অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১

প্রবন্ধে রণবীর

 

বাঙালীর জলযাত্রা
================
রণবীর চন্দ
================



সে একটা যুগ ছিল - অনেক অনেক বছর আগে, যখন বাণিজ্যের সম্ভার নিয়ে বাঙালীর সপ্তডিঙ্গা ভেসে যেত দূর থেকে দূর দেশে-সাত সমুদ্র পেরিয়ে, সিংহল, মালয়, সুবর্ণদ্বীপ হয়ে, রোম, গ্রীসে। খালি ছেলেরাই যে যেত তা নয়, মেয়েরাও যেত। অনেক জাহাজে খালি মেয়েরাই থাকত। নানারকম মশলা, চাল, গুড় , মসলিনের কাপড় নিয়ে সেই সব জাহাজ ভেসে চলত। বিনিময়ে নিয়ে আসত স্বর্ণমুদ্রা। গ্রীস, রোমের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত মেয়েরাও কেরকমভাবে দূরদেশে এসে একাএকা ব্যবসা করে যায়। সে কত বছর আগেকার কথা? তা অন্ততঃ চারশো বিসি মানে প্রায় আড়াইহাজার বছর তো হবেই।

মধ্যযুগে রচিত মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের চাঁদ সওদাগর বা ধর্মমঙ্গলের ধনপতি সওদাগর সেই সুদূর অতীতযুগেরই স্মৃতি বহন করে। রাজা শশাঙ্কের আমলেই বাঙালীর সমুদ্র বাণিজ্যে ভাটা পরে যায়। সেই সমৃদ্ধি আর ফিরে আসেনি। চাঁদ সওদাগর বা ধনপতি সওদাগরের কাহিনি আরও পুরানো। অন্ততঃ খ্রীষ্টজন্মের চারশো বছর আগের গঙ্গারিডাই সভ্যতার সমসাময়িক অথবা আরও পুরানো প্রায় চারহাজার বছর আগেকার পাণ্ডুরাজার ঢিপি বা পুন্ড্রবর্ধন রাজত্বের সমসাময়িক। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমুদ্র বাণিজ্যের কাহিনীই পরবর্তীকালে মঙ্গলকাব্যের চরিত্র হিসাবে থেকে গেছে। আদিমতম মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরান পাল যুগের রচনা, লিখেছিলেন কানা হরিদত্ত। সেই মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ পাল সাম্রাজ্যের সাথে সাথে সারা ভারতে প্রচলিত হয়। তবে কাহিনীর সূত্র আরও অনেক পুরানো। বাঙালী গন্ধবণিকেরা চাঁদ সওদাগরকে তাদের পূর্বজ বলে মনে করেন।বাংলার গন্ধদ্রব্যের ব্যবসা গ্রীস ও রোমের সাথে চলত। চাঁদ সওদাগর সম্ভবতঃ ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন। বাংলাদেশের বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে চাঁদ বেনের বাড়ি ছিল। এই এলাকাটি ছিল পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী। মহাভারতের সময়ই পুন্ড্রবর্ধন এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য। এখানকার বণিকেরা পালতোলা নৌকায় চেপে দেশ বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন। পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের সেই বাণিজ্যের স্মৃতিই অনেক পরবর্তীকালে রচিত মনসামঙ্গল কাব্য ধরে রেখেছে।

প্রাচীন বাংলার বাণিজ্য অবশ্যই সমুদ্র নির্ভর ছিল। সমুদ্র বাণিজ্য মানে রপ্তানির মাধমেই বাঙালীর ঘরে লক্ষী আসত। চারহাজার বছর আগের বর্ধমানের পান্ডু রাজার ঢিপিতে যে বিলুপ্ত নগর সভ্যতার খোঁজ পাওয়া গেছে সেখানে দেখা গেছে যে সেইসময়ই সেখানকার বণিকেরা ক্রিট দ্বীপের সাথে বাণিজ্য করত। মূলত মশলাই যে রপ্তানী হতো তারও প্রমান আছে। বাংলা থেকে সেইসময় বিদেশে পিপ্পলী বলে লম্বা একরকম গোলমরিচ রপ্তানী হতো। তখনও লঙ্কা বা অন্য কোনো মশলা আসেনি। এই পিপ্পলী ব্যবহার করা হতো মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের কাজে। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস পিপ্পলীর ঔষধী গুনের কথা লিখে গেছেন। ইউরোপে এই পিপ্পলী যেত বাংলা থেকেই। তবে সমুদ্র বাণিজ্যের এই স্বর্ণ যুগ শশাঙ্কের আগেই শেষ হয়ে যায়। তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়েও বাণিজ্য এইসময় ভাটা পরে যায় , পরে তা আর কোনোদিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালীর সমুদ্রবাণিজ্যই ছিল তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল উৎস। নীহারঞ্জন রায় বলেছেন খ্রীষ্টপূর্ব সময় থেকে শুরু করে খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী অবধি বাঙালীর বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ। এইসময়ই পৃথিবীর নানা দেশে বাংলার জিনিসপত্র রপ্তানী হয়ে বাংলার ঘরে বিনিময়ে সোনা জমা হতো। সেই সমৃদ্ধি পরে আর ফিরে আসেনি। গৌতম বুদ্ধের সময়েও তাম্রলিপ্ত বন্দর ছিল। বাংলার ছেলে বিজয়সিংহ এই পথ দিয়েই সিংহলে গিয়েছিলেন। অতুল সুরের মতে, তাম্রযুগের সভ্যতায় বর্ধমান থেকে তাম্রলিপ্ত অঞ্চল ছিল সারা পৃথিবীর বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র।

তৎকালীন বাংলার অন্যতম প্রধান নগরী গৌড়। এই গৌড় নামটি এসেছে গুড় থেকে। এই গুড়ও প্রচুরপরিমানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে ও ইউরোপে রপ্তনি হতো। আখ এবং তাল গাছের রস জ্বাল দিয়েই গুড় তৈরী করা হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে গৌরিক নামে একরকম রাসায়নিক দ্রব্য যা গৌড়ে তৈরী হতো তা সোনা পরিশোধনের কাজে ব্যবহার করা হতো ও দেশবিদেশে রপ্তানী হতো। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা থেকে উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, "যখন লোকে লোহার ব্যবহার করিতে জানিত না, তখন বেতে বাঁধা নৌকায় চড়িয়া বাঙালীরা নানা দেশে ধান চাউল বিক্রয় করিতে যাইত, সে নৌকার নাম 'বালাম নৌকা ' । তাই সে নৌকায় যে চাউল আসিত তাহার নাম ‘বালাম চাউল’ হইয়াছে"। জৈনদের ধর্মগ্রন্থ কল্পসূত্রেও উত্তরবাংলার পুন্ড্রবর্ধন নিবাসী পুণ্ডরীক নামে এক বণিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুণ্ড্রের প্রধানতম পণ্যগুলি ছিল কৃষি ও পশুপালন থেকে প্রাপ্ত। সেইসময় গৌড়ের রপ্তানীযোগ্য সেরা জিনিস ছিল আজ্য, বা ঘি। ঐ ঘিয়ের নামই হয়ে গেছিল ‘আজ্যসার গৌড়', মানে গৌড়ের ঘি। পুন্ড্রে প্রচুর তেজপাতা উৎপন্ন হতো, আর সেগুলি নৌকা করে করতোয়া ও গঙ্গা নদী হয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসে পৌঁছাতো, তারপর ওখানথেকে বিদেশে রপ্তানী হতো। এদিকে এক পাউন্ড বা আধ সের পিপ্পলী গ্রীসে বিক্রি হতো পনেরো স্বর্ণমুদ্রা দামে, প্লিনির ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে যায় যে সারা ইউরোপের স্বর্ণমুদ্রা জমা হতো বাংলার ঘরে।

খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধগুপ্ত নাম একজন বৌদ্ধধর্মাবলী বণিকের নাম পাওয়া যায়। বুধগুপ্ত বাণিজ্যপোত্ নিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে বাণিজ্য করতে যেতেন। ভারতে ও ভারতের বাইরে ওনার অনেক তাম্রপত্র ও শিলালিপি পাওয়া যায়। মালয়েশিয়াতে তাঁর নাম একটা শিলালিপি পাওয়া গেছে যা উনবিংশ শতাব্দীতে আবিস্কৃত হয়েছিল। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে এই বুদ্ধগুপ্তের নিবাস ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ জেলায় কর্ণসুবর্ণের কাছে রাঙামাটি গ্রামে।

সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রামচরিতে দেখিয়েছেন যে সেইসময় বরেন্দ্রভূমিতে প্রচুর এলাচ ও পিপ্পলী নামক গোলমরিচের চাষ হতো এবং ঐ এলাচ ও পিপ্পলী বিদেশে রপ্তানী হতো। আর হতো প্রচুর তেজপাতা, লবঙ্গ ও সরিষা। পিপ্পলী, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা , সরিষা বাংলা থেকে গোটা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মিশর ও ইউরোপে চালান যেত। সর্ষের ও তিসির তেলও প্রচুর পরিমানে বিদেশে চালান যেত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর বেদের মেয়ে উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে পিঁপে পিঁপে সর্ষের ও তিসির তেল বড় বড় পালতোলা জাহাজে করে সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ, মালয় উপদ্বীপ সহ সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মিশর, গ্রীস, রোম সহ সমগ্র ইউরোপে রপ্তানী হতো। কখনও কখনও সমুদ্রে ঝড় ও বড় বড় ঢেউ উঠলে পরে পিঁপে পিঁপে তেল সমুদ্রে ঢেলে সেই ঢেউ সামলানো হতো। এইসব দ্রব্য যে বাংলা থেকেই ইউরোপে রপ্তানী হতো তার প্রমান পেরিপ্লাস গ্রন্থে ও টলেমির ও প্লিনির ইন্ডিকা গ্রন্থে আছে। রাজশেখর তাঁর কাব্য মীমাংসা গ্রন্থে ভারতের পূর্বাঞ্চল বা পূর্ব দেশের ১৬টি জনপদের উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে উৎপন্ন দ্রব্যের একটা তালিকাও দিয়েছেন। এরমধ্যে বিভিন্ন মশলাপাতি, ঘি যেমন ছিল , তেমনি আরও অনেক দ্রব্য যেমন, লবলী, গ্রন্থিলরনক, অগুরু, দ্রাক্ষা, কস্তুরিকা ইত্যাদিও ছিল। সেইসময় বাংলার অর্থনীতিই চলত সমুদ্র বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে।

প্রাচীন বাংলার এই সমুদ্র বাণিজ্য পালযুগেই হারিয়ে যায়। সপ্তম শতাব্দীতেই বাংলার সমুদ্র বাণিজ্য মোটামুটি শেষের পথে। তবুও পাল সম্রাট মহিপালের শাসনকালে লোকদত্ত ও বুধমিত্র নামে দুইজন বণিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেনযুগে তো সমুদ্র বাণিজ্য একেবারেই শেষ হয়ে যায়। লক্ষণসেনের অন্যতম সভাকবি গোবর্ধন আচার্য লিখে গেছেন,
 “তে শ্রেষ্ঠীনঃ ক্ক সম্প্রতি শত্রুধ্বজ যৈঃ কৃতস্তবোচ্ছায়ঃ।
ঈষাং বা মেঢ়িং বাধূনাতনাস্ত্বাং বিধিৎসন্তি।।

হে শত্রুধ্বজ! যে শ্রেষ্ঠীরা (একদিন তোমাকে উন্নত করিয়া গিয়াছিলেন, সম্প্রতি সেই শ্রেষ্ঠীরা কোথায়? ইদানীংকালে লোকেরা তোমাকে (লাঙ্গলের) ঈষ অথবা মেঢ়ি (গরু বাঁধিবার গোঁজ) করিতে চাহিতেছে।”

নীহাররঞ্জন এই শ্লোকটি সমন্ধে জানাচ্ছেন যে “প্রাচীনকালে শ্রেষ্ঠীরা শত্রুধ্বজোত্থান পূজা (ইন্দ্রের ধ্বজার পূজা) উৎসব করিতেন। দ্বাদশ শতকেও উৎসবটি হইত কিন্তু তখন আর শ্রেষ্ঠীরা ছিলেন না।"

মধ্যযুগে কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল যে বর্ণনা দিয়েছে গন্ধবণিকদের, তাতে বোঝা যায়, বড়মাপের ব্যবসা বাণিজ্য আর হত না। কবিকঙ্কণ লিখছেন,

“পুরে বৈসে গন্ধবেণ্যা গন্ধ বেচে ধূপ ধুনা
পসার সাজায়া চলে হাটে।”

মানে গন্ধবণিকেরা পসার সাজিয়ে হাটে বসে ধুপ-ধুনো বিক্রি করে।



সপ্তম শতাব্দীর পরে আর কোনো স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় না। পাল ও সেন যুগের কোনো স্বর্ণমুদ্রাই পাওয়া যায়নি। রৌপমুদ্রা অবশ্য কিছু পাওয়া গেছে। অষ্টম শতাব্দীর পর হতে তাম্রলিপ্ত বন্দরেরও কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি কোনো সমুদ্র বন্দরেরও উল্লেখ নেই। অনেক পরে পঞ্চদশ শতাব্দীতে সরস্বতী নদীর তীরে সপ্তগ্রাম এবং বঙ্গোপসাগরের কোলে চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে ওঠে। বলা যায় যে অষ্টম শতাব্দীর পরে সেরকম ভাবে সমুদ্র বাণিজ্য হতো না , কারণ বন্দরই তো নেই। সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার সমুদ্র বাণিজ্য যে হারিয়ে গেল তা আর কোনোদিনই ফিরে এলো না।

নিচের মৃৎপাত্রটি পশ্চিম বাংলার বারাসাতের কাছে চন্দ্রকেতুগড়ের কাছে পাওয়া। পাত্রটির বয়স চারশো বিসি মানে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার। এখানে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের নৌকা করে বাংলার বণিকেরা বাণিজ্যে যাচ্ছে। একটা নৌকায় কেবল মেয়েরাই আছে।







চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র, যা বর্তমানে আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে





তথ্যসূত্র

১, তমাল দাসগুপ্ত, শারদীয়া গন্ধবণিক বাণী, ২০১৭

২, রমেশচন্দ্র মজুমদার, হিস্ট্রি অফ এনসিয়েন্ট বেঙ্গল, পৃ - ২৩-২৪

৩, নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা

৪, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বেনের মেয়ে, গুরুদাস চ্যাটার্জী এন্ড সন্স, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলকাতা




1 টি মন্তব্য:

  1. আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানায়।

    উত্তরমুছুন