অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বুধবার, ১২ মে, ২০২১

এ ডিস্টোপিয়্যান ড্রিম

 

         

এ ডিস্টোপিয়্যান ড্রিম
=====================
তনিমা সাহা
=====================



মধুর আজ আবারও ওই একই স্বপ্ন দেখলো। গত বেশ কয়েকদিনের মতোই আজও সূর্য্য ওঠার আগে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এসে মধুর এই পুকুরের পাড়ে বসে আছে। সূর্য্য ওঠার পর আরো কিছুক্ষণ বসে তবে ঘরে যাবে। আতঙ্কে এখনো কাঁপছে মধুর। কেন যে এই ধরনের স্বপ্ন দেখছে সে।






এই পুকুর পাড়ে এসে বেশ ভালো লাগে মধুরের। পুকুরটা একদম একটা নির্জন জায়গায়। পুকুরের পাড় থেকে প্রায় দু'হাত ছেড়ে ছোটো-বড়ো অনেক গাছ। গাছগুলো এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হবে কেউ যেন শাড়ির আঁচল দিয়ে পুকুরের পাড়টাকে আড়াল করে রেখেছে যাতে স্নান করার সময় কাউকেই বাইরে থেকে দেখা না যায়। পুকুরটা বেশ বড়ো আর তার জলের রঙ গাঢ় সবুজ। যদিও জলে কোনো শ্যাওলা নেই। পুকুরে যে মাছ, কাঁকড়া, গুগলি আছে সেগুলোকেও স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। অবশ্য মধুরের মা সর্বরি বলতেন যে মধুরের নাকি দিব্যদৃষ্টি আছে। তাই সে জলের ওপর থেকেও জলের ভেতরের সবকিছুকেই দেখতে পায়। মা সঙ্গে করে মধুরকে নিয়ে আসতেন রোজ। মা পাড়ে বসে কাজ করতেন আর মধুর পাড়ে বসেই বুনো ফুল পাতা কাঁকর নিয়ে খেলা করতো। মধুরের এই জায়গায় কোনো বন্ধু নেই। মা-ই ছিলেন মধুরের বন্ধু। মা চলে যাবার পর মধুর বড্ড চুপ হয়ে গিয়েছিল। খিদে পেত না, ঘুম পেত না। ভাবতো মা হয়তো কোথাও গেছে। চলে আসবে একটু পরেই। তারপর চুলে বিলি কেটে বলবে, "চ' আয়। মায়ে-ছেলে মিলে দুটো খে' নি"। বা হয়তো বলবে, "এম্মা! এখনো চান করিস নি। দেখ গা দিয়ে পচা গন্ধ আসছে"। হয়তো বা ঝুপ্ করে সামনে বলবে, "কিরে বাবু, ভয় পেয়েছিলি বুঝি। ভাবলি মা বোধহয় কোথাও চলে গেছে", বলে নিজেই হেসে উঠবে। তারপর কোলে করে নিয়ে চান করিয়ে খাইয়ে দেবে। চৌদ্দ বছর বয়েস পর্যন্ত মধুরকে মা-ই সব করিয়ে দিত।


মধুর বাকি ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা। বাকিদের থেকে অনেক দেরিতে মধুরের কথা ফুটেছে। প্রায় দশ বছর পর্যন্ত মধুরকে দেখতে একটা শিশু ব্যতিরেক আর কিছুই ছিলনা। তার আকার আকৃতি দেখে মনে হতো সে দশ/এগারো মাসের ছোটো বাচ্চা। গাঁয়ের লোকেরা মধুরকে কখনো চোখে দেখেনি। একটা শুধু উড়ো কথা শুনেছিল যে ঝোপের আড়ালে বাচ্চা পাওয়া গেছে। সবাই দেখতে চাইলেও সর্বরি "ও, ভুঁয়ো কথা", বলে পাশ কাটিয়ে দিত। স্বামীকে হারিয়ে বড়ো কষ্টের জীবন কাটাচ্ছিল সর্বরি। তার ওপর শাশুড়ির অত্যাচার যেন দিনের পর দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। গলায় কলসি ঝুলিয়ে বাড়ির পুকুরে মরতে গিয়েছিল সে। কিন্তু মৃত্যুদেব বোধহয় সেদিন তাঁর কপালে অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে কলসিতে গিঁট দিচ্ছিল সর্বরি। হঠাৎ পুকুর পাড়ের ঝোপ-জঙ্গলার ভেতর থেকে বেড়াল বা ওই জাতীয় কিছুর কান্নার শব্দ তার কানে আসে। শব্দটার মধ্যে এমন একটা আকুতি ছিল যে সর্বরি কিছুতেই ঝোপের ধারে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারলো না। ঝোপের কাছে গিয়ে দেখে একটা কচ্ছপ বা বনরুইয়ের মতো খোলার ভেতরে ছোট্ট একটা শিশু। খোলার ভেতরে শিশুটাকে এমনভাবে রাখা রয়েছে যেন এই খোলাতে করেই আনা হয়েছে শিশুটিকে। একটা ছোটো কুকুরছানার মতো শিশুটির আয়তন….এতো ছোটো মানুষের বাচ্চা আগে কখনও সর্বরি দেখে নি। শিশুটি ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর কান্না করছিল। এতো ছোটো শিশুটি যে কান্নার শব্দও ঠিকভাবে বেরোচ্ছে না। সর্বরি তাড়াতাড়ি শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে ভালো করে পড়নের কাপড়টায় জড়িয়ে নিল। কোলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির কান্না থেমে গেল। শিশুটি জল ভরা চোখে টুকুম টুকুম করে সর্বরির দিকে তাকিয়ে রইলো। শিশুটির বেগুনি রঙয়ের চোখের মণি, লাল টুকটুকে ঠোঁট, ঠিক ফর্সা নয় তবে উজ্জ্বল গায়ের রঙ। সর্বরি আপনমনে বলে উঠলো, "ওমা, এ যে দেবশিশু"। শিশুটি কি বুঝলো কে জানে 'পিচিক' করে হেসে সর্বরির কোলে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পরলো। সর্বরি যখন শিশুটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো তখন শাশুড়ি বিশাল ঝামেলা করেছিল। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সর্বরি শিশুটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। নিজের পুরোনো শাড়ি কেটে শিশুটির জন্য জামা বানালো। শিশুটি আসার কয়েকদিন পর থেকে সর্বরির শাশুরী কেমন যেন মিইয়ে যেতে শুরু করলেন। চেঁচামেচি করতেন না, ঝগড়া করতেন না, উপরন্তু সর্বরিকে রেঁধে খাওয়াতেন। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকতেন তখন সর্বরির শাশুরি। সর্বরির কিন্তু বেশ মজা লাগতো তার দজ্জাল শাশুড়ির এই নেতিয়ে পরা রূপ। শর্বরির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সবকিছু ওই 'দেবশিশু' তার জীবনে আসার জন্যই হয়েছে। সর্বরি আদর করে তার 'দেবশিশু'র নাম রাখলো মধুর। দেড় বছরের মধ্যেই সর্বরির শাশুড়ি মারা গেলেন। সর্বরির দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল যে মধুর তার সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই সে সতর্কভাবে মধুরকে সকল গ্রামবাসীর থেকে লুকিয়ে রাখতো। সময় অতিক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীও মধুরের কথা বিস্মৃত হয়ে গেল।


দেখতে দেখতেই তেরোটা বছর পেরিয়ে গেল। যেহেতু মধুর আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতো ছিল না তাই সর্বরি প্রত্যেক অতিক্রান্ত বছরকে মধুরের বয়েস হিসেবে ধরতো। সর্বরির স্বামী পেশায় নাপিত ছিল। স্বামী গত হলে সর্বরিই পেট চালানোর জন্য স্বামীর পেশাটাকে ধরে নিয়েছিল। অভাব থাকলেও সর্বরি মধুরকে পাওয়ার আনন্দে অভাবকে ভুলে থাকতো। হঠাৎই সর্বরি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। সর্বরি মারা যাবার আগের থেকে মধুর রাতে একটা স্বপ্ন দেখতো যে কেউ এক বিশাল দেহী দানব তার মাকে পাঁজকোলা করে নিয়ে পুকুরের জলে ডুবে যাচ্ছে। সর্বরি একজন সারহীনের মতো ওই দানবটার কোলে শুয়ে আছে। মধুর ডাকছে কতো কিন্তু সর্বরি উত্তর দিচ্ছে না। দানবটার হাতে-পায়ে বড়ো বড়ো নখ। গায়ে চামড়াটা কেমন যেন শ্যাওলা শ্যাওলা মতন। মনে হয় একটা শক্ত খোলস পরে আছে। ওই কাঁকড়া বা গুগলি যেমন খোলসের ভেতর থাকে তেমনি ধরনের খোলসে দানবটার পুরো শরীর ঢাকা। সর্বরিকে নিয়ে সে পুকুরের জলে ডুবে যেতে যেতে একবার পেছনে ফিরে মধুরের দিকে তাকায়। উফ্! কি হীমশীতল তার দৃষ্টি। চোখের মণির রঙ বেগুনি। ঠিক মধুরের মতো। দানবটার ওই তাকানোতেই ভয়ে মধুর কেঁপে ওঠে। ঘামে ভিজে ওঠে তার শরীর। ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। কে ওই দানবটা...কেন-ই বা সে মধুরছর স্বপ্নে আসে? যেদিন সর্বরি মারা গেল সেদিন এসেছিল ওই দানবটা। শুধু তাই নয় যেদিন যেদিন গ্রামের কেউ মারা যেত সেদিনও স্বপ্নে সে ওই দানবটাকে দেখতো। দানবটা মৃত সর্বরিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে পুকুরের জলে ডুবে গেল। মধুর ছোটোছোটো পায়ে দৌড়িয়েছিল পেছন পেছন, আধো আধো স্বরে "মা,মা" ডাকতে ডাকতে।


মধুরের বয়েস তেরো বছর হওয়া সত্ত্বেও তাকে দেখতে চারবছরের শিশু থেকে বেশী মনে হয় না। সর্বরি মারা যাবার পর মধুর বড়ো একা হয়ে যায়। মধুরের কখনও খিদে পেত না। আশ্চর্য্যজনক ভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার পেট ভরে যেত। গ্রামের কেউ তার খেয়াল না রাখলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার খেয়াল রাখতো, যত্ন করতো। মধুরের কেন জানি মনে হতো যে ওই অদৃশ্য শক্তিটা আসলে ধুরের মা সর্বরিই। সর্বরি মৃত্যুর পরেও মধুরকে আগলে রাখতো। এরমধ্যে কিছু গ্রামের লোক মারা গেলেও মধুর কিন্ত স্বপ্নে ওই দানবটাকে দেখেনি। হঠাৎই মধুরের শরীরে বৃদ্ধি শুরু হয়। একবছরের মধ্যেই মধুর বেশ বড়ো হয়ে যায়।


কয়েকদিন যাবৎ মধুর স্বপ্নে আবার ওই বেগুনি রঙয়ের চোখের দানবটাকে দেখছে। কি নির্দয় দৃষ্টি দানবটার। তাকালেই মনে হয় প্রাণটা এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে। কেমন শ্বাপদের মতো জুলুজুলু চোখে তাকায় সে। ভয় পেয়ে ওঠে মধুর। ঘামে ভিজে ওঠে তার শরীর। ঠিক তখনই পুকুরটাকে স্বপ্নে দেখে সে। যেন পুকুরটা তাকে ডাকছে। বিছানা থেকে উঠেই দৌড়ে তাই চলে যায় পুকুরপাড়ে। গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। মধুরের মনে হয় সর্বরি তার সাথে কথা বলছে।


আজ আবার দেখেছে মধুর স্বপ্নটা। তাই সেই থেকে পুকুরপাড়ে বসে আছে মধুর। বসে বসে চোখের জল ফেলছিল সে। আজ তার মাকে খুব মনে পরছে। হঠাৎ মধুর দেখে পুকুরের ঠিক মাঝখানে একটা গোল করে গর্ত বা ছোটো ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিটা ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। আস্তে আস্তে গোটা পুকুরের মাঝে একটা বড়ো ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছে। সেই ঘূর্ণাবর্তের মাঝে থেকে সর্বরি ওঠে এলো। মধুর তাড়াতাড়ি চোখ মুছলো। সে কি ঠিক দেখছে! চোখটা ভালো করে কচলে দেখলো...হ্যাঁ ঠিকই দেখছে সে। সামনেই সর্বরি.. মধুরের মা দাঁড়িয়ে আছে। মধুর লক্ষ্য করলো সর্বরিরও চোখের মণির রঙ বেগুনি হয়ে গেছে। দুহাত বাড়িয়ে সর্বরি ডাকে তার প্রাণের ধন মধুরকে। মধুর ছুটে গিয়ে সর্বরির বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। কেঁদে কেঁদে সে বলে, "মা কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? কতো খুঁজেছি তোমায়….জানো আমি কতো ভয় পেতাম। ওই.. ওই ভয়ঙ্কর দেখতে দানবটা বারবার আমার স্বপ্নে আসে"। মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে সর্বরি বললো, "জানি বাবা। সেসবই আমি জানি। তাই তো তোকে নিতে এলাম। তোর যে বড়ো প্রয়োজন ওই জগতে…"। সেই প্রথমদিনের মতোই জলে ভরা বড়ো বড়ো চোখে সর্বরীর দিকে তাকিয়ে মধুর বললো, "জগৎ...কোন্ জগৎ মা"? সর্বরি হেসে বললো, "আমি বলতাম না যে তুই আমার 'দেবশিশু'। তুই সত্যিসত্যিই 'দেবশিশু'। তুই তোর জগতের 'দেবশিশু'। যাকে স্বপ্নে দেখছিস সে তোর সৎভাই। তুই এই পৃথিবীর জীব নোস রে...তোর পৃথিবীটাই আলাদা। তোর জগতের লোকেরা তোর আশাতেই আছে। ওই দানবটা তোর ক্ষতি করতে চাইতো। কিন্তু আমি তোর কোনো ক্ষতি হতে দেইনি। তাই তো আমায় মরতে হয়েছিল। আমাকে মেরে দানবটা ভেবেছিল যে সে তোর ক্ষতি করতে পারবে। কিন্তু পারেনি। তাই সে তোকে ভয় দেখাতে শুরু করে। চল বাবা তোর জগতের জীবেরা যে তোর জন্য অপেক্ষা করছে"। সর্বরি মধুরের হাত ধরে হারিয়ে যায় আবার সেই জলের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে। মধুর দেখে সর্বরির গোটা শরীর ঢেকে আছে একটা শক্ত, স্যাঁতস্যাঁতে চক্রাকার খোলসে। আর ওর নিজের শরীরে ঘিরেও সৃষ্টি হচ্ছে একটা চক্রাকার স্যাঁতস্যাঁতে কাঁকড়ার মতো খোলশ। সর্বরি আর মধুর পুকুরের আবর্তে তলিয়ে যেতেই পুকুরের জল আবার আগের মতোই শান্ত হয়ে যায়।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন