অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু ,বিরহ দহন লাগে




আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু ,বিরহ দহন লাগে

================================
ভাস্কর পাল
===============================

“জীবন আর মরণ তো একই সত্ত্বার দুই দিক- চৈতন্যে ঘুম আর জাগরণ যেমন!” বলেছিলেন কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বাসন্তী দেবীকে তাঁর ১৫ই কার্ত্তিক ১৩৩৮-এ লেখা একটি পত্রে । কবির প্রজ্ঞায় ধরা পড়েছিল মৃত্যু কিন্তু বিলুপ্তি নয়। কবি অনুভব করেছিলেন, মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের পরিপূর্ণ মুক্তি। সম্পূর্ণ প্রকাশ। পুরানো যা কিছু, তাকে নূতনের জন্য জায়গা করে দিয়ে যেতে হবে। মৃত্যুর সেই দূয়ারেই জীবনের মহাযজ্ঞ। আর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই পরিণতির মাত্রায় প্রকাশিত হয় জীবন, তার পূর্ণতায়!


মৃত্যুকে বিলুপ্তির হাহাকারের সীমানায় যে দেখা, যে দেখার মধ্যে দিয়ে আপামর মানুষ কালের পথরেখা ধরে শোকে কাতর হয়ে বিলাপ করে চলে কবি রবীন্দ্রনাথ সেই দেখা কে বলেছেন খণ্ডিত দেখা, তা অসম্পূর্ণ! তাই তা পূর্ণ সত্য নয়! শোক আমাদের গতি রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে! মুছে যেতে থাকে সামনের পথরেখা! জীবনের প্রবাহমানতা বিঘ্নিত হয়, শোকের আতিশয্যে বিহ্বল হয়ে আমরা মৃত্যুকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করি না। জীবনকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করতে হলে মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তাকে অনুধাবন করা প্রয়োজন!

মৃত্যু আর জীবনের মাঝের এই সময়টুকু নিয়েই আমাদের যত আয়োজন, যত আনন্দ যত অনুভব সুখস্মৃতি ।আমরা যদি খুব গভীর ভাবে অনুভব করি তাহলে দেখতে পাবো সমস্ত আয়োজনের মাঝেই আছে সমাপ্তির আভাস । মানুষের জীবনের এই অসহায় সমাপ্তি আর মৃত্যু যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে কেটে আসছে গভীর দাগ, জীবনের অক্ষয় এই সত্য ভাবিয়ে তুলেছে মানুষকে। আর এই কথা প্রতিফলিত হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ।গীতায় আত্মতত্ত্বের যে পটভূমি তা আমিত্ববোধের হতাশা ও তার থেকে উত্তরণের এক দার্শনিক সৃষ্টি ।

গীতা – অধ্যায় ০২ – শ্লোক ২২ এ বলা হয়েছে

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি।
তথা শরীরানি বিহায় জীর্ণা-
ন্যানানি সংযাতি নবানি দেহী ॥ ২-২২॥

এর অর্থ যেরূপ মানুষ পুরোনো বস্ত্রগুলি ত্যাগ করে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহন করে, সেইরূপ জীবাত্মা পুরাতন শরীর সকল ত্যাগ করে অন্য নূতন শরীর প্রাপ্ত হয়।

আমরা গীতা – অধ্যায় ০২ – শ্লোক ২৭ এ যদি দেখি, সেখানে বলা হয়েছে

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ॥ ২-২৭॥

অর্থাৎ, যে জন্মগ্রহন করেছে, তার মৃত্যু নিশ্চিত আবার যে মরে তার জন্মও নিশ্চিত। সুতরাং যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

একই ভাবে গীতা – অধ্যায় ০২ – শ্লোক ২৩ শ্লোকে অবিনাশী আত্মার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥ ২-২৩॥

যেহেতু আত্মাকে কেউ বধ করতে পারে না ও তার বিনাশ নেই তাই এর দেহ পরিবর্তনে বা মৃত্যুতে কারো শোক করা উচিত নয়। যিনি তত্ত্বজ্ঞ জ্ঞানী তিনি কখনই কারো মৃত্যুতে শোক করেন না।

অথচ মানব সমাজে প্রতিটি মুহূর্তেই কোনো না কোনো মানুষ শোকাহত হয়ে পড়ছে। প্রতিমুহূর্তেই কারো না কারো পরম আত্মীয় মারা যাচ্ছে, সে শোকাহত হচ্ছে। সাধারণত শোকরস মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হয়। অর্থাৎ যেখানে মৃত্যু আছে, সেখানে শোকও আছে। আপনজন, প্রিয় মানুষ, আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুজনিত বিয়োগবেদনায় মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, বিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রিয়জনের আসনটি শূন্য হলে মানুষের মনের গহীনে প্রিয়জনের ভবিষ্যৎ অনুপস্থিতি ভেসে উঠতে থাকে। অনুপস্থিতির এই অনুভূতিকেই শোকসন্তপ্ত বলা হয়ে থাকে। নিজের মৃত্যু কল্পনা করে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে । সে মৃত্যু মেনে নিতে পারে না এবং প্রিয়জনের মৃত্যুকেও মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না ,আর পারে না বলেই মনের মধ্যে তৈরি হয় তীব্র আফসোস । মানুষ অনুভব করতে থাকে এক প্রকারের নিঃসঙ্গতা, হতাশা ।

প্রাচীন ভারতীয় পৌরাণিক সময়ে যদি তাকাই , কথিত আছে, কোন একদিন মুনিবর বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সাথে নিয়ে তমসা নদীতে স্নান করার যাত্রা পথে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক শোভা দেখে বিমুগ্ধ হয়ে ইতস্তত বিচরণ করছিলেন । এক ব্যাধ বাল্মীকির সম্মুখেই এক ক্রৌঞ্চযুগলের মধ্যে পুরুষ ক্রৌঞ্চকে তীরবিদ্ধ করে। স্ত্রী ক্রৌঞ্চটি করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ বাল্মীকির মুখ থেকে অভিশাপ বাণীর আকারে উচ্চারিত হয় সৃষ্টির প্রথম শ্লোক

‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ’

এটিই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক। শোক থেকে শ্লোক। নিহত পাখির শোক থেকেই উৎসারিত বাক্য বলেই শোক এর কাব্যিক প্রকাশ ‘শ্লোক’

তাহলে শোক কী?

কোনও কিছু চিরতরে হারালে আমরা যে আবেগ অনুভব করি — কোনও প্রিয় ব্যক্তি বা কোনও প্রিয় বস্তু, যার অভাব কোনও ভাবেই পূরণ করা যায় না, তাকেই বলে শোক। এই জন্যেই মানুষ প্রেমে বিচ্ছেদের পরে, প্রিয়জনকে হারিয়ে, নিজের পোষা প্রাণীটি মারা গেলে অথবা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বা সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। কারণ তাঁদের মনের মাঝে আঁকা জীবনের সুন্দর ছবিটা তখন ভেঙ্গে যায়।

মেগান ডিভাইন তাঁর ইট’স ওকে দ্যাট ইউ আর নট ওকে বইটিতে শোকের প্রতি সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “শোককে এক ব্যতিক্রমি, স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনের বহির্ভূত আবেগ হিসেবে ধরা হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে এক ধরনের বিকার হিসেবেই দেখা হয়। আমরা বিশ্বাস করি যে শোক হল জটিল পরিস্থিতিতে এক সাময়িক প্রতিক্রিয়া, যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেটে যাবে।”

কিন্তু সবার আগে সেই শোকস্তব্ধ ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতি ও হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে তাঁর সম্পর্কটা বুঝতে হবে। ব্যক্তির অনুভব করা শোকের গভীরতা এই সম্পর্কই নির্ধারণ করে।

নিরবিছিন্ন শোক আমাদের মস্তিষ্ক মনন ও শরীরের উপরে প্রভাব ফেলে। এর ফলে ব্যাক্তিটির যে সব সমস্যা উদ্ভুত হয় সেগুলি এই রূপ ।

মনঃসংযোগের অভাব,
বাস্তবের সঙ্গে ক্রমবিচ্ছেদ
মাথাব্যাথা ও খিটখিটে ভাব
সময়ানুবর্তিতার অভাব
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং পরিবার ও বন্ধুদের থেকে নিজেকে ক্রমে ক্রমে গুটিয়ে নেওয়া
অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস — অত্যধিক খাবার খাওয়া বা না খাওয়া


কিন্তু এরকম কেন হয়?

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, একজন শোকাচ্ছন্ন ব্যক্তির মস্তিস্কের অ্যামিগডালা অংশটি আমাদের আশেপাশের পরিস্থিতি নির্ধারণের জন্য দায়বদ্ধ । এই অংশটির অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার জন্য মস্তিষ্কে নিউরনগুলো বদলে যায়।এর ফলে শুধু মস্তিষ্কেই না, আমাদের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও নানা রকমের পরিবর্তন দেখা দেয় ।অ্যামিগডালা মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের অংশ, যা অনুভূতি এবং উদ্দীপনা সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিক্রিয়াগুলির সাথে জড়িত।মস্তিস্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিন ( Serotonin) বা ৫-হাইড্রক্সিট্রিপ্টামিন হল মস্তিষ্কের স্নায়ুকে সংযোগকারী একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যার রাসায়নিক নাম ৫-হাইড্রক্সিট্রিপ্টামিন। রক্তনালিকায় রক্ত প্রবাহে এটি সাহায্য করে। এটি মানুষের ক্ষেত্রে ভাল থাকার অনুভূতি প্রদান করে| তাই একে অনেকসময় সুখানুভূতির হরমোন বলা হয় । যদিও এটি হরমোন নয়, এটি একটি মনোএমাইন।তবে সেরোটোনিন কীভাবে সংবেদনশীল প্রসেসিংকে প্রভাবিত করে এবং এর প্রভাব ও তার পরীক্ষামূলক এবং গণনামূলক বিবরণগুলি হতাশার নিউরোসাইকোলজি এবং ফার্মাকোলজিকাল চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয় ।

মনস্তত্ত্ববিদ এলিজাবেথ কুবলার রস তাঁর “ডেথ অ্যান্ড ডাইং” বইটিতে শোক এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করেছেন এগুলি হল –Deny বা অস্বীকার, Anger বা রাগ , Bargaining বা দর কষাকষি, Exhaustion বা অবসাদ এবং Accept বা স্বীকার ।

একজন শোকাছন্ন মানুষের প্রথম লড়াই শুরু হয় নিজের সাথে। সে বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বীকার করতে চায় । তাঁর নিজের পাশের পরিস্থিতি ও পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর বিতৃষ্ণা জন্মায় ও সে সহজেই রেগে যায় ।

সে বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে ও পূর্বতন পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সহজাত দর কষাকষি করে বা বিনিময় ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয় ।

এই পর্যায় ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে নিজের ক্ষতির মাত্রা উপলব্ধি করতে শুরু করেন। এই সময়ে তাঁরা পরিবার পরিজনদের এড়িয়ে চলতে পারেন বা সব সময় বিষণ্ণ থাকতে পারেন । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে যেহেতু এই সময়টাতে সেই ব্যক্তি তাঁর শোককে উপলব্ধি করছেন, সেহেতু তাঁকে তাঁর মতন করে সময় দেওয়া উচিত এবং কোনও বাধা ছাড়াই তাঁদের আবেগের জোয়ারে ভাসতে দেওয়া উচিত।

শোকাতুর ব্যক্তি তাঁর হারানোর যন্ত্রণাকে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা বা তার মোকাবিলা করার রাস্তা খুঁজতে থাকেন।

সাধারণ ভাবে শোককে এই ক’টি পর্যায়ে ভাগ করা গেলেও, সবাই সব পর্যায় বা পর পর সবকটির মুখোমুখি নাও হতে পারেন।

প্রত্যেক মানুষের শোকের অভিজ্ঞতা একে অপরের থেকে আলাদা — কাজেই পুঁথিগত নিয়ম অনুযায়ী সবাই একই পর্যায়গুলি অনুভব করেন না। এটি অনেকটাই নির্ভর করে সেই ব্যক্তির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপরে, এবং শোকের মোকাবিলা করার জন্যে তাঁদের মানসিক স্থিতিস্থাপকতার উপরে।

শোকের বাখ্যা করা এবং শোক ও মনের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক খুঁজে তাদের মধ্যেকার সাযুজ্য বের করা ও সেটিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অনেকগুলি তত্বের অবতরনা করা হয়েছে । এবিষয়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের শোক তত্ত্ব, বোল্বির সংযুক্তি তত্ত্ব, স্ট্রোবি এবং শুটসের দ্বৈত প্রক্রিয়া মডেল, এবং নেইমির অর্থ পুনর্গঠন মডেল বিশেষ ভাবে আলোকপাত করে ।

ফ্রয়েড মূল ‘শোকের কাজ’ তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিল, কাবলার-রস ‘মঞ্চ তত্ত্বের’ প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে শোক ও অস্বীকৃতি, ক্রোধ, ক্ষোভ এবং অপরাধবোধ, হতাশা এবং অবশেষে স্বীকৃতি সহ একাধিক পূর্বাভাসযোগ্য পর্যায় জুড়ে শোক এগিয়ে যায়। স্ট্রোবি এবং শুট একটি 'দ্বৈত-প্রক্রিয়া মডেল' প্রস্তাব করেছিলেন বনান্ন এট আল পরামর্শ দিয়েছিল যে দীর্ঘস্থায়ী শোকটি ক্ষতি-পূর্ব নির্ভরতা এবং মৃত্যুর প্রাক-লোকসানের গ্রহণযোগ্যতার সাথে স্থিতিস্থাপকতার সাথে জড়িত, যেখানে নেইমায়ার এবং স্যান্ডস পরামর্শ দিয়েছেন যে অর্থের গঠনটি দুঃখের মূল বিষয়। হল প্রস্তাব দিয়েছে যে লোকসান হ'ল জীবন-বর্ধনশীল ‘পোস্ট-ট্রমাটিক’ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সরবরাহ করে কারণ ব্যক্তি ক্ষতি এবং স্থিতিস্থাপকতার পাঠকে একীভূত করে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব মতে “মানুষের অবচেতন মনে অনেক কামনা-বাসনা অবদমিত অবস্থায় থাকে এর অনেক কিছুই স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পায়’’- এটাই ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব।

ফ্রয়েড মানুষের মন কে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন।
চেতন (Conscious)
অবচেতন(Sub-conscious)বা প্রাক-চেতন (pre-conscious)
অচেতন (Unconscious)


অচেতন মনের আবার দুইটি স্তর।
অচেতনের প্রথম স্তর( Primary Unconscious)
অচেতনের দ্বিতীয় স্তর(Secondary Unconscious)
অচেতনের প্রাথমিক স্তরের আবার দুইটি ভাগ আছে।
প্রেমের অন্বেষণ (Eros) এবং মৃত্যুর অন্বেষণ (Thamotos)।


অচেতনের দ্বিতীয় স্তর(Secondary Unconscious) থেকে অবদমিত আবেগ (Repressed Emotion)- এর জন্ম হয়। মানুষের হিংসা, ক্রোধ, বিরহ, নৈরাশ্য, শোক, অপূর্ণ কামনা-বাসনা ইত্যাদি নানাবিধ আবেগ অবদমিত আকারে অবচেতন মনে অবস্থান করে এবং প্রতীক আকারে পুনরায় চেতন মনে ফিরে আসে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মন প্রচণ্ড গতিশীল এবং এই ‘মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তির, তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। যে কামনা, বাসনা আর যৌন-তাড়না একটি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য তৃপ্ত করতে পারে না, সেই অতৃপ্তি-জাত ইচ্ছেগুলোকেই অবদমিত হয়ে স্থান করে নেয় মানুষের মনের অচেতন স্তরে। এই অচেতন স্তরেই অবদমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিপরীতমুখী বিরোধ ও বাধার, যা লজ্জা, ভয়, দুঃখ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে। আকস্মিক ক্ষতি মানুষের চেতন অবস্থার এই সাম্য ব্যাহত করে ফলে শোকে পীড়িত অবস্থায় মানুষের যে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি, যার জন্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বেরিয়ে আসে।


অ্যালডরিচ আগাম দুঃখকে সংক্ষেপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে যা ক্ষতির আগে ঘটে যা ক্ষতির সময় বা তার পরে ঘটে যাওয়া দুঃখ থেকে আলাদা। নিলসান এট আল প্রত্যাশিত শোক অধ্যয়নের একটি নিয়মতান্ত্রিক পর্যালোচনা পরিচালনা করেছিলেন এবং আগাম শোক এবং শোকের মধ্যে একটি ইতিবাচক যোগসূত্র সম্পর্কে প্রস্তাবনা দেন।
শিয়ার এট আল মানুষের শোকের চারটি মূল বৈশিষ্ট্যটির রূপরেখা দিয়েছেন: ১) মৃত্যু সম্পর্কে অবিশ্বাসের অনুভূতি ২) মৃত্যুর উপর ক্রোধ এবং তিক্ততা ৩) তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য আকাঙ্ক্ষার সাথে বেদনাদায়ক আবেগগুলির পুনরাবৃত্তি বেদনা এবং ৪) মৃত ব্যক্তির চিন্তায় ব্যস্ততা যা প্রায়শই মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত উদ্বেগজনক এবং হস্তক্ষেপমূলক চিন্তার অন্তর্ভুক্ত।


শোক এমন একটি দর্শন যা মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে সম্পর্কিত। এর ফলে শরীর এবং মনের মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক দ্বৈতবাদ সৃষ্টি করে । পরীক্ষামূলক দ্বৈতবাদ অনুযায়ী কেবলমাত্র শারীরিক বিশ্বে কিছু দেখার আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটি প্রিয়জনকে হারানোর ফলে আসা শোকের মতো মানসিক প্রক্রিয়ার চেয়ে গুণগতভাবে আলাদা বলে মনে হয়। এই দর্শনও কার্যকারণ দ্বৈতবাদের প্রবক্তা যা মানসিক অবস্থা এবং শারীরিক অবস্থার একে অপরকে প্রভাবিত করার দ্বৈত ক্ষমতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়। তবে কার্তেসিয়ান দ্বৈতবাদ এবং পরীক্ষামূলক দ্বৈতবাদ বাস্তবে দুটি মৌলিক পদার্থকে ধারণ করে না , মন এবং পদার্থ। বরং পরীক্ষামূলক দ্বৈতবাদকে একটি ধারণাগত কাঠামো হিসাবে বুঝতে হবে যা মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্যে গুণগত পার্থক্যকে বিশ্বাস করে। এব্যাপারে মনের দৈহিক দার্শনিকতার মনোবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি পদার্থ এবং শক্তিকে বাস্তবতার মৌলিক পদার্থ হিসাবে চিহ্নিত করে। যা বৌদ্ধ ধর্মের ধারণাগত কাঠামো হিসাবে অভিজ্ঞ দ্বৈতবাদ গৃহীত হয় ।

বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা হল সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য- এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া, বিলুপ্তি, বিলয় বা অবসান। কিন্তু বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল সকল প্রকার দুঃখ ও শোক থেকে মুক্তি লাভ।এই সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের চারটি উপদেশ যা চতুরার্য ।

গৌতম বুদ্ধ দ্বারা প্রচারিত চারটি শ্রেষ্ঠ সত্য এবং তাঁর প্রধান জ্ঞান দর্শন। এই চারটি সত্য হল দুঃখ, দুঃখ সমুদয়, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধ মার্গ।মার্গ আবার আটটি, এই আটটি উপায়কে একত্রে বলা হয় আয্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যার দ্বারা জীবন থেকে দুঃখ দূর করা বা নির্বাণ প্রাপ্তি সম্ভব। এই আয্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপর ভিত্তি করেই বৌদ্ধ ধর্মে দশ শীল, অষ্টশীল এবং পঞ্চশীলের উৎপত্তি। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি বলা যায়, যা মধ্যপথ নামে অধিক পরিচিত।

রামায়ণে সীতাকে হারিয়ে রামের ব্যাকুলতা কিম্বা মহাভারতে পর্ব থেকে পর্বে শোকের ব্যাকুলতার কথা আমরা পাই ভীষণ ভাবেই । দ্রোণ কে হারিয়ে অশ্বথমার, অভিমুন্য এর মৃত্যুতে কাতর পিতার কিম্বা দুর্যোধন কে হারিয়ে পিতা ধৃতরাষ্ট্রের এবং গান্ধারীর শোক আমাদের ব্যাথিত করে । কাশিদাসের রামায়ণে তাঁর লেখনী মাধুর্যে আমরা অনুভব করি শোকের ব্যাপ্তি ।

অর্জুনের বাক্য শুনি উঠেন গোবিন্দ ।
নয়ন প্রসম যেন বিকচারবিন্দ ॥
ভক্তি করি কাছে গিয়া বসেন আপনি
যুধিষ্ঠির হাতে ধরি কহেন তখনি ॥
শোক ত্যজ মহারাজ শাস্ত কর মন ।
কেন নাহি শুন রাজা ব্যাসের বচন ॥
যে সব মরিল রণে জ্ঞাতি বন্ধুজন ।
শোক কৈলে পাবে হেন না হয় রাজন ॥
সেব্যমান উদ্বেগে কলহ কণ্ডু বাড়ে ।
শোকে মন দিলে রাজ। লক্ষ্মী তারে ছাড়ে ॥
আপনি নারদ পুনঃ সঞ্জয়ে কহিল ।
তবেত সঞ্জয় রাজ শোক পাসরিল ॥
হিতকথা কহিলেন ব্যাস মুনিবর। !
তাহাতে আপনি কেন না দেহ উত্তর ॥
এতেক কহেন যদি কমললোচন ।
কিছু না কহেন তবে ধৰ্ম্মের নন্দন ॥


প্রিয়জনের বিছেদে আকুলতা শুধু আমাদের দেশ নয় এর পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মানুষের শোক প্রকাশের ভঙ্গিমা এক ।শোক,দুঃখ,কান্না ও অশ্রু বিসর্জন মানুষের সহজাত স্বভাব। মানব শিশু কান্নার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে । মানব জীবনে সুখ-দুঃখ নিত্য দিনের সহচর।দুঃখ,শোক মানব জীবনকে গতিময় করে । বেঁচে থাকার শক্তি, উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়। মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করে । কোনো লোক যখন তার পরম পাওয়ার বা ভালোবাসার কোনো বস্তুকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে কিংবা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটে তখন মানুষ কেবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েনা,সে বুক-মাথা চাপাড়ায় এবং শোকগাথা গাইতে থাকে আর এই শোকগাথা কালের স্রোতে লিখিত রূপে প্রকাশ পায় ‘শোকপ্রকাশক কবিতা’ হয়ে । আত্মীয়ের মৃত্যুতে মানুষের মনে যে গভীর বেদনা ও ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা কাব্য ও কবিতা রচনার মূলভিত্তি। প্রাচীন শব্দ “এলিজি” শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘Elegia’ থেকে, যার অর্থ ‘বেদনায় আকুলতা’।


ইংরেজি সাহিত্যে মহাকবি মিল্টনের “Lycidas” (1637) থেকে শোক কবিতার শুরু।'লাইসিডাস' প্রচলিত যাজকীয় কিংবদন্তি এবং তাঁর প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে লেখা , কবিতাটি নৈর্ব্যক্তিক ও কালজয়ী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত দুঃখ সর্বজনীন তাৎপর্য সহ বিনিয়োগের জন্য এলিজিয়াক শোক বাধা পেয়েছে। লাইসিডাসের মর্মান্তিক মৃত্যুকে অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা এক উদাহরণ হিসাবে এবং ভাগ্যের মর্মান্তিক বিড়ম্বনা যা সমস্ত মানব প্রচেষ্টাকে নিষ্ক্রিয় করে তোলে। কবিতায় দ্বিধাদ্বন্দ্বকে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের মিশ্রণ তৈরি করার পিছনে চার্চের অবক্ষয় এবং আত্মার বিষয়গুলিতে সমসাময়িক অবহেলা লক্ষণীয় । 'লাইসিডাস' নিঃসন্দেহে ইংরেজি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শোক কবিতা। মিলটন 'লাইসিডাস' কবিতায় নৈসর্গিকতা তুলে এনেছেন এই ভাবে

And now the Sun had stretch'd out all the hills,
And now was dropt into the Western bay;
At last he rose, and twitch'd his Mantle blew:
To morrow to fresh Woods, and Pastures new

মানব সভ্যতার আদি থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ বিলাপের মাধ্যমে শোক প্রকাশের রীতি প্রচলিত ছিল । সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশে রচিত কারবালা ট্র্যাজেডিকে ঘিরে পূর্ব যুগে গৌরবময় স্মৃতিচারণমূলক শোকগাথা বা শোক সাহিত্যকর্মকে মার্সিয়া বলা

৬১ হিজরীতে কারবালার মরু প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এবং অন্যান্য বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রশংসাসূচক কবিতাই বিশেষভাবে মার্সিয়া নামে অভিহিত হয়। যুদ্ধের বর্ণনাকে আশ্রয় করে আরবে প্রথম মার্সিয়া সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। আরবে মার্সিয়া রচনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের বিষাদময়ভাব প্রকাশ করে পরস্পরের মনের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হতো। তামসিক যুগে মার্সিয়া সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল বটে কিন্তু ইসলামী যুগে তা পূর্বাপেক্ষা ব্যাপকতর পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং বিকাশ লাভ করে ।

সম্রাট হুমায়নের ভারত প্রত্যাবর্তনের সময় বহু ইরানী কবি-সাহিত্যিকের সংশ্রবের ফলে ফার্সি ভাষা শরীফদের ভাষায় স্থান লাভ করে।সে সময় দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাষ্ট্রগুলোতে মার্সিয়া কাব্য চর্চা পুরা দমে শুরু হলেও উত্তর ভারতের শিয়া কবি ও সাহিত্যিকগণ সাম্রাটের ভয়ে ধর্ম সম্বন্ধীয় কোনো কাব্য রচনা করতে সাহসী হননি। বরং মুঘল রাজদরবারের কবিগণ কাসীদা রচনা করে সম্রাট ও শাসকবর্গের সন্তোষ বিধান করতেন। এর কারণ মূলত অর্থনৈতিক। কেননা, মৃত ব্যক্তির গুণকীর্তন অপেক্ষা জীবিত ব্যক্তির প্রশংসা কীর্তনের প্রতি তাদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল । সম্রাট শাহজাহানের রাজদরবারের কবি হাজী মুহাম্মদ জান কুদসী স্বীয় যুবক পুত্রের অকাল মৃত্যুতে এক মার্সিয়া রচনা করেছিলেন । দাক্ষিণাত্যের শাসক দ্বিতীয় আদিল শাহ এই শাসনকালে (১৫৮০-১৬২৬.খ্রি.) তার দরবারের কবি মোল্লাহ যুহুরী আদিল শাহের নির্দেশে মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলার কবিগণের অধিকাংশ নবাব আলীবর্দী খান ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে আগমন করে কাব্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন । এ সকল কবি প্রধানত ফার্সিও উর্দু ভাষায় মার্সিয়া রচনা করতেন। বিখ্যাত ফার্সি কাব্য ‘মকতুল হুসেন’ কাব্যের অনুভাবেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিগণ বাংলা ভাষায় মার্সিয়া কাব্য রচনায় যত্নবান হন। তাদের মধ্যে মুহম্মদ খান,হায়াৎ মামুদ, ফকীর গরীবুল্লাহ,রাধাচরণ গোপ,হামিদ অন্যতম ।

সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে দু’টি ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ধারা সপ্তদশ-অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘হরি বংশ’ প্রভৃতির অনুসরণে ‘নবী বংশ’ এবং ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’, ‘পাণ্ডব বিজয়’ প্রভৃতির অনুসরণে ‘রসূল বিজয়’, ‘মুহাম্মদ বিজয়’,কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতি পয়গম্বরদের কাহিনী মূলক কাব্যাদি রচনা । দ্বিতীয় ধারা হযরত রাসূলুল্লাহর পরবর্তী খলিফাগণের বিজয় অভিযানের বীরত্ব ব্যঞ্জক কথা ও ইমাম হোসাইনের কারবালার যুদ্ধের করুণ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য রচনা ।

এই দ্বিতীয় ধারার কাব্যগুলোর সাধারণ নাম ‘জঙ্গনামা’। ‘জঙ্গনামা’র বিষয় অত্যন্ত করুণ ও মর্মস্পর্শী। বাঙালি মুসলমানদের নিকট এ কাব্যের কদর হয়েছিল অত্যন্ত বেশি । প্রকৃতপক্ষে এ জঙ্গনামা বা বাংলা মার্সিয়ার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা তাদের প্রাণের কথা প্রতিধ্বনিত হতে শুনলেন ।

অতি প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যাথায় আমরা এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকি বলেই নিজেদের জীবনের সীমানায় মৃত্যুর সৌন্দর্যটুকৄ অনুভব করতে পারি না! মৃত্যুর অন্ধকারই যে জীবনকে নিরন্তর আলোকিত করে রাখে, অনুধাবন করতে পারি না সেই সত্যও! টের পাই না, মৃত্যু এসেই প্রিয়জনকে আরও নিবিড়ভাবে অনুভবের- মূল্যবান পরিসরটুকু প্রস্তুত করে দিয়ে যায়! কিন্তু সময়ের সাথে শোকের তীব্র দাহ প্রশমিত হয়ে এলে, পিছন ফিরে যতই স্মৃতিচারণ করি, ততই কিন্তু মৃত্যুর সেই অনিবার্য যন্ত্রণার মুহূর্ত্ত ছাপিয়ে জীবনের স্মৃতিবিজরিত অম্লান মুহূর্ত্তগুলির সুখস্মৃতিতেই সবাই মগ্ন হই, সুখানুভূতির স্পর্শে! এখানেই তো মৃত্যুর সৌন্দর্য! মৃত্যু তাই কেবলই জীবনের রঙ ফোটায়!

মৃত্যুর মধ্যে যে শোক, সেই শোকের শত যন্ত্রণা ছাপিয়েও এই যে ঐকান্তিক প্রেম; এই প্রেমের শক্তিই আমাদের সংলগ্ন রাখে জীবনের প্রবাহমানতার সাথে! কবি তাই মৃত্যুর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে স্বীকার করেননি! মৃত্যুও প্রবাহমান জীবনের প্রধানতম অনুষঙ্গ! এই বোধ জাগ্রত থাকলে, শোক আমাদের পরাজিত করতে পারে না, বরং উত্তীর্ণ করে জীবনের পূর্ণতায়!

তাই তো মন গেয়ে ওঠে -

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,
বিরহদহন লাগে!
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে!!



References:

1. উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ
2. The 5 Stages of Grief & Loss By Julie Axelrod
Freud, S. (1957) Mourning and melancholia. In J. Strachey (Ed. & Trans.), The standard edition of the complete psychological works of Sigmund Freud (Vol. 14, pp. 273-300). London: Hogarth. (originally published 1917).
3. Kübler-Ross, E. (1969). On Death and Dying. New York: Macmillan.
4. Kenneth J. Doka, PhD
5. Professor, The College of New Rochelle
6. Senior Consultant, The Hospice Foundation of America
7. Author, Grief is a Journey: Finding Your Path through Loss



২টি মন্তব্য:

  1. অত্যন্ত সাবলীল ও সহজ ভাবে জীবনের এক গূঢ় তত্ত্বের ব্যাক্ষা করেছেন। আপনার লেখনশৈলীতে মুগ্ধ হলাম এবং লেখাটিতে যে প্রসঙ্গ গুলি টেনে আনা হয়েছে তাতে লেখনীতে তথ্যের সমাহারে সেটি অন্য মাত্রা লাভ করেছে যা পাঠক- পাঠিকাদের সমৃদ্ধ করবে বলে আশা রাখি।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক ভালোবাসা রইল। সাথে থেকো ।

    উত্তরমুছুন