সে অনেক দিন আগের কথা। কোন ছোটবেলার কথা। নামটা মনে নেই। আমরা উনাকে বুড়ো দাদু বলে ডাকতাম। ভাদ্রমাস হলেই চলে আসতেন বাড়িতে নারকেল গাছ পরিস্কার করার জন্য। নারকেল গাছ যে ভাদ্র মাসেই পরিস্কার করতে হয়। আমার ঠাকুমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিতেন কোন গাছের কোন ডালটা কাটতে হবে, আর কোন গাছের কোন কোন নারকেলের কাঁদি পাড়তে হবে। নারকেল পাড়া হয়ে গেলে ঠাকুমা বেছে বেছে ঝুনো নারকেলগুলি আলাদা করতেন। নারকেলগুলি দিয়ে পূজার জন্য আর বিজয়াদশমীর জন্য নাড়ু , তক্তি এইসব বানানো হবে , আর গাছের ডালগুলি শুখিয়ে নিয়ে ঝাঁটা বানানো হবে। দেখতে দেখতে পূজা এসে যেত। ঠাকুরঘরে বসে একটা পরিস্কার খবরের কাগজ পেতে ঠাকুমা নারকেল কুড়োতে বসতেন। একদিকে কুড়োনো হতো আর পশে একটা পিতলের স্টোভে , পেতলের কড়াইতে আখের গুড় জ্বাল দেওয়া চলতো। গুড় জ্বালের পর যখন গুড়গুলি নরম হয়ে গলে যেত তখন ঠাকুমা আগের থেকে কোঁড়া নারকেল ঢেলে দিতেন। একসাথে নারকেল ও গুড় জ্বাল চলত। একটুপরে একটা পিতলের গামলায় সমস্ত কিছু ঢেলে দেওয়া হতো। আমরা মানে ছোটোরা উঠানে খেলতে খেলতেই ঠাকুমার কাছে ছুটে ছুটে চলে যেতাম আর ছোট ছোট হাত বাড়িয়ে বলতাম "ও ঠাম্মা আমাকে একটু নাড়ু দাও না। " ঠাকুমা একটু হেসে বলতেন " আরে ছেমড়া, এই সবে উনুন থেকে নামিয়েছি। একটু সবুর কর। " এরপর ফুঁ দিয়ে হাওয়া দিতে দিতে একটুখানি নারকেল-গুড় গোল করে আমাদের হাতে তুলে দিতেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই চলতো ঠাকুমার কাছে এসে হাত পেতে দাঁড়ানো , আর অনুনয় করা, " ও ঠাম্মা একটা নাড়ু দাও না। " আর ঠাকুমাও দেখিয়ে বলতেন , " অনেক হয়েছে। এরপর পেট খারাপ করবে। দশমীর আগেই সব নাড়ু শেষ করে ফেলবি। " অবশ্য দশমীর অনেক আগেই সব নাড়ু শেষ হয়ে যেত। ঠাকুমা আবার নাড়ু করতে বসতেন। সাথে সাথে গান ধরতেন " রাই জাগো জাগো বলে সুখসারী ডাকে। "
তখনও শহরে বাড়ি বাড়ি রান্নার গ্যাস আসেনি। রান্নার জন্য মাটির উনানই ভরসা। সেই সময় দুপুরের দিকে রোজ হাঁক দিয়ে যেত মাটিউলিরা। কোথা থেকে এরা এঁটেল মাটি নিয়ে আসত আর সেই মাটি লাগত উনুন লেপার কাজে। মাটি লেবে গো , মাটি লেবে গো বলে নিঝুম দুপুরে তাদের সুর করে ডাক দিয়ে যাওয়া এখনও চোখে ভাসে। একজনের সাথে ঠাকুমার ভালো পরিচয় ছিল। ঠাকুমা উনার সাথে অনর্গল দেশোয়ালী ভাষায় কথা বলতেন। দুর্গা পূজার পর পরই বিজয়া দশমী করতে এসে সেই মাটিউলি দিদা একঝুড়ি মাটি নিয়ে এসে ঠাকুমাকে প্রণাম করে বলতেন দিদি এই মাটিগুলো অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি। প্রদীপ বানালে পরে আর ছাড়বে না।ঠাকুমা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন , এই কথা তুই প্রতিবারই বলিস , আর প্রতিবারই বানানোর সময় প্রদীপ ভেঙ্গে যায়।ঠিক লক্ষ্মীপূজার পর থেকেই ঠাকুমার প্রদীপ বানানোর আয়োজন শুরু হতো। কালী পূজার আগের দিন মানে ভুতচতুর্দশীর দিন চোদ্দ প্রদীপ লাগবে যে। মাটির তালে জল দিয়ে তারপর কিছুটা মাটি হাতে নিযে , হাতের তালুতে চাপ দিয়ে দিয়ে এক এক করে চোদ্দটা প্রদীপ বানাতেন। এক এক করে সব প্রদীপ একটা পিতলের থালায় রেখে উঠোনে রোদে শুকাতে দিতেন। ঠাকুমা যখন প্রদীপ বানাতেন তখন আমরা বলতাম ও ঠাম্মা আমার জন্য একটা ছোট দেখে বানিয়ে দাও না। ঠাকুমাও প্রশ্রয়ের হেসে আমাদের জন্য ছোট ছোট কয়েকটা প্রদীপ বানিয়ে দিতেন। তারপর মা সলতে পাকাতে বসতেন। কার্তিক অমাবস্যার আগেরদিন রাতে মা ওই প্রদীপগুলিতে সলতে বসিয়ে ছোটদের হাতে দিয়ে বলতেন বাড়ির কোনায় কোনায় দিয়ে আসতে। নিজে তুলসীতলায় প্রণাম করে জ্বালিয়ে দিতেন আকাশ প্রদীপ।
যাঁরা একদিন ছিল আজ নেই সেই পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে আলোকিত শ্রদ্ধায় অন্ধকার সরে সরে যায় মাটির প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয়। মা আর ঠাকুমা তুলসীতলায় গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম জানান সেই পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশে , যারা আজ আর নেই। আকাশের তারা হয়ে গেছেন। যাদের জন্য আমরা আজ এই পৃথিবীতে এসেছি। প্রণাম জানিয়ে প্রার্থনা করেন , এই বংশের জ্ঞানগরীমা যেন মনুষত্বের আলোকধারায় আলোকিত হয়ে উঠে।
মা একটা কথা প্রায় বলতেন - মহালয়ার অমাবস্যায় আমরা পিতৃ তর্পন করে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বর্গলোক থেকে আমাদের পৃথিবীতে ডেকে আনি। একমাস তাঁরা আমাদের সাথে, আমাদের আশেপাশে থাকেন। আমরা তাঁদের দেখতে পাইনা। কিন্তু তাঁরা আমাদের দেখতে পান। আমাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হন। আবার একমাস পরে কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন তাঁরা ফিরে যান তাঁদের আসল বাসস্থানে, দেবলোকে বা স্বর্গলোকে। তাঁদের যাবার পথ যাতে সুগম হয় , এজন্যই আমরা চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি। আর পুরো কার্তিক মাস ধরে আমরা আকাশ প্রদীপ জ্বালাই যাতে তাঁরা উপর থেকে দেখতে পান আমরা তাঁদের ভুলি নাই। তাঁদের মনে রেখেছি। তাঁদের রেখে যাওয়া আলোকিত পথেই আমরা এগিয়ে যাব আগামী দিনগুলিতে।
সেই ছোটরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাটির প্রদীপ বানানোর লোক আর নেই। এমনকি বাজার থেকে তৈরী প্রদীপ কিনে এনে সলতে দিয়ে , তেল ঢেলে প্রদীপ সাজিয়ে দেওয়ারও সময় ও লোকের অভাব। তবু কিনে আনা মোমবাতি আর টুনি লাইটের আলোই তারা আকাশপানে দেখায়। আকাশের দিকে আলোকিত করে তারা খুঁজে বেড়ায় তাদের পূর্ব পুরুষকে - তাদের ঠাম্মা , মা , বাবাকে - যারা এখন আকাশের তারা হয়ে আছেন।
প্রিয় কবি,অন্যমনে সাহিত্য বড়দিন সংখ্যায় আপনাকে পেয়ে গর্বিত ও আশান্বিত । আমরা আপনাকে শুভকামনা ও শুভেচ্ছা জানাই।
উত্তরমুছুন