অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১

গল্পে বারিদ বরন গুপ্ত


  

 

এক টুকরো রুটির কান্না
===================


আজ যখন বর্ষা নেমে আসে, শ্রাবণের অঝোর ধারায় মাঠ ঘাট নদী-নালা থই থই করে, তখন কেন জানিনা দাউদ দার কথা বারে বারে মনে পড়ে যায়, আর মনে ঢেউ খেলে যায় তার কান্না, পেটের জন্য, এক টুকরো রুটির জন্য, জীবনধারণের একটু অক্সিজেনের জন্য। তখনকার দিনে ভাদর মাস গ্রামবাংলার মানুষের কাছে যেন আতঙ্ক, কথায় আছে ভাদরে উদরের জ্বালা, কখনো আধপেটা, কখনো গোটা পেটা উপোস গেছে গ্রাম বাংলা, কারণ ভাদোর মাসে ঘরে খাবার শেষ হয়ে যেত, আশ্বিন-কার্তিক মাসে নতুন ধান উঠলে,ঘরে আবার খাবার ঢুকতো। আজ এই বর্ষণমুখর দিনে সেই দাউদ দার অসহায় মুখটা বারবার মনে পড়ছে, আর ভেসে আসছে একটু রুটির জন্য কান্না।



সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৭০ দশকের এক সকাল, ভাদ্র মাস, মাঠে ধানের গোছ একটু একটু করে সবুজ হচ্ছে, দুদিন ধরে প্রবল বর্ষণ চলছে, মাঝে মাঝে আকাশ কাপিয়ে বিদ্যুতের গুরুগম্ভীর আওয়াজ, তার সাথে আলোর ঝলকানি, কেউ বাড়ির বাইরে বেরোনোর সাহস পাচ্ছে না, বলতে গেলে সবাই প্রায় গৃহবন্দী। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ স্তুপাকার মাঠ পেরিয়ে জীবনকে হাতে নিয়ে দাউদ দা এসে হাজির আমাদের বাড়িতে। বুঝতে অসুবিধা হলো না ক্ষুধার জ্বালায় দুর্যোগ কে উপেক্ষা করে ভয়-আতঙ্ক কে হারিয়ে সকাল হতে না হতেই বেড়িয়ে পড়েছে জীবন বাঁচানোর তাগিদে।



দাউদ দাকে দেখেই বাবা চেল্লিয়ে উঠলো-'তোর মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? দেখছিস জমির আল দেখা যাচ্ছে না, বলি কি কাজ হবে? তাছাড়া হাতে টাকা কড়ি একদম নেই, এখন কাজ করাতে পারবো না।' তখন দাউদ দা বাবার পায়ে এসে পড়লো-'কাকা তোমাকে পয়সা দিতে হবে না, একটুকরো রুটি দিলেই হবে,দুদিন খেতে পাইনি, ছেলেগুলোর কান্না আর দেখতে পাচ্ছিনা, আমাকে এক টুকরো রুটি দিয়ে বাঁচাও!' এই বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলো। মা ঘরেই ছিল, দাউদ দার কান্নার আওয়াজ শুনে বাবাকে বললো-'কোন মুখে বকছো? শুনছো দুদিন খেতে পায় নি, ছেলেগুলো না খেতে পেয়ে কাঁদছে! হ্যাঁ তুমি বসো দাউদ আমি রুটি তৈরি করি, তুমি ছেলেপিলের জন্য রুটি বাড়ি নিয়ে যাবে।' মায়ের এই কথা শুনে দাউদ দা জানে প্রাণ ফিরে পেল, ছুটে গিয়ে মড়াই তলা থেকে কোদাল নিয়ে সোজা মাঠে!



আমার মায়ের মনটা খুব উদার, মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে সহ্য করতে পারতেন না, দেখেছি অনেক সময় নিজের বরাদ্দ খাবার দীন দুঃখীদের বিলিয়ে দিয়েছেন, বাবকে না জানিয়ে লুকিয়ে অনেক গরিব মানুষকে চাল-ডাল এটা ওটা দিয়ে সাহায্য করেছেন, একথা আজও গ্রামের অনেক মানুষ স্বীকার করে, এই নিয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতে দেখেছি।



এদিকে মায়ের রুটি তরকারি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে মা এসে দেখে দাউদ দা নেই। বাবা বললো-'সে তো মাঠে চলে গেছে!'সঙ্গে সঙ্গে লেগে গেল বাবার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া।

'দেখছো এই দুর্যোগে লোক বাড়ি থেকে বেরোতে পারছিনা, আর তুমি ওকে পাঠিয়ে দিলে মাঠে!'বাবা বলল-'আমি কি তাকে মাঠে যেতে বলেছি! সেতো ছুটে মাঠে চলে গেল, ঠিক আছে, আমি ডেকে নিয়ে আসছি!'



বাবা রেগে-মেগে মাঠে যেতে উদ্যত হয়েছেন, তখন আমি বাবাকে বললাম -'তুমি বস,আমি যাচ্ছি।'মাঠে গিয়ে দেখলাম গোটা মাঠ সমান হয়ে গেছে, জমি চেনা যাচ্ছে না, মাঠ না সমুদ্র! চারিদিকে জল আর জল, ডাঙার চিহ্নমাত্র নেই, তারি মাঝে থেমে থেমে বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলকানি! আর এই দুর্যোগে জলের তোর কে উপেক্ষা করে কোনরকমে শরীরটাকে জমির মধ্যে রেখে ঘাস তোলার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে দাউদ দা। দূর থেকে আমার হাঁকানিতে হুশ ফিরল তার।



সেদিন দাউদ দা কি দেখে বুঝেছিলাম এক টুকরো রুটি কত দামী! সত্যিই এই স্তুপাকার জলরাশিতে কাজ করা যায় না, এই দুর্যোগ কে উপেক্ষা করে তারাই কাজ করে যাদের জীবন ধারণের শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে যায়! সত্যিই পেটের তাগিদ বড় তাগিদ, পেট কিছুই মানে না, ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে আর কিছুই মনে হয় পৃথিবীতে বেশি নয়! তাই জীবনের বিনিময়ে জীবনটাকে বাঁচানোর তাগিদে দাউদ দা আজ মাঠে এসে পড়েছে!



যাই হোক দাউদ দা কে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, মা আগে থেকেই তার বরাদ্দ খাবার প্রস্তুত করে রেখেছেন। মাকে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে ছেলে বউ দের জন্য খাবার গামছায় বেঁধে নিয়ে দাউদ দা মহানন্দে এক টুকরো রুটি চিবুতে চিবুতে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে, বর্ষণমুখর শ্রাবণে, দাউদ দার কথায় বারে বারে উঠে আসছে, আর ভেসে আসছে একটুকরো রুটি জন্য কান্না।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন