জীবনের রামধনু
=================
অগ্নিশ্বর সরকার
=================
এই নিয়ে পরপর তিনবার ফোনটা চিৎকার করে কিছুক্ষণের বিরতি নিল। ফোনটা তোলার আকাঙ্খা বা আগ্রহ কোনওটাই নেই সিমির। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিতে জন্মিয়ে সামাজিক প্রতিবাদের ভাষাটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে সিমি। একবারও কি পারতো না? বিকেলের পড়ন্ত রোদকে সাক্ষী রেখে চোখের কোল বেয়ে একটা গরম জলের ধারা নেমে এলো।
*
দীপ্তি তার পিসতুতো বোন নন্দিনীর বিয়ে ঠিক করে ফেলল এক দূরসম্পর্কের দেওর অনির্বাণের সাথে। ছেলে হিসাবে অনির্বাণের কোনও তুলনা হয়না। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু নন্দিনীর ইচ্ছে ছিলো না। নন্দিনীর ইচ্ছে কয়েকটা বছর চাকরি করে তারপর বিয়ে করার। ছোটবেলাতেই বাবা-মা বিয়োগ হয়েছে। নিজের মতো করে বাঁচার ইচ্ছেটা কোনও দিনও পূরণ হয়নি। বিয়ের পর যদি শ্বশুরবাড়ির লোক তার এই চাকরির ইচ্ছেটাকে স্বীকৃতি না দেয়? তাহলে এতো কষ্ট করে, আত্মত্যাগ করে লেখাপড়া শেখার কী মানে তবে? দিদি ছোটবেলা থেকেই তাকে মায়া, মমতা দিয়ে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছে। তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারন কীভাবে করবে? আর কয়েকঘন্টা বাকি ইচ্ছে আর ঋণশোধের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নেওয়ার জন্য। এখন কি নন্দিনী বাড়ি ছেড়ে পালাবে না আবারও নিজেকে বিলিয়ে দেবে, মেরে ফেলবে সব ইচ্ছে-স্বপনগুলোকে? দীপ্তিদিদিকে না পারলেও সিমি দিদিকে সব বলেছে। সিমি দিদি সেদিনও চুপ ছিল, আজকের পরপর তিনবার ফোন করার পরও তাই।
**
প্রতিবাদ আর একগুঁয়েমির একটা নাটক মঞ্চস্থ হল দীপ্তিদের বাড়িতে। এক বাড়ি আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়েটা ভেঙে গেছে নন্দিনীর। সৌজন্যে সিমি। সাথে ভেঙে গেছে সিমি আর দীপ্তির ছোটবেলার বন্ধুত্ব। আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছিল নন্দিনীর, হতে চলা শ্বশুরবাড়ির কেউ মেনে নেয়নি ভবিষ্যতে বাড়ির একমাত্র বউমার চাকরি করার ইচ্ছেটাকে। ওদিকে দীপ্তিরও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। চিৎকার করে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছে। ঠিক সময়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়েছে অস্থির সিমি একটা প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে। ছাদনাতলাতে সকলেই উপস্থিত। বরাসনে উপবিষ্ট নন্দিনীর হবু বর। সিমি ধীর পদে বরের সামনে দাঁড়িয়ে খুলে বলেছিল নন্দিনীর মনের চেপে রাখা ইচ্ছেটাকে। প্রস্তাবটা হবু শ্বশুরমশাই পত্রপাঠ মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ফলাফল কথা কাটাকাটি, তর্ক এবং সবশেষে কান্নার রোল দিয়ে।
***
আজ নন্দিনীর এক মেয়ের মা, সাথে একজন রেলের উচ্চপদস্থ কর্মী। সিমির নিজের ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে নন্দিনীর। সেই বিয়ে ভাঙ্গার দিনেই কিন্তু পরের লগ্নে। বিয়ের লাল বেনারসি পরেই সিমির হাতকে অবলম্বন করে বেরিয়ে না এলে আজ স্বপ্নগুলো নিশ্চিত ভাতের হাঁড়ির তলার কালির সাথে আটকে যেত। সেদিন সিমির বাড়ি ফেরার পর পরিবারের সাথে সিমির ভাইও শুনেছিল সব। একজন আই.এ.এস ছেলের ব্যাক্তিস্বত্বা সেদিন বাধ্য করেছিল একটু আগে ঘটতে চলা অন্যায়ের শেষ করতে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো নন্দিনীর দিকে গোটা পরিবারকে পাশে নিয়ে। আজ নন্দিনী সুখী। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া পরিবারকে পাশে পেয়েছে, সাথে পেয়েছে প্রায় হারাতে বসা সেই সাতরঙা রঙিন স্বপ্নগুলোকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন