অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

ইচ্ছে-পূরণ


 

ইচ্ছে-পূরণ
===================
মৌসুমী রায়
===================



টিকলি বছর দুয়েক ধরেই ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছে, বাপি এবার ক্রিস্টমাসে আমার মোবাইল ফোন চাই। তার বাপি কথা দিয়েছে মাধ্যমিক দেওয়া হয়ে গেলেই কিনে দেবে, নয়ত পড়াশোনার খুব ক্ষতি হবে।

এবছর এমন এক মহামারী এলো যে টিকলির বাবা ঘরে বন্দী হয়ে পড়লেন। বড়বাজার থেকে ছোটখাটো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এনে তার ছোট্ট মফস্বলের বাড়ি লাগোয়া দোকানে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। দুই মেয়ে তার বড় মেয়ে ঝিমলি আর ছোট টিকলি। তারা স্বামী স্ত্রী যতই কষ্ট করে সংসার চালাক না কেন, মেয়েদের ভালো স্কুলেই পড়াতেন। টিকলির পরীক্ষার পরেই লকডাউন হয়ে গেলো তার দিদির কলেজ বন্ধ। দিদির তাও মোবাইল আছে কিন্তু টিকলির? তার তো সময় কাটেনা কিছুতেই। অনেক কান্নাকাটি করে বাবার কাছ থেকে কথা আদায় করেছে এই ক্রিসমাসে ফোন সে পাবেই পাবে।

মাস চারেক বাড়ি বসে টিকলির বাবা রাজু বিশ্বাসের জমানো টাকা শেষ প্রায়। এদিকে ছোট মেয়েকে কথা দিয়েছেন মোবাইল কিনে দেবেনই। রাজুবাবুর এক বন্ধু তাকে একটা কাজের প্রস্তাব দেয়, কিছু না ভেবেই উনি রাজি হয়ে যান। সংসারটা তার নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে ভীষণ ভাবে। মেয়েদের মুখে নিরামিষ ছাড়া কিছুই খেতে দিতে পারছেন না। বড়মেয়ে সব বোঝে কিন্তু ছোটজন কিছুতেই বুঝতে চায়না। রোজ খেতে বসে চিৎকার শুরু করে। রাজুবাবুর মন ভারাক্রান্ত হয়, কিন্তু তিনিও নিরুপায়। তাই কাজ পেয়ে উনি আর কিছু ভাবেন না।

রোজ ভোরবেলা বেরিয়ে যান সন্ধ্যের মধ্যে ফেরেন। এখন মাছ মাংস না হোক একবেলা ডিম অন্তত মেয়েদের মুখে তুলে দিতে পারছেন। একদিন দু প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে আসেন, বলেন তার বসের ছেলের জন্মদিন তাই অফিসের সবাইকে দিয়েছেন। দুই বোন খুব খুশি। লকডাউন ধীরে ধীরে উঠে যায়। তবুও মানুষের মধ্যে মৃত্যু ভয়টা চেপে বসে থাকে। রাজুবাবু তাই কলকাতায় আসার ঝুঁকি নেন না কিছুতেই।

টিকলি পেয়ে যায় ক্রিসমাসে তার মোবাইল ফোন। দারুণ খুশি সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে। দুদিন পর টিকলি বাবাকে বলে তার এক বন্ধুর বাড়িতে যায় মোবাইলটা দেখাতে। অনেক মাস বন্ধুদের সাথে দেখা নেই। টিকলির বন্ধু পর্নারা খুব বড়লোক তার বাবা বড় অফিসার মানুষ।

অনেকদিন পর টিকলিকে কাছে পেয়ে পর্না দারুণ খুশি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে পর্না তার বাবার কাছে আদবার করে যে তারা দুই বন্ধু একটু গাড়ি করে আরেক বন্ধু তিয়াসার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে চায়, তার সাথেও অনেকদিন দেখা হয়না। ফেরার পথে টিকলিকে বাড়িতে নামিয়ে চলে আসবে। পর্নার মা ঝিমলির জন্যেও অনেক খাওয়ার প্যাক করে দেন। আর তাকেও নিয়ে আসতে বলেন। দুই বন্ধু গিয়ে গাড়িতে বসে, দুমিনিটের মধ্যেই পর্নার ড্রাইভারকাকু দুপুরের খাওয়ার খেয়েই গাড়িতে এসে বসে এবং বসেই চমকে যায়।

টিকলির মুখ রক্তশূণ্য। সে পর্নাকে বলে,' পর্না আজ থাক তিয়াসার বাড়ি অন্য আরেকদিন যাবো। আমার শরীরটা হঠাৎই খারাপ লাগছে।' পর্না কিছু বোঝার আগেই টিকলি গাড়ি থেকে নেমে হন হন করে হাঁটা

দেয়। পিছন থেকে পর্না ডাকে 'টিকলি,ঝিমলিদির খাওয়ারটা নিয়ে যা।' টিকলি ততক্ষণে বেশ অনেকটা পথ চলে গেছে। পর্না হা করে তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখে সে একটা টোটোয় উঠে গেছে।

টিকলি বাড়ি ফিরে মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। সেভাবেই কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। তার মা আর দিদি কিছুই বুঝতে পারেনা। কি এমন হয়ে গেলো মেয়েটা সকালে হাসতে হাসতে বন্ধুর বাড়ি গেলো। ঝিমলি ফোন করে পর্নাকে কি হয়েছে জানতে চেয়ে। পর্না বলে সে নিজেই কিছু বুঝতে পারেনি সারাদিন তো হইহই করল খাওয়ার পর তিয়াসার বাড়ি যাবে বলে গাড়িতে উঠেই শরীর খারাপ লাগছে বলে বাড়ি চলে গেলো।

সেদিন বিকালে রাজুবাবু একটু তাড়াতাড়িই ফিরে আসেন, অন্যদিন একবার চার্চে ঘুরে তারপর ফেরেন। আজ যখন বাড়ি ফেরেন তার মুখটাও শুকনো লাগে বড্ড। উনি বাড়ি ফেরা মাত্র টিকলি ছুট্টে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে আর মোবাইলটা ফেরত দিয়ে বলে 'বাপি আমি আর কোনদিন এত দামী উপহার চাইব না তোমার কাছে। আমি খুব অন্যায় করেছি। তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। আমি আর মাছ মাংসের জন্যেও জেদ করব না গড প্রমিস।' ঝিমলি আর তার মা কিছুই বুঝতে পারেনা কি হল মেয়েটার!!

রাজুবাবু কথা দেন যে কাল থেকে উনি আর পর্নার বাবার গাড়ি চালাবেন না। যেমন করেই হোক নিজের দোকানটা আবার খুলবেন। তারপর উনি বাড়ির সবাইকে ঘটনাটা খুলে বলেন। এতদিন অর্থের অভাবেই তিনি ড্রাইভারের কাজ করেছেন, যদিও তার চোখে কোন কাজই ছোট নয়। সবাইকে যাতে অভুক্ত না থাকতে হয় তাই তিনি কাজটা করছিলেন। আর টিকলির জন্য মোবাইলটা কেনার টাকাটাও তাকে জোগাড় করতে হত। কিন্তু টিকলি যে তার বাবার কষ্টটা বুঝেছে এটাই তার কাছে ক্রিসমাসের রিটার্ন গিফট। পরেরদিন থেকে আর রাজুবাবু গাড়ি চালাতে যাননি। তার দুই মেয়েই এখন অভাবকে মানিয়ে চলতে শিখে গেছে।

 

 


 

1 টি মন্তব্য:

  1. প্রিয় কবি,অন্যমনে সাহিত্য বড়দিন সংখ্যায় আপনাকে পেয়ে গর্বিত ও আশান্বিত । আমরা আপনাকে শুভকামনা ও শুভেচ্ছা জানাই।

    উত্তরমুছুন