তাকে শূন্যে তুলে ধরলাম। সত্যি সত্যিই সে তো শিশুর মতোই খিলখিল করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। তার বুকের কাঁপুনীতে যৌবনের উদ্দীপনা। মেঘে মেঘে আকাশটা ঢাকা পড়ছে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘বৃষ্টি হবে নাকি?’
-মনে তো হয় ঝড় উঠবে। বৃষ্টি হলে ভিজব, মজা হবে।
-আর যদি উড়িয়ে নিয়ে যায়?
-প্রাণ উড়ে যাবে কিন্তু মন তো যাবে না।
সে আমার বুকে মুখ গুঁজে জাপটে ধরে বলল, ‘আমার কিন্তু ভয় করে।’ আমি তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে গোছা চুল সরিয়ে তার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বললাম, ‘ভয় নাই, আমিও উড়ে উড়ে ঠিক উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনব।’ সে আমাকে ঠেলে দিয়ে হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঐ দেখ ময়ূর ডাকছে!’ সত্যি সত্যি নদীর উল্টোদিকে ময়ূরের দল। কেউ কেউ আবার পেখম তুলে নাচছে। পুচ্ছের সে কী আস্ফালন! চারিদিকে পাতা খসে খসে পড়ছে। সে হাত বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারে সব চাপা পড়ছে। সে বলছে, ‘জানো তো ময়ূর ময়ূরী আড়াল ছাড়া প্রেম করে না?’ তার দু চোখে হাজার শঙ্খিনীর ডাক। যেন সিঁড়ির দরজা খোলাই আছে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে তার ভেতরে নামছি। সিঁড়ির দু’পাশে দু’পা তুলে মাথা নীচু করে সে বাঁশি বাজিয়েই চলেছে। কালের স্রোত থেমে আছে। সত্যি সত্যি আমার তখন নাচতে ইচ্ছে করছে। বাঁশির সুরে সুরে সবকিছুই নাচছে। তাকে ডাকলাম। সে উঠে এসেই দাঁত দিয়ে টগরফুলের বোঁটা কেটে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার শংখিনী।’ তার মোহিনী মূর্তি ফুটে উঠছে। অলৌকিক শংখধ্বনি আর অতুলনীয় শোভা আমাকে গ্রাস করছে। সে দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। তার দু চোখেই প্রথম দেখা সেই হাজারো নীল তারার নির্বিকার দৃষ্টি। অন্ধকারের ভেতর থেকে তার আয়ত দুটি চোখ লাইটহাউসের প্রদীপের মতো ঘুরে ঘুরে আলোয় আলোয় পথ দেখিয়েই চলেছে।
খুব সুন্দর
উত্তরমুছুন