জলযাত্রা
=========================
ভাস্কর পাল
=========================
শুরুতে,তিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।প্রথমে পৃথিবী সম্পূর্ণ শূন্য ছিল, চারিদিক অন্ধকারে আবৃত ছিল আর ছিল জল।টলটলে জল।তিনি বললেন,“আলো ফুটুক!” তখনই আলো ফুটতে শুরু করল।তারপর তিনি বললেন,“জলকে দুভাগ করবার জন্য আকাশমণ্ডলের ব্যবস্থা হোক।”তাই তিনি আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি করে জলকে পৃথক করলেন। এক ভাগ জল আকাশমণ্ডলের উপরে আর অন্য ভাগ জল আকাশমণ্ডলের নীচে থাকল।তারপর তিনি বললেন, “আকাশের নীচের জল এক জায়গায় জমা হোক যাতে শুকনো ডাঙা দেখা যায়।”এবং তাই হল। আবার এই জলই রোষে ফুঁসে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে গেল শুকনো ডাঙা,আমাদের আশ্রয়। উত্তর আধুনিকতার মিথ্যে মোড়কে ভুলে,বর্ণ ধর্ম আর সংকীর্ণ রাজনীতিতে জলাঞ্জলি দেই আমরা আমাদের মনুষত্ব ।
আমাদের এই উত্তর আধুনিক যুগে জলকে বলা হয় most democratic liquid, সে যুগে জল ছিল elixir of life, অন্নের আশ্রয় জল। জৈবিক পদার্থের ‘অন্তঃকোষ’ অংশে জলই হল প্রধান প্রবাহী তরল। তাই জলধারার সঙ্গে জীবনধারার তুলনা করা হয়। ‘হে জল তুমি সুখের আধারস্বরূপ’ ।
জীবনযাত্রার সব পর্যায়ে জলের উপর এই নির্ভরতা আজও রাজনীতির মানদন্ড। দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের জন্মের পর যমুনার জলকে ব্যবহার করে শুরু হয়েছিল রাজনীতির জলযাত্রা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে দুর্যোধনের আত্মগোপনও সেই জল কেন্দ্রিক।জলস্তম্ভন করা হয়েছিল দ্বৈপায়ন হ্রদের।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে গঙ্গা নদী পবিত্রতার প্রতীক।গঙ্গা জলের ও গঙ্গা নদীর পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মান্ড পুরাণে কঠোর নির্দেশ ছিল। এমনকি গঙ্গার পবিত্র জলে শৌচ্য, আচমন, গাত্র সংবাহন, মল ঘর্ষণ, বস্ত্র ত্যাগ, ফুল,মালা বা নির্মাল্য ইত্যাদি বিসর্জন না দেবার তেরোটি বিধি ছিল।অথচ আজ ভারতের কলুষনাশিনী গঙ্গায় অগণিত মৃতদেহের মৌন যাত্রা। শত শত মৃতদেহের স্বর্গ প্রাপ্তির যাত্রায় পুন্যতোয়া গঙ্গার অন্তর্জলী যাত্রা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এরপর জলের সাথে জল বিবর্তনে প্রাচীন ভারতের জল বানিজ্য বিস্তৃতি লাভ করে । পাপ পুণ্যের সীমারেখা পার হয়ে ইতিহাসের পাতায় যাত্রা করলে প্রাচীন বানিজ্য তরী থেকে ভেসে আসে সাফল্যের মূর্ছনা।
ম্যাক্সমূলার, ল্যাসেন এবং জিমারের মতো পণ্ডিতগণের মতে ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশ নিতেন । কিথের মতে ঋকবেদে যাকে সমুদ্র বলা হয়েছে, আসলে তা সিন্ধুনদের মোহনার বিস্তৃত জলরাশি । এই বাণিজ্য চলত মূলত উপকূল ধরে । অর্থাৎ, সাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না । পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’এ সমুদ্রের উল্লেখ আছে । প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে বহির্বাণিজ্যের উল্লেখ আছে । প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় নাবিকেরা সমুদ্রপথ চেনার জন্য ‘দিশাকাক’ নামে এক পাখির সাহায্য নিত । ‘শঙ্খজাত’ থেকে জানা যায়, ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্য চলত । ভারত থেকে বনৌষধি, মুক্তা, হিরা, প্রবাল, লোহা, তামা, চন্দন কাঠ, পশুচর্ম, গজদন্ত প্রভৃতি রপ্তানি হত । আর সুগন্ধি, কাচ, টিন, দামি পাথর, রং ইত্যাদি আমদানি করা হত ।
মৌর্য যুগে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও সেই সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যেরও যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল । স্থল ও জল উভয় পথেই বহির্বাণিজ্য চলত । এই সময় ভারতের বাণিজ্যতরী এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিত । অর্থশাস্ত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । এই সময় কার্পাস ও রেশমের বস্ত্র, মশলা, মূল্যবান পাথর, মুক্তা, হাতির দাঁত প্রভৃতি দ্রব্য ভারত থেকে রপ্তানি করা হত । এই সময় তিনটি বন্দরের কথা জানা যায় । সেগুলি হল- তাম্রলিপ্ত, ভৃগুকচ্ছ এবং শূর্পারক ।
মৌর্যোত্তর যুগে বহির্বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার ঘটেছিল । পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও গুজরাট অঞ্চলের সঙ্গে আফ্রিকা, মধ্যপ্রচ্য ও ইউরোপের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল । চিন ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ।৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস ভারত মহাসাগরে মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । এর ফলে ভূমধ্যাগরের বন্দর থেকে প্রথমে লোহিত সাগর ও পরে আরব সাগরের মধ্য দিয়ে নৌ-চলাচল সম্ভব হয় ।ফলে স্থলপথের উপর নির্ভরতা অনেকাংশে হ্রাস পায়, যাতায়াতের সময়ও হ্রাস হয় । এইভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কয়েকটি বন্দর ও গড়ে ওঠে, যার নাম পেরিপ্লাস ও টলেমির ভূগোলে পাওয়া যায় । এইসব বন্দরের মধ্যে সিন্ধু নদের মোহনায় অবস্থিত বারবারিকাম বন্দর বিখ্যাত ছিল । গুজরাট উপকূলে ছিল সুরষ্ট্রিনি (সুরাট) এবং বারুগাজা বন্দর নর্মদার মোহনায় অবস্থিত । কোঙ্কন উপকূলে তিনটি বন্দরের নামও জানা যায় । সেগুলি হল সুপ্পারা (সোপারা), সিমুল্লা (মুম্বাইয়ের ২৩ মেইল দক্ষিণে চৌল) ও ক্যালিয়েনা (কল্যাণ) । কোঙ্কনের দক্ষিণেও কয়েকটি বন্দরের নাম জানা যায় । তবে এইসব বন্দরের গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম ছিল । রোমের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । এখান থেকেই মশলা রপ্তানি হত । প্লিনির রচনা থেকে এও জানা যায় যে, ভারতীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনবার জন্য রোমকে প্রতি বছর ৫৫০,০০০,০০০ মুদ্রা খরচ করতে হত ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায় । গঙ্গা নদীর মোহনা থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভারতের উপকূলে অনেক বন্দরের কথা জানা যায় ‘পেরিপ্লাস’ থেকে। এইসব বন্দর গুলির মধ্যে কামারা, পোডুকা এবং সোপাটমা উল্লেখযোগ্য । পেরিপ্লাস-এর লেখক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে সুবর্ণভূমি বলে উল্লেখ করেছেন ।
তাঙ যুগে (৬১৭-৯০৭) বহু ভারতীয় বণিক ক্যান্টন বন্দরে বসবাস করত এবং দক্ষিণ ভারতে এই যুগের বহু চিনা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে । চোল রাজাদের আমলে ভারতের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । চোল আমলে প্রথমে মামল্লপুরম ও পরে নাগপট্টনম খুব বিখ্যত বন্দর ছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গলে লিখে গেছেন ‘গঙ্গা আর সরস্বতী/ যমুনা বিশাল অতি/ অধিষ্ঠান উমা মহেশ্বরী।’ ১৬৬০ সালে ভূতাত্ত্বিক ভ্যান ডি ব্রুক ভারতের, বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশের অনেকগুলি নকশা এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে তার থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্নসুত্র থেকে একদম শুরুর কথা যা পাওয়া যায় তা হোল জুরাসিক যুগে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে যখন গণ্ডয়ানা অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙ্গে যায়, তখন সৃষ্টি হয় গঙ্গা ও ব্ৰহ্মপুত্ৰের। ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় অন্তর্বর্তী বদ্বীপের এবং আরও পরে গঠন হয় বঙ্গোপসাগরের তটরেখার। পৌরাণিক মতে গঙ্গা নদী নয় – একটি খাল। এটির খনন করেছিলেন কোশালার (অধুনা উত্তরপ্রদেশের অবধ) সাগর রাজার ছেলে ভগীরথ।
এই জলেই ভেসে ভেসে বেহুলা ফিরিয়ে এনেছিল লখিন্দরের প্রাণ আর চাঁদ সওদাগর সপ্তাডিঙ্গায় পাল তুলিয়ে জলের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে বাংলার বাণিজ্যিক পরিসীমা সাত সমুদ্র বিস্তৃত করেছিল।
মনসামঙ্গল অনুসারে চাঁদ সওদাগর ছিলেন অধুনা আসামের কামরূপ জেলার ছয়গাও তথা তৎকালীন চম্পক নগরের প্রভাবশালী বণিক। ছয়গাও (ছয়গাঁ) ও সপ্তগ্রাম (সাতগাঁ)-এর মাঝামাঝি ব্ৰহ্মপুত্ৰের তীরবর্তী জনপদ ছিল অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বগুড়া – যেখানে বেহুলা ও লখিন্দরের লোহার বাসরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই রচনাটি মনসামঙ্গলের উপর নয় – কিন্তু তথ্যগুলি উল্ল্যেখ করা হল যাতে তখন নদীমাতৃক বঙ্গদেশের বানিজ্য পথগুলির একটা ধারনা করা যায়। চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল – সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী সঙ্গম। সেখান থেকে চিৎপুর – সালকিয়া - বেতড় (অধুনা শিবপুর – ব্যাতাইতলা, যা গার্ডেনরিচের ঠিক উল্টোদিকে) কালিঘাট – চুরাঘাট – বারুইপুর – ছাত্রভোগ - বদ্রিকুণ্ড – হাথিয়াগড় – চৌমুখী – শতমুখী – সাগর সঙ্গম (অধুনা বোড়াল, নরেন্দ্রপুর, কোদালিয়া, মহিনগর, জয়নগর, লক্ষ্মীকান্তপুর, নামখানা।
বাংলার কৃষি ও কৃষি উৎপাদনের ব্যাপক সমৃদ্ধি যুগপৎভাবে বাংলার মুগল শাসনকে সুসংহত করে এবং সমুদ্র ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে বাংলার সম্পৃক্তি ঘটায়। সুলতানি যুগের পতনের প্রথম পর্বে পর্তুগিজ বণিকেরা বঙ্গোপসাগরে চলে আসে এবং ষোল শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। ষোল শতকের শেষ দুই দশকে বদ্বীপের গভীর অভ্যন্তরে মুগলদের আগমন অবধি পর্তুগিজরা হুগলিতে বন্দর গড়ে তোলে, চট্টগ্রামে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটায় এবং ঢাকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় বাণিজ্য-বসতি স্থাপন করে। অবশ্য পর্তুগিজরা কখনও বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যে এশীয় বণিকদের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেনি বলে সাধারণত মনে করা হয়। ষোল শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় এবং তা স্থানীয় পণ্যের উৎপাদন ধারার গতিকে বেগবান করে তোলে।
১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি ছিল পর্তুগিজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এটি পরিচিতি লাভ করেছিল ‘পর্তুপিকোয়েনো’ হিসেবে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিখ সিজার সাতগাঁওকে একটি ব্যস্ততম শহর হিসেবে দেখেছেন। এখান থেকে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫টি ছোট-বড় জাহাজে বিভিন্ন পণ্য বোঝাই করে বিভিন্ন দিকে যাত্রা করত।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন ক্যাবরাল লিখেছেন যে, হুগলি সারা পৃথিবীর সাধারণ বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এখানে ভারত বিশেষত পর্তুগিজ ভারত, চীন, মালাক্কা ও ম্যানিলার অনেক জাহাজ পুনঃমেরামতের জন্য আসত। তিনি আরও লিখেছেন যে, শুধু এদেশের অধিবাসীরাই নয়, হিন্দুস্থানি মুগল, পারসিক, ও আর্মেনীয় বণিকেরাও এখানে দ্রব্য ক্রয় করতে আসত। ভ্যান লিন্সকোটেন এবং রালফ ফিচ লিখেছেন যে, ষোল শতকের আশির দশকেও হুগলি একটি বিশাল বন্দর ছিল। ১৫৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে আইন-ই-আকবরী লেখা শেষ হয়। এতে বর্ণিত হয়েছে যে, সাতগাঁওয়ের চেয়ে হুগলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল।
সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে হুগলিতে কারখানা স্থাপন করে ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে। ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরে গঠিত হয় এবং সতেরো শতকের আশির দশকে তারা এই অঞ্চলে বাণিজ্য শুরু করে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ এর পর বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ইংরেজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ইউরোপীয় ও এদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেয় এবং বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
সাত চল্লিশে দেশভাগের পর বন্ধ হয়ে যায় পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম বাংলার সড়ক, রেল ও নৌ-পথ যোগাযোগ। কলোনিয়াল কন্সপিরেসি আর ধর্মাশ্রিত রাজনীতির ডামাডোলে বন্ধ হয়ে যায় একই ভাষা ও ভূগোলের মানুষের সুপ্রাচীন কাল থেকে অব্যাহত থাকা সাংস্কৃতিক লেনদেন। প্রচলিত থাকা যোগাযোগের পুরনো সব রুট আর বন্ধনগুলি।
নয়া সীমান্ত, বিভাজন রেখা, কাঁটাতার, জাতীয়তাবাদী নয়া চেতনা ও পরিচয়ে একই ভাষার মানুষের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব বাড়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা রায়টের বীভৎস ক্ষত, ভয়—ভূতের মত মনের কোণে থেকে যায় অনঅপসৃয়মান আবছায়া হয়ে। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের নয়া জিগিরে সীমান্তে সিল গালা হয়। এর মধ্যেই ভাগ হয়ে পড়ে আসাম, সিলেটের করিমগঞ্জ, ভাগ হয় পাঞ্জাব, ভারতবর্ষ।
জল জীবন ধারণের এক মৌলিক চাহিদা৷ পরিবেশ সুরক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷মানব সভ্যতার ভবিষ্যত নির্ভর করছে জলের ব্যবহারের ওপর৷ অথচ মিষ্টি জলের উৎস ক্রমশ ক্ষীয়মাণ৷ আপাতদৃষ্টিতে এই বসুন্ধরা জলসম্পদে সমৃদ্ধ৷ কিন্তু এই জলের ৯৭.৫% পানের বা চাষের অযোগ্য৷ মিষ্টি জলের মোট পরিমাণ আড়াই শতাংশের মত৷তাও সহজলভ্য নয়৷ এই আড়াই শতাংশের ৬৯ শতাংশ আসে গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ থেকে আর ৩০% জল মাটির নীচের৷ একদিকে পৃথিবী থেকে মিষ্টি জলের উৎস কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়ে চলেছে৷ আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পড়বে তীব্র জল সংকটের মুখে, যদি না জলের অপচয় রোধ করা যায়৷
ভারতে মিষ্টিজলের উৎস মূলত দুটি৷ এক, হিমালয়ের গ্লেসিয়ার আর অন্যটি বৃষ্টিপাত৷ গ্লেসিয়ার থেকে জলপ্রবাহে কিছুটা টান পড়লেও ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণে কিন্তু বিশেষ তারতম্য হয়নি৷ খামতিটা রয়ে গেছে জলসম্পদ পরিচালন ব্যবস্থাপনায়৷ কী পরিমাণ জল আছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে পানীয় জল কতটা দরকার, কৃষি ও শিল্পকারখানার জন্য কতটা দরকার, ভূ-গর্ভস্থ জলের সদ্বব্যবহার কীভাবে করা উচিত সেটা ঠিকমত করা হয়নি৷ উষ্ণায়নের ফলে জলের বাষ্পীভবন হচ্ছে বেশি৷ দেখা যাচ্ছে, চাহিদা জোগানের ব্যবধান বাড়ায় মাথাপিছু জলের পরিমাণ অনেক কমে গেছে৷
ইতিমধ্যে চেন্নাই, মহারাষ্ট, রাজস্থান, গুজরাট ও কেরালাসহ বিভিন্ন রাজ্যে অস্বাভাবিক জলসংকটে নাজেহাল বিপুল সংখ্যক মানুষ৷এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে চেন্নাইকে শুধুমাত্র বৃষ্টিই পারে রক্ষা করতে ৷ সম্পূর্ণ ফাঁকা কুয়ো ও জলবিহীন শহর চেন্নাই৷ রাজ্যের প্রধান ৪টি জলাধারই শুকনো৷
‘‘ভারতে মোট ৬ লক্ষ ৫৬ হাজার গ্রাম রয়েছে৷ সেখানে ১৯ কোটি ১৯ লক্ষ পরিবার বসবাস করে৷ জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি৷ নীতি আয়োগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৬০ কোটি মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোনো বন্দোবস্ত নেই৷ দেশে মোট ১৮ শতাংশ মানুষ পাইপলাইনে পানীয় জলের পরিষেবা পাচ্ছেন৷ মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরালা ও গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে পানীয় জলের গভীর সংকট দেখা দিয়েছে৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷ ভূগর্ভস্থ জল তুলে চাষাবাদ-সহ অন্যান্য কাজে লাগানোয় জলস্তর ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷
জল সম্পদের ভাগবাটোঁয়ারা নিয়েও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্রাবর্ত সুস্পষ্ট৷ কেউ কেউ বলছেন বিশ্বের জল সংকটের সমাধান করতে না পারলে জল নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বাধাও বিচিত্র নয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে, জলের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে এর সমাধান কী ?
অভিন্ন নদীর জলবণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদী অমিমাংসিত ইস্যু। দু'দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি।১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর জল বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর জল ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে সিন্ধু নদের শাখানদী চেনাব অববাহিকায় ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে, সে সম্পর্কে পাকিস্তানের আপত্তি নিয়ে নতুন দিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তানের সিন্ধুনদের জল কমিশনারদের বৈঠক৷
চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের গাইকা শহরের থেকে ৯ কিমি (৫.৬ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ইয়ারলুনং জ্যাংবো বা ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত একটি মাধ্যাকর্ষণ বাঁধ নির্মিত হয়েছে নাম জঙ্গমু বাঁধ । এই বাঁধ ভুটান-ভারত সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নির্মিত। বাঁধের উদ্দেশ্য হল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। বাঁধ যত নিচের দিকে হবে, বাংলাদেশের দিকে জল প্রবাহ তত কমবে। এর মানে হলো, তিব্বতে চীনের জল আটকে রাখায় যত সমস্যা হবে, অরুণাচলে বাঁধ হলে তা আরও বাড়বে, যেহেতু অরুণাচল থেকেই ব্রহ্মপুত্র বেশি জলধারা পায়। অর্থাৎ জলযাত্রায় স্বাভাবিক ছন্দবিরতি। সমস্যা ভারত আর বাংলাদেশের।
রাজ্যের দিকে তাকালে আমাদের ক্যানভাস ভিজে যায় জলের ঢেউয়ে ।
২০০৯-এর ২১ মে আয়লা এসেছিল। আয়লার তাণ্ডবের পর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের কয়েক হাজার কিলোমিটার নদী বাঁধ। প্রবল জলোচ্ছাসে আর নদীর ঢেউয়ে ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদীবাঁধের অধিকাংশই। আয়লার তাণ্ডবে ১৭৭ কিলোমিটার সমুদ্র ও নদী বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিল। ৬০১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তারপর প্রায় মাস দুয়েক ধরে নোনা জলে বন্দি হয়েছিল সুন্দরবন।
আমফান এল ২০২০ এর ২০ই মে। মাঝের এগারো বছরে আয়লায় বিধ্বস্ত বাঁধ সারাইয়ের প্রথম দফার কাজ এখনও অসমাপ্ত। সম্ভবত জমি জটিলতার কারণে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় টাকারও সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়নি। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবের পরে সুন্দরবনে পাঁচ কোটি ম্যানগ্রোভ চারা লাগানোর কথা জানিয়েছিল বন দফতর।১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে স্থানীয় মানুষজনকে দিয়েই ওই কাজ করানো হয়েছে। তাতে খরচ হয়েছে ছ’কোটি বাহান্ন লক্ষ টাকা। আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে ওই বনসৃজন হয়েছে।
২০১০ সালের শেষে প্রথম পর্যায়ে ১৮৪ কিমি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত প্রকল্পের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পর্বে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৩৩৯ কোটি টাকা। এই ১৮৪ কিমি বাঁধ সারাইয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৫০০ একর জমি। তদানীন্তন সরকার এই জমি অধিগ্রহণের নোটিস দিয়েছিল।এর পরেই রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে নব গঠিত সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সরকার কোনও জমি অধিগ্রহণ করবে না।
এবার ২৫ শে মে ২০২১, ভরা কোটালের মধ্যে আছড়ে পড়ল ইয়াস। ফলে তার জেরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নদীগুলির জল ভাসিয়ে দিল গ্রামের পর গ্রাম। সুন্দরবনে মাটির বাঁধ ভাঙল।সর্বত্র গ্রাম ভাসল। অনেক বাড়ি ভেঙে পড়ল।ইয়াসের তাণ্ডবে ভেসে গেল পশ্চিমবঙ্গের ৬৬ টি বাঁধ। কোথাও হাতানিয়া দোয়ানিয়া, কোথাও বিদ্যাধরী নদীর জল ভাসিয়ে দিয়েছে একের পর এক গ্রাম। সাগরদ্বীপে কপিল মুনির মন্দিরের কাছেও অনেকখানি জল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
ইতিহাসের সুবাসিত ঐতিহ্য হারিয়ে জলের জলচক্রে আমাদের ঘটে চলেছে জল বিবর্তন। এখন বানিজ্য তরীর ধাক্কায় জলের মধুর তরঙ্গ উজান টানে ফিরে আসে না। বাস্তবতাহীন পরিকল্পনা আর সংকীর্ণ রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে ম্যানমেইড প্লাবনে আমরা জলমগ্ন হয়ে পড়ি।আর আত্মমগ্ন হই ভেনিসের ভেলকিতে ।
সম্প্রতি প্রায় দেড় ঘণ্টার মুষলধারার বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল শহর প্রাচীন ভারতের রাজধানীর অধিকাংশ৷আর সেই জমা জলের প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি রাজ্য রাজনীতির পীঠস্থান বিধানসভাও৷পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভিতরে আম্বেদকর মূর্তির সামনে সাজানো বাগান একটি নদীর আকার ধারণ করেছিল৷যেদিকেই চোখ যেত জল আর জল৷টলটল জল ।
জলের স্বরূপ বোঝার একটা প্রচেষ্টা পাশাপাশি তার নিয়ে -----------। খুব সুন্দর হয়েছে।
উত্তরমুছুনanoboddya....
উত্তরমুছুন