অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বুধবার, ১২ মে, ২০২১

ভাঙন

 

 

ভাঙন
=================
অর্পিতা মান্না
=================



বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামে, আম্ফানের দাপটে ধ্বংস হয়েছে একুশটি পরিবারের মাথার ছাদ সহ পায়ের তোলার মাটি। আজ যেখানে শুধুই নদী কুল কুল করে বইছে, তার বক্ষতলে এককালে লেখাছিল আমের বাগান,শ্যামল ক্ষেত, আর গ্রাম্য বাড়ি ঘরের কাটাকুটি।


সুরেশ সেই একুশটি পরিবারের মধ্যেই একজন, যার দুর্যোগ বিধ্বস্ত জীবন এখন আটকে পড়েছে জলস্রোতের মাঝে। সরকারি অনুদান সুযোগ সুবিধা, সেইসব পাওয়ার আশায় কেটে গেছে এক বছর। দৈনন্দিন জীবন থেমে নেই তবুও। শুধু আটকে গেছে জীবনের বিচরণ। তার দুই ভাইপোর স্কুল হারিয়েছে। সুরেশের বৌ অন্তঃসত্ত্বা ছিলো,নিষ্পাপ প্রাণ পৃথিবীর আলো দেখার আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে মাতৃগর্ভে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ সুরেশের পরিবারকে নিঃস্ব রিক্ত করেছে।তবু সুরেশের পরিবারের সকল সদস্যের বেঁচে থাকার গল্পগুলো লিখে চলেছে সুরেশ একাই। আশাহত বৌকে এখনও সে স্বপ্ন দেখায় আগামী সন্তানের, দুই ভাইপোকে সে স্বপ্ন দেখায় তাদের স্কুল নতুন করে সৃষ্ঠি হবে। বৃদ্ধ বাবা মাকে বাঁচিয়ে রেখেছে নতুন গ্রাম গড়ে উঠবে এই স্বপ্ন দেখিয়ে।শুধু দাদাকে সে সামলাতে পারেনা। আবেগী মানুষটি আম্ফানের পর হারিয়েছে তার স্ত্রীকে। বনানী দুই হাতে আগলে রেখেছিলো সংসার। সুরেশের দাদা সুবোধ ভালোবেসেই পাশের গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। আম্ফানের আগে সে গেছিলো বাপের বাড়ি। গাছের নারকোল দিয়ে নাড়ু, আর উঠোনে মাচার পুঁইশাক, বিধবা মায়ের জন্য রেঁধে নিয়ে যাওয়ার আগে বলেছিল, "মা টা আমার বরই ভালোবাসে নাড়ু খেতে, হাতেপায়ে জোর কমেছে সারাদিন গোপাল নিয়ে পরে থাকে, কদিন ঘুরে আসি মায়ের কাছে,বড্ড মন কেমন করছে মায়ের জন্য।" তারপর আর বাড়ি ফেরেনি বনানী।একটুও অস্তিত্বও বেঁচে নেই বনানীর গ্রামের, সাথে ভেসে গেছে বনানী ও তার মাও। সুবোধ মেনে নিতে পারেনা তার স্ত্রীর এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলেযাওয়া। মানসিক ভাবে ভেঙে পরা দাদাকে সুরেশ সঙ্গ, সান্ত্বনা দিতেই থাকে।



বাড়ির দালান ভেঙে ঢুকে পড়েছিল অ্যাম্ফান। তারপর ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে বাঁচার লড়াই চালিয়েছে সুরেশ ও তার পরিবার। হটাৎ চোখের সামনে অন্ধকার নামে। যখন চোখ খোলে চারিদিক এলোমেলো। ভাঙা দালান, তুলসীমঞ্চ, গোয়াল ঘর গিলে বয়ে চলেছে নদী, জল জল আর জল। শুধু সুরেশের পরিবার নয় সাথে আরো কুড়িটি পরিবার এখন একই জীবন স্রোতে বইছে। তাদের মধ্যে কেউ হারিয়েছে গবাদি পশু, কেউ হারিয়েছে মা বাবা, কেউবা সঞ্চিত ধন, কেউবা হারিয়েছে বসবাসের আস্তানা। এই হারানোর কোনো তালিকা হয়না।


অভিমানী নদীর বুকে লুকিয়ে গেছে গ্রাম, বাজার, হাসপাতাল, স্কুল। শুধু খানিক মাটির এই তীর যেনো দান করে গেছে প্রকৃতি। তাতে হয়ত ঠাঁই পেয়েছে একটি বটবৃক্ষ,কাউর ঘরের একচিলতে দেওয়াল, কাউর শুধুই হেঁসেল ঘর, কাউর আবার রয়েগেছে শুধুই দালান।সুরেশদের বাড়িটার কেবল রয়গেছে একটি ঘর। পাশের ঘর দুটির একটির দেওয়াল হেলে পড়েছে জলের দিকে, আরেকটির ছাদ ফেটে চৌচির হয়েছে। বহুদিন ধরে বেরা, খড় ইত্যাদি দুর দুরন্ত থেকে জোগাড় করে এনে সেগুলোর মেরামতির ব্যাবস্থা করে সুরেশ। কোনো মতে বাসযোগ্য ঠাঁই। বেঁচে যাওয়া লোকালয়টি তাদের এই তীরের থেকে বহু দূরে, নৌকা করে যেতে হয় নদীর জল ঠেলে ঠেলে।সেখানেই আছে বাজার। নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সব আনতে হয়। ফুরিয়েছে পরিবারগুলির অর্থও। দিনযাপন চলছে কষ্টের মধ্যে। সেই তীরের কোনো নাম নেই ঘর নেই, শুধু আছে একুশটি পরিবারের সব মিলে একশোকুড়ি জন মানুষ। যার মধ্যে একশো জন মহিলা আর দশ জন শিশু। বাঁচা শুরু হয়ছে এখানে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে,মাত্র দশ জন পুরুষ, যার মধ্যে পাঁচ জন বৃদ্ধ, আর তিন জন আহত। বাকি দুই জন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আহার তুলে দিচ্ছে কোনমতে এই গোষ্ঠীর মুখে। সুরেশ আর সুবোধ এই দুজন টেনে চলেছে এই বিশাল পরিবার। কিন্তু কিভাবে? সেই গল্পের কেউ খোঁজ রাখেনা।


যখন বিপদ, বিপর্যয় সব ছিনিয়ে নেয় তখন বোধয় মানুষ বাঁচতে শেখে সকলকে নিয়ে।মানুষ ভুলতে শেখে নিজের স্বার্থ। জেগে ওঠে বিবেক মানবিকতা, মনুষত্ব একে অপরের জন্য। এই পরিবারটি তারই নিদর্শন।


সুরেশ যখন বাকি সকলের চোখে স্বপ্ন আঁকছে,সে বলছে,"আমি যোগাযোগ করবো নিউজ চ্যানেলে। সরকারের কাছে আবেদন পত্র পাঠাবো, খুব শীঘ্রই আমাদের ব্যাবস্থা করবে সরকার" ঠিক তখনই অনিলের মা বয়েস তেষট্টি তিনি ঘরের মজুত করা মুড়ি, গুর প্লাস্টিকে বেঁধে দিচ্ছে সুরেশের জন্য। সে যাবে শহর তলিতে, সরকারের দ্বারে বার্তা পৌঁছাতে, আসার পথে আনবে চালের বস্তা, আলু, সব্জি। সুবোধ শিক্ষিত সে সমস্ত দরখাস্ত লিখে দিয়েছে।দুরান্তের লোকালয় থেকে জোগাড় করেছে ছোটো ছেলে মেয়েদের জন্য পুস্তক। নিয়মিত গণিত,কিশলয়,সহজপাঠ হেঁকে হেঁকে জ্ঞানের আলোটুকু জিয়ে রেখেছে সে। শিশুরা খেলা করে ওই তীরের বটবৃক্ষের ঝুড়ি ধরে।তাদের যেনো বিশ্বের সকল চিন্তা দূরীভূত হয়েছে, কারণ এদের এখন অনেক অভিভাবক। সুশীলা রান্না করে তো অনিলের মা এদের স্নান করিয়ে দেয়। কুসুম পিসি তাদের খাইয়ে দেয়। সুরেশের মা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে, এক খাটিয়ার এপাশ ওপাশ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুপুরের ঘুমে আচ্ছন্ন হয় তারা।বোঝে না অভাব বোঝেনা ঘরহারা হওয়ার শোক, ভুলে যায় ঝড়। নদীর তীরের হাওয়ায় বড় হচ্ছে একদিন দুদিন করে ওদের শৈশব।দেখে বোঝার উপায় নেই যে এরা সকলে আলাদা আলাদা পরিবার ছিলো এককালে। একবছরের এই বৃহৎ পরিবার হারিয়েছে অনেক। তবু আজ যেনো এদের জুটেছে শান্তির এক তীর। প্রিয়জনের কথা মনেকরে যখন কেঁদে ওঠে সুশীলা, দময়ন্তী; তখন বৃদ্ধা অনিলের মা, সুরেশের মা এদের বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেয়। চোখের জল মুছিয়ে দেন সুরেশের বৃদ্ধ বাবা কান্তিলাল। এভাবেই একে অপরকে ঘিরে বেঁচে থাকা এদের, ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন ছয় ঋতুর আসা যাওয়া।


দীর্ঘ আরো আট মাসের পর একদিন হঠাৎই নৌকা নিয়ে হাজির হয় মিডিয়া প্রেসার রিপোর্টাররা। ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট, লাইভ ইত্যাদির মারফৎ গোটা বিশ্বে পৌঁছে গেলো এই পরিবারের বার্তা, এবং দুর্দশার খবর। এই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে সরকার, এবং তারও প্রায় দশ মাস পর সরকারি চিঠি আসে এবং জানানো হয়

ওই একুশটি পরিবারকে তারা উদ্ধার করবে, এবং প্রত্যেকটি পরিবার পাবে তাদের আশ্রয় আর কিছু আর্থিক সাহায্য।


এতদিন পর ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন সকলের মুখেই হাসি ফুটলো। কেউ ঘর পেলো গ্রাম হতে শহরে, কেউ বা আরো গ্রামে, কেউ বা ওই তীরের কাছেই লোকালয়ে। সুরেশের পরিবারটি চলে গেলো অনেকটা দূরের একটি মফস্থলে। নতুন আশ্রয় নিয়ে আবার শুরু হলো নতুন জীবনযাপন, হারিয়ে গেলো গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের কিছু সুখ। ছোটো সদস্য গুলো স্কুল পেলো, হারালো কুসুম পিসির হাতে খাওয়া। অনিলের মায়ের পাখারা হাওয়ায় রূপকথার গল্প নিয়ে একসঙ্গে ঘুম আর নেই, হৈ হৈ করে খেলা, ওরা আর পেলো না দময়ন্তী কাকির হাতের শাক চচ্চড়ি। আবেগী মন খোঁচা দিয়ে চোখে জল এনে দেয় দময়ন্তী কুসুম আর সুশীলার কিন্তু বুকে আগলে সান্ত্বনা দিতে আসেনা অনিলের মা, সুরেশের মা,ভাঙা শরীর নিয়ে কন্তিলালের দরাজ গলার স্বর আর আসেনা।


দীর্ঘ আড়াই বছরের অভ্যেসের সংসার ভেঙে সকলে বিচ্ছিন্ন হয় আশ্রয়ের জন্য। এও এক দৃষ্টান্ত। খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতিক দুর্যোগ; অভাব বোধ করে মানুষ একটি ছাদের আর কংক্রিট ছাদের তলায় আছে সাজানো জীবন, সেখানে কখনো কখন মানুষ অভাব বোধ করে একটি পরিবারের। মানুষের জন্য মানুষ হয়ে বাঁচতে বাঁচতে এরা শিখেছে ঐক্যবদ্ধ থাকার মন্ত্র। শুধু সুভোধ আর সুরেশের হারানোর গল্প গুলো এভাবেই একা লিখেছিলো সুরেশ।সব হারিয়ে আন্তরিকতা আর মানবিকতার যে আশ্রয় তারা গড়েছিল সেটা অন্তরের গভীরে রেখেছিলো তার শেষ ঠিকানা। যে ঠিকানায় আর ফেরা সম্ভব না। কিন্তু স্মৃতির পটে জীবনযুদ্ধ জয়ের পতাকা উরিয়ে সুরেশকে হাতছানি দেয় আজও ধ্বংসের পর ভালোবাসায় গড়া এক বিরাট পরিবার। সেদিন ছিলো আশ্রয়ের ভাঙন, আজ যেনো সুরেশ অনুভব করে একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ সংসারের ভাঙন। সব পাওয়ার পরেও নেই শব্দটা বিলুপ্ত হয় না।


1 টি মন্তব্য: