মৌসুনি
===================
অশোক রায়
===================
ভোর রাত থেকে ব্যস্ত মৌসুনি’র মানুষজন। পরেশ, ইয়াসিন, ভুবি’রা তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে পরিবার সমেত বেরিয়ে পড়েছে। উঁচু ডাঙার পানে, যেখানে শক্ত জমি, সেই রাস্তার পারে যেখানে সরকারি ক্যাম্প বসেছে। শেল্টার। রিক্সা, অটো ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে টাকার বিনিময়ে।
সিন্ধুর সেদিকে দৃষ্টি পড়ে না, তার মন চিন্তা দৃষ্টি সব সাগর পানে। ওই বুঝি বাবা এল বিরাট নৌকো নিয়ে তাদের সবাইকে নিয়ে পাড়ি দেবে নিরাপদ একস্থানে – কইরে, আয় জল তো বাড়ছে। তার বাবা ছিল বড় মাঝি, লখনা মাঝি।
দু-বছর আগে এমনি এক ঘুর্ণিঝড়ের রাতে বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল – এই তো যাব আর আসব। বাঁধের কাছে বড় নৌকাখান রাখা আছে, নিয়ে আসি। সেই যে গেল বাবা আর ফিরল না। সারা রাত সবাই জেগে, ঝড়ের দাপট বাড়ে কিন্তু বাবার দেখা নেই। সকাল হতে সভয়ে দেখে চারদিকে ধু ধু জল, বাঁধ নিশ্চিহ্ন, তার সাহসী বলিষ্ঠ বাবা কোথাও নেই - তাদের দ্বীপের আভাসটুকুও নেই, শুধু ছোট ছোট ঢেউয়ের ভাঙ্গা-গড়া। সেই থেকে সিন্ধু একা, তার যে আর কেউ নেই।
সিন্ধু জানে প্লাবন এসে রাতের অন্ধকারে তার বাবাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আয়লা, বুলবুল, ফণি, আম্পান, ইয়াস মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এত ঘনঘন ঘুর্ণিঝড় এসে তছনছ করে গেছে যে মৌসুনি আর ঘোড়ামারার স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। পঞ্চায়েত প্রধান জানিয়েছে এবারো যদি গ্রাম ভাসে, সরকার আর বাঁচাতে পারবে না, গ্রামবাসীদের অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে।
চলতে চলতে সিন্ধু ঝাপসা চোখে দেখতে পায় একটা বিশাল নৌকো, ছোট জাহাজের আকার, তার সামনে এসে দুলছে বাঁধের জলে – তার বাবা দুখান মস্ত দাঁড় ধরে আছে, সবাইকে ডাকছে – এসো এসো ওঠ ওঠ শিগ্গির । ওমা একি নৌকা সমেত পুরো গ্রামটাই যে চলে যাচ্ছে দূরে আরো …দূরে… বাবা… বাবা… আনমনে চেঁচিয়ে ওঠে সিন্ধু। দুচোখ জলে ভাসে। কত সুখস্মৃতি কত দুঃখ-ভালোবাসা জড়িয়ে…সে সব ফেলে যাওয়া কি এত সোজা!
হঠাত সিন্ধুর মাথাটায় কেমন ওলটপালট হতে থাকল। একটা ডিঙি নৌকো ভাসছিল জলে উপুড় হয়ে। সেটাকে সোজা করে চেপে বসল। সে যাবে না শেল্টারে, কোথায় না কোথায় পাথুরে জংগলে পাঠিয়ে দেবে! সে যাবে না। উপকুল ধরে সে ডিঙি বাইবে – তার বাবার মত – বাবা বলেছিল কাছেই বর্ধিষ্ণু গ্রাম নাকি আছে… সেখানে গিয়ে নতুন সংসার পাতবে। জল ছেড়ে সে যাবে না।।
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানায়।
উত্তরমুছুন