হলুদ পাখি
===============================
সুজাতা দে
===============================
ক্লাস ফোরের বলাকা আজ একবুক আশা নিয়ে ঠামির ঘরে বসেছিল। সপ্তমীর ভোরে তার চার পিসি বাপের বাড়িতে এসেছে। আটমাস আগেই বাবার কারখানাটা লক আউট হয়ে গেছে। পূজোতে একটাও নতুন জামা হয়নি এবারে। মা বলেছিল দেখিস পিসিরা কেউ তোর জন্য ঠিক নতুন জামা নিয়ে আসবে। নিয়ে আসেনি। বলাকার বিধবা ঠামিকে সবাই কাপড় দিতে এসেছে। মাসি মামারা মিলিয়ে তুলতুলিদির চারটে জামা হয়েছে। সেগুলো ঠামির ঘরে দেখাচ্ছিল পিসিদের। তুলতুলি বলাকার জ্যেঠার মেয়ে। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে বলাকা নতুন জামাগুলোর গন্ধ নিচ্ছিল। ছোটোপিসি ডাকল, কিরে বালু তোর নতুন জামা কিনিস নি?বলাকা মাথাটা নেড়েই এক দৌড়ে গিয়ে নিজেদের ভাঙা টালির ঘরের আলনার পিছনে লুকিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো মুছে নিল। এখন সবার সামনে কান্না চাপতে শিখেছে বলাকা। মা ও তো পিঁয়াজ কাটতে গিয়ে বারবার আঁচলে চোখ মুছছিল। মা আসলে লুকিয়ে কাঁদছিল; পিসিদের জন্য রান্নার ব্যস্ততার ফাঁকে। বলাকা বোঝে ওটা অসহায়তার কান্না। মায়ের ছেঁড়া ফাটা তালিমারা শাড়ি ব্লাউজ। মাকেও কেঊ একটা কাপড় কিনে দেয়নি। বড়োলোক পিসিরা আর জ্যেঠিমা ঠাকুর দেখতে যাবার প্ল্যান বানাচ্ছে। মাকে কেউ ডাকছে না।
আজ অষ্টমীর সকাল। দুটো চালভাজা আর চা খেয়ে প্রতিদিনের মতো বলাকার বাবা কাজের খোঁজে কোন ভোরে বেরিয়ে গেছে। পিসিরা কালই হুল্লোড় করে খেয়েদেয়ে ঠাকুর দেখে যে যার বাড়ি চলে গেছে। একটু আগে তুলতুলিদিরাও মামারবাড়ি চলে গেছে। যাবার আগে তুলতুলিদি বলে গেল ওর আরো চারটে নতুন জামা হয়েছে। কে দিয়েছে বললো না। মন খারাপ নিয়ে দাওয়ায় বসে ছিল বলাকা। ঢাকের আওয়াজ,কাশফুল সব কেমন ম্লান শোকের ঘন্টা বাজিয়ে ব্যাঙ্গ করছে বলাকাকে। বাবার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন জামা চায়নি এবারে। গতকাল জ্যেঠুর আনা খাসির মাংসের সব থেকে ছোটো একটা টুকরো পড়েছিল বলাকার পাতে। বাবা তো দিনের বেলা খেতেই আসেনা। মায়ের ভাগে দুটো আলু আর ঝোল জুটেছে। সব দেখেছে বলাকা। পিসিদের আনা মিষ্টির আধখানা টুকরো দিয়েছে জ্যেঠিমা। মা বলে গরীবদের কিছু চাইতে নেই। যা জোটে তাই খুশী হয়ে মেনে নিতে হয়। মামারবাড়িতে দাদু দিদা আর এক মামা ছাড়া কেউ নেই বলাকার। মা পালিয়ে বিয়ে করেছিল তার গরীব বাবাকে তাই মামারবাড়ির পথ ও বন্ধ।
কলোনিতে পাশের বাড়ির তারা মাসির ডাকে চমক ভাঙে বলাকার। লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে তারা মাসি। ছেলেপুলে নেই,তাই বলাকাকে খুব ভালোবাসে।
ও ছোটো বউ কোথায় গেলে মা? বচ্ছরকার দিন মেয়েটারে শুকনো মুখে বসিয়ে রেখেছ কেন গা? আয় মা আয়, এই জামাখান পরে দেকা দেখি কেমন মানিয়েছে। আঁচলের ফাঁক থেকে হলুদ রঙের জামাটা বার করে পরিয়ে দেয় তারামাসি। ঝলমলে মুখে জামাটা পরেই তারামাসির গালে একটা হামি এঁকে দেয় বলাকা। মা রান্না ফেলে উঠে এসেছে। হাসিমুখে চোখের জল মুছে বলে আবার এসব এনেছে কেন তারাদিদি?
তারামাসি ধমক দেয় তুমি থামো তো ছোটো বউ; মেয়েটা কি তোমার একার,আমার নয়! তারামাসির চোখেও জল। এরা আনন্দের দিনে এতো কাঁদে কেন কে জানে! ছোট্ট বলাকার আনন্দ আর ধরে না। মায়ের কাঁচভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে বলাকা। খুশিতে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেনা আর।
হলুদ পাখির গল্প বলেছিল ইস্কুলের দিদিমণি। আয়নাতে একটা হলুদ পাখিকে দেখতে পাচ্ছে বলাকা।
ঠামি বলে হলুদ রঙ নাকি লাকি। এবার থেকে অনেক পড়াশোনা করবে বলাকা। বড়ো হয়ে অনেক বড়ো চাকরি করবে। সবার আগে তারামাসিকে আর মাকে হলুদ কাপড় কিনে দেবে পূজোর দিনে। তারপর সব্বাইকে। হ্যাঁ ঠামি জ্যেঠিমা, পিসিদের ও দেবে। ওরা বলাকাকে নাইবা দিক। রূপকথার হলুদ পাখি তো সব্বাইকে দেয়। হলুদ পাখির মতো বড়ো মনটা পেয়ে গেছে তো বলাকা। ও যে এখন থেকে সবার সব স্বপ্ন পূরণের হলুদ পাখি।
দুরের ঢাকের আওয়াজটা তালে তালে এগিয়ে আসছে বলাকার দিকে। আনন্দে কাশফুলগুলো বাতাসে দুলে দুলে উঠে যেন নাচ করছে। আজ যে শুভ মহাঅষ্টমী। আজ আরো একটা নতুন হলুদ পাখির জন্ম হলো যে...।
প্রিয় কবি,অন্যমনে সাহিত্য বড়দিন সংখ্যায় আপনাকে পেয়ে গর্বিত ও আশান্বিত । আমরা আপনাকে শুভকামনা ও শুভেচ্ছা জানাই।
উত্তরমুছুন