কলেজের ক্লাস শেষ করে কফি হাউসে চলে এল শাক্য। কমনরুমে আজ আর বসে থাকা গেল না। সেই ঘুণধরা রাজনীতির কচকচানি।আজ অর্ণব ও শান্তনু আসবে কফি হাউসে। ওদের শারদীয়া পত্রিকার প্রচ্ছদ ঠিক হবে আজ। ওদের আসতে অনেকটাই দেরী। যথারীতি বাঁদিকের কোণের টেবিলে বসল ও।বেয়ারা হায়দারকে কফি ও চিকেন পকোড়ার অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। মাথাটা সকাল থেকেই ভার ভার। সিগারেট সুখে মগ্ন হতেই চেনা কন্ঠ: "বসতে পারি?" চমকে চোখ তুলতেই হৃদয় জুড়ে বিস্ফোরণ ! হাজার ঝাড়বাতির আলো স্মৃতির সরণীতে। মনের গহীনে বিসমিল্লার পাগলা সানাই !
সঞ্চিতা ! বিশ সাল বাদ ! সেই কফি হাউস।সেই বুধবার। সেদিনও ও বিশেষ কিছু বলবে বলে আসতে বলেছিল।শাক্য যথারীতি এলেও সঞ্চিতা আসেনি। দীর্ঘ তিনঘন্টা অপেক্ষা করে বুকে জ্বালা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল।ফোনেও সঞ্চিতা ছিল নিরুত্তর।সব চেষ্টাই হতাশায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিল।আগুনে দগ্ধ মহাকাশ তখন শাক্যর। হঠাৎ যেন ও ভোকাট্টা ঘুড়ি একটা। ভেসে চলেছিল কোথায় তা নিজেরও যেন অজানা। আস্তে আস্তে সইয়ে ছিল সব। বিশ্বাস হীনতা যে নি: শ্বাসহীনতারই সামিল ! তাই আর ও পথে যাওয়া হয়নি শাক্যর। অনেক প্রলোভন এড়িয়ে আজও ও কেয়ার অফ একাকীত্ব !
মুচকি হেসে সঞ্চিতাকে বসতে বলে আরো এক কাপ কফির অর্ডার দিল ও। সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল সঞ্চিতার দিকে। আগে তো ও খুব ধূমপায়ী ছিল। তবে আজ নঞর্থক রইল। টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিল সঞ্চিতা।এক দৃষ্টে তাকিয়ে শাক্য। বুকের ভেতর সেই আগের মাদল দ্রিমি দ্রিমি বাজছে।না , আজ আর মনকে প্রশ্রয় নয়।আজ হারলে চলবে না। সেদিনের অপমানের জ্বালায় আজও পলি পড়ে নি সেভাবে। রক্তক্ষরণ ওর যাপনে এখনো। আজ জানতেই হবে ওদের ইতিহাসের বদলের কারণ। কফি খেতে খেতে কিছু কথা চললো যা শাক্যকে আরো অভিসারী করে তুলল। হঠাৎ ওর প্রশ্নের অভিঘাত: "সঞ্চিতা, স্পষ্ট করে বলতো, আমাকে অচল পয়সা ভাবার কারণটা।"
প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলো সঞ্চিতা।শাক্য দুচোখ ভরে দেখল, হাসলে আজও গালে সেই টোল ! ঐটা দেখবে বলে ও সঞ্চিতাকে অতীতে অকারণে হাসিয়েছে বারে বারে ।আজ আর বুকে সেই দোলা গরহাজির। এদিকে সঞ্চিতা বলে চলল :"আজ তোমাকে কথাটা আমাকে বলতেই হবে। আসলে প্রেমিক হিসেবে তুমি ছিলে উপমাহীন।প্লাটোনিক লাভ শব্দটার অর্থ যেন সশরীরে তুমি। কয়েকবার হাত ধরা ছাড়া আমাকে ছুঁয়েও দেখনি কোনদিন। একান্ত হতে চাওয়ার মুহূর্তেও তুমি সেই ব্যক্তিত্বময় কঠিন পুরুষ। আমার শরীর যখন তোমাকে আশ্লেষে চাইতো বারে বারে, তখন তুমি উদাসীন। আমার ঠোঁট যখন তোমার শরীরের সমস্ত আবেগ শুষে নিতে চাইতো, তখনও তুমি নির্বিকার। কতবার তোমার কাঁধে মাথা রেখে নিজের গভীরে ডুব দিতে চেয়েছি, তুমি বোঝো নি তা ! মাঝে মাঝে মনে হতো , তুমি বোধহয় ঈশ্বর হতে চাইছো। শরীরহীন প্রেমের মন্দিরে জাগ্রত দেবতা। তাই দাম্পত্যের কথা ভাবলেই ভয় পেতাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো। তাই আস্তে আস্তে শেষে সরে আসতে লাগলাম তোমার থেকে।জানি তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলে। কিন্তু জীবন তো একটাই ! আমার জীবনকে তাই নষ্ট হতে দিতে চাইনি। শূণ্যস্থান পূরণ করল তোমারই বন্ধু সৌজন্য।এই কফি হাউসেই একদিন ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে। সেদিন ওর চোখ কাম লক্ষ্য করেছিলাম।মন প্রথমে সায় দেয় নি। তবে শরীর মনের কথা শুনল না। অন্য শরীর আবিস্কারের নেশায় সে মশগুল।এক বিকেলে ওদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে ধরা দিলাম ওর কাছে। আমার তৃষ্ণা সেদিন ও মিটিয়ে ছিল এক সমুদ্র আবেগে। ঠিক করলাম বাকি জীবনটা ওর বাঁধনেই কাটাব। আমাদের বিয়ের খবরটাই দেবো বলে সেদিন তোমায় ডেকেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো, তোমাকে এটা বলা আমার পক্ষে কঠিন।আর তাছাড়া আবেগপ্রবণ তুমি কিভাবে নেবে ,তাও চিন্তার কারণ ছিল।তাই সেদিন.....।"শেষের কথা গুলো বলতে গিয়ে মুখ নীচু করলো ও।
এক অদ্ভুত ঘোরলাগা নিয়ে শাক্য তাকিয়ে রইল সঞ্চিতার দিকে।তারপর হঠাৎ "হো হো" করে স্বভাববহির্ভূত হাসিতে ফেটে পড়ল।হাসি যেন থামতে চায় না ওর। আশপাশের টেবিলে তখন উৎসুক মুখ ও কান। অপ্রস্তুত সঞ্চিতা।এমন প্রতিক্রিয়া নিরীহ শাক্যর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত।শাক্য হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। সঞ্চিতার দুটো হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল :" তোমাকে ধন্যবাদ সঞ্চিতা। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাকে তুমি মুক্তি দিলে। আসলে তুমি শরীর সর্বস্ব ভালোবাসা চেয়েছিলে।মন প্রস্তুত হবার আগেই।এ একপ্রকার লালসা ,সঞ্চিতা। আমি তোমার ভালোবাসাকে সন্মান করে আজীবন এক সাথে এক শরীরেই পথ চলতে চেয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করিনি।জানি প্রত্যেক জিনিসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়েই তা গ্রহণ করলে সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়। শরীর শরীর, তোমার মন নাই! সঞ্চিতা সঞ্চিতা , তোমার মন নাই ! হা হা হা । আসলে তুমি মন নয়,শরীর বিলাসী !"
শাক্যর হাসি কফিহাউসের মেঝে, দেওয়াল সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।যেন বিদ্রুপ করছে সঞ্চিতাকে । বলতে চাইছে, "ভুল ভুল, বড়ো ভুল ছিলে তুমি সঞ্চিতা।শাক্যর প্রেমের যোগ্যই তুমি ছিলে না।মন ছাড়া শরীর হয় না। রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে। তুমি তা বুঝতেও চাওনি।"মুখ নীচু করে বসে সঞ্চিতা। তবে কি ও ভুল করেছিল ?একটা ভালো মানুষকে ঠকিয়ে শুধু শরীরী সম্ভোগের জন্য? অন্ধ শরীরী এক প্রেতছায়া যেন সঞ্চিতার সারা শরীরে পরাজয়ের কালিমা লেপে দিতে লাগল।
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানায়।
উত্তরমুছুন