খয়েরী রঙের পাতা
===========================
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
===========================
সকাল থেকেই হাসপাতালে ভিড়।বুধা হাসপাতালের ভিতরে না গেলেও চা খেতে আসা কয়েকজনের মুখে শুনেছে এক বুড়োকে তার ছেলে হাসপাতালের ভিতর একটা গাছের তলায় ফেলে চলে গেছে।বুড়ো শুনেই বুধার কেমন একটা সন্দেহ হয়।কালকের বুড়োটা নয় তো!
ছোট থেকে এই দোকানে আছে তখন বাবার সাথে এসে কাপ ডিশ ধুয়ে দিত।সেই থেকেই সবাই চেনে জানে। কতবার ভেঙে দেবার কথা উঠলেও আবার সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে।
কোনদিনও একঘন্টার জন্যে দোকান পুরোপুরি বন্ধ করেনি, একদিকের ঝাঁপটা একটু নামালেও অনেকেই জানে গভীর রাতেও বুধার দোকানে চা পাওয়া যাবে।তবে এবারেই অনকেদিন ধরে সকালেও ঝাঁপটা নামিয়ে রাখতে হয়েছিল।এই দিন কয়েক হল পুরো খুলছে। না হলে তো ঝাঁপের বাইরেটাতে ফল নিয়ে বসেছিল আর তার বউ বেবি পাড়াতে সব্জি নিয়ে বসত।অবশ্য যারা জানত তারা এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু আস্তে বলে উঠত,‘একটু চা হবে নাকি?’
কোনদিনও একঘন্টার জন্যে দোকান পুরোপুরি বন্ধ করেনি, একদিকের ঝাঁপটা একটু নামালেও অনেকেই জানে গভীর রাতেও বুধার দোকানে চা পাওয়া যাবে।তবে এবারেই অনকেদিন ধরে সকালেও ঝাঁপটা নামিয়ে রাখতে হয়েছিল।এই দিন কয়েক হল পুরো খুলছে। না হলে তো ঝাঁপের বাইরেটাতে ফল নিয়ে বসেছিল আর তার বউ বেবি পাড়াতে সব্জি নিয়ে বসত।অবশ্য যারা জানত তারা এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু আস্তে বলে উঠত,‘একটু চা হবে নাকি?’
বুধাও চারদিকটা দেখে নিয়ে উত্তর দিত, ‘মিনিট দশ ঘুরে আসুন তার মধ্যে করে দেবো।’
মাঝে মাঝে নিজের মনে হাসত।কি রকম অদ্ভুত ব্যাপার, সাধারণ লোক ভয় পায় পুলিশকে আর তারাই এসে মাঝে মাঝে বলে,‘এই বুধা কয়েককাপ স্পেশাল চা বানা তো।’
কাস্টোমারদের মুখে বুধা অনেক খবর পায়।তার নিজের গ্রাম থেকে অনেকে হাসপাতালে দেখাতে এলে তাদের যতটা সম্ভব সাহায্য করবার চেষ্টা করে।বাড়ি ফেরার সময় তাদের সবাইকে কম পয়সায় বা বিনা পয়সায় স্পেশাল চা তৈরী করে খাওয়ায়। বাবা অনেকদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে হাসপাতালের কাছে উঠে এলেও গ্রামকে এখনো ভালোবাসে, বুধাও সেকথা মেনে চলে। দোকানটাও ছোট তাও এখন আবার এখানেই শুতে হচ্ছে।রাতে বেবিও থাকে।কয়েকদিন আগেও এখান থেকেই ভোর ভোর স্টেশনে সব্জির বাজারে চলে যেত।একটু সুবিধাও হত।
অনেকের আবার মিলিত হবার জায়গা এই বুধার চায়ের দোকান।অবশ্য শুধু চায়ের দোকান বললে ভুল হবে, সেই সঙ্গে রুটি ঘুগনি এমনকি টুকটাক ফলের পাশে মগ, দাঁতমাজার ব্রাশ, থেকে আরম্ভ করে জলের বোতলও আছে। হাসপাতালে কোন রুগী ভর্তি হলে বা তার সঙ্গে কেউ থাকতে এলে যা যা লাগতে পারে মোটা মুটি সব কিছুই পাওয়া যায়, এখন আবার মুখে বা মাথায় বাঁধার বিভিন্ন রকমের কাপড় মাক্স আর স্যানিটাইজারও বিক্রি করছে। দোকান বন্ধের সময়েই পুলিশেরই একজন বুদ্ধিটা দিয়ে গেছিল।
আগে এই চায়ের দোকানেই ভালো ভাবে সংসার চলে যেত।এখন সকালটাতে বেবিকে সব্জি নিয়ে বসতে হচ্ছে। সংসার তো চালাতে হবে, বাবা মা বুড়ো হয়েছে, তাদের খাওয়া দাওয়া, ওষুধ, নিজেরও ছেলে মেয়ে আছে এই সমস্ত কিছু আসবে কোথা থেকে। তবে দোকান ভালো ভাবে খোলা থাকলে সেরকম কোন অসুবিধা হয় না। এমনিতেও কয়েকটা দিন একটু সব্জি বিক্রি করতে হল এই যা। সে অবশ্য অনেকেই করছে।একটা বড় হোটেল আছে, এই সময় সে বেচারাও একটা ভ্যান জোগাড় করে ফল নিয়ে শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামনের জেরক্সের দোকানটাও মুদিখানার জিনিস রাখছে। বুধা কয়েকদিন আগে কি একটা জেরক্স করতে গিয়ে তো অবাক। জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বলে,‘আরে এখন এটাই জীবন, সরকার বলছে শুধু মাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস খুলবে।
গতকালও তখন দোকান বন্ধ করে নি।কাপ ডিশগুলো ধুয়ে টিফিন কৌটা থেকে দুটো রুটি খেতে যাবে এমন সময় একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে দোকানের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,‘এটো তুমার দোকান বটে নাকি?’
এমন প্রশ্নে বুধা একটু থতমত খেয়ে গেলে সামলে উত্তর দেয়, ‘হঁ গো,কেনে?’
–দুকান কি লাগায় দিছ ?
-হাসপাতালের কুনু দোকান কখনও বন্ধ থাকে না, ঝাঁপ নামানো থাকে।
ছেলেটা একটু থমকে যায়। আস্তে আস্তে সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করে,‘তুমিও কি এখন ঝাঁপ নামাবে?’
একটু অবাক হয় বুধা দোকান আর রাস্তার আলোতে ভালো করে ছেলেটাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন বল তো?’
‘এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, বড় বড় চুল, একটা পায়জাম আর গেঞ্জি পরে আছে।’
বুধা তারদিকে আরেকবার দেখে বলে,‘কি কর তুমি?’
–ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে উত্তর দেয়,‘সেরকম কিছু না, ঐ টুকটাক কাজ?’
-বাইরে কাজ করতে নাকি?
–বাইরে! না গো বাইরে কেন করবো গা? ই’খানেই থাকি।
বুধা জানে এখন বাইরের রাজ্য থেকে কেউ এলেই সমস্যা। তার নিজের গ্রামেই এরকম অনেক ছেলে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি এসে ঢুকে গেছে। কয়েকজনের আবার শরীরও খারাপ ছিল। রোগটা তো বাইরে থেকেই এসেছে।
ছেলেটা থতমত খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকায়।কি যেন বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।তারপর বলে,‘একট কথা বলছিলম, বাপটকে তুমার এই দুকানটতে কিছুক্ষণ রাইখবোগা? আমি হাসপাতালে ঘুরবো তো।’
-কি হইছে তুমার বাপের?
-সেরকম কিছু লয়, একটু জ্বর, আর কাশছে গা।
বুধা কিছু বলবার আগেই বেবি বলে ওঠে,‘কেনে ইখানে রাখবে ? ঐ দ্যাখো হাসপাতালে ভিতরে একট বসবার জায়গা আছে, উখানে বসায়ে যা খুশি করগে।’
-বলছিলম যে উখানে যে ক্যামেরা রইছে, সব তো দেখা যাবেক।
–দেখা যাবেক? যাক গো, কি হবেক তাতে ?
বেবির কথাগুলো শুনেই ছেলেটা কেমন যেন ভয় পেয়ে কিছু সময় সাইকেল নিয়ে দোকানের সামনেই এদিক ওদিক করে অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।বুধা ও বেবি খুব অবাক হয়ে গেলেও কউকে কিছু বলে না।অবশ্য বলবেই বা কাকে? বুধা রাতে শুতে যাবার ব্যবস্থা করবার আগে দেখে সেই ছেলেটা সাইকেল চেপে আস্তে আস্তে হাসপাতালে ঢুকছে, আর কিছু ক্ষণ পর একটা বুড়ো লোকও সাইকেলটার পিছন পিছন ঢুকল।বুড়োটা খুব কাশছে, দোকানের ভিতর থেকে বুধা বেবি দুজনায় কাশির আওয়াজ পায়। দুজনার গায়েই চাদর ঢাকা দেওয়া আছে। সকালে সব কিছু শুনে বুধার গতরাতের কথাগুলো মনে পড়ে।বেবি এবার প্রতিদিনের মত বাড়ি যাবার পরিকল্পনা করছে। সকালে ঘুগনি বানানোর পাশে বুধাকেও একটু সাহায্য করে. খুব চাপ থাকে তো।এরপর একটু বেলা হলে ঘরে যায়। কিছু রান্না করে স্নান করে আবার আসে। সেসময়টাতে বড় ছেলেটা থাকে।বুড়োটার কথা শুনে বেবির মনটা খারাপ হয়ে যায়। বারবার করে বলতে আরম্ভ করে,‘আহা রে কেমন ছেলে কে’জানে নিজের বাপকে কেউ এমন ভাবে ফেলে চলে যায়?’ বুধা তার নিজের মত কাজ করে চলে আর দোকানে চা খেতে আসা সবার সাথে টুকটাক কথা বলে। অবশ্য বেশির ভাগ সেই বুড়ো মানুষ আর সেই ছেলেটার কথা। শোনা যায় বুড়োর গায়ে জ্বর, কাশছে, কিন্তু ডাক্তাররা কেউ দেখে নি।বলছে,‘এখানে এই রোগের চিকিৎসা হয় না।একটা রোগীর জন্য পুরো হাসপাতালের সবাই অসুস্থ হয়ে যাবে।’
সবার কথার মাঝে বেবি হঠাৎ একটা নতুন মাক্স টেনে নেয়। তারপর স্যানিটাইজারের বোতলটাও সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়। কিছুসময় পরে তাড়াতাড়ি ফিরে দোকানের পিছন দিকে নিজেদের থাকবার জায়গাটা সরিয়ে একটা আলাদা জায়গা করে বুধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,‘এখানে একটা পেলাস্টিক টাঙালে এই দিকটতে আমরা আর উইদিকে.....’
-কি ? উই দিকটতে কি হবেক?
-থাকবেক গো, বুড়াট থাকবেক। কয়েকদিন রইবেক, মানুষ বটে, ছেড়ি চলে আসবো?
-কিন্তু যদি ঐ রোগট ?
-বেবি মুচকি হেসে বলে, ‘তাই তো পেলাস্টিকট টাঙাই দিলম।এবার চল বুড়োটকে ধরে একটুকুন আনি গা।
ছোট্ট গ্যাসে তখন স্পেশাল চা ফুটছিল। বুধা বুঝতে পারে না, আগে গ্যাসটা কমাবে নাকি....? কিন্তু এই বেবিট বদলে গেল কিভাবে ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন