একটি হনুমানের কথা
=================
রথীন্দ্রনাথ রায়
=================
ছেলেটা প্রতিদিন হনুমান সাজে ।
সারা শরীরে পলিথিন বস্তার সরু সরু সুতোগুলো বাঁধা । বাঁধা বলতে জামা বা প্যাণ্টের সঙ্গে সেলাই করা । আশ্চর্য এক শিল্পিত দক্ষতায় প্রকৃত হনুমানের মতোই সাজে ছেলেটা। মুখে কালি মাখানো। এমনকি মাঝে মধ্যেই হনুমানের মতোই শব্দ করে। মুখ ভ্যাঙচায় ।
আসানসোল বর্ধমান লোকাল ট্রেনের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত হনুমানের মতোই কখনো চারপায়ে কখনো দুপায়ে চলাফেরা করে । বাচ্চাদের ভয় দেখায় , বড়দের হাসাতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ হাসে। আবার কেউ কেউ তার লেজ টেনে ধরে। কখনো কখনো ওর লেজে আগুন ধরিয়ে দিতে চায় ওরা। কাঁদতে থাকে হনুমান। লোকেরা খুব মজা পায়। বিনিময়ে পয়সা পায় ছেলেটা। কোনো দিন তিরিশ টাকা অথবা চল্লিশ টাকা। আবার কোনো দিন আরো বেশি।
হনুমান সাজার আগে সে রেলের কামরা ঝাঁট দিত । তাতে বেশ রোজগার হতো। কিন্তু একবার একবাবু পয়সা না দিয়ে ঝাঁটার কয়েকটা কাঠি ভেঙে নিয়েছিল । তারপর কাঠি গুলো সোজা বিঁধিয়ে দিয়েছিল ওর শরীরে। লোকটা খুব মজা পেয়েছিল। কিন্তু যণ্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠেছিল ছেলেটা। রক্ত বের হতে দেখে সেই লোকটা চোখদুটোকে বড়বড় করে বলেছিল, তোর শরীরে তো অনেক রক্ত । না, তারপর থেকে সেটার ঝাঁটা ধরেনি। তখন থেকে সে শুধুই হনুমান। মতলবটা দিয়েছিল ফড়িং। সে বর্ধমান হাওড়া কর্ডলাইনের হনুমান। তাছাড়া সে এলাইনে বেশ অভিজ্ঞ। গুরুজী বলা যেতে পারে। একটা বিড়ি ধরিয়ে ভারিক্কিচালে সে বলেছিল, শালার পাবলিক আজকাল আর এমনি এমনি পয়সা দেয় না।
ওর যাকিছু রোজগার সব ওর মা নিয়ে নেয়। এরজন্য সে অনেক পয়সা লুকিয়ে রাখে রেলগূমটির পাশে একজায়গায় পাথর চাপা দিয়ে। লুকানো পয়সায় সে বিড়ি খায়, মদ ও খায় । ফড়িং বলে বাঁচতে হলে মরদের মতোই বাঁচতে হবে। বড়োসড়ো একটা স্বপ্ন ও দেখে সে। পাঁচ হাজার টাকা জমাতে পারলে ছোটোখাটো একটা চায়ের দোকান করবে সে।
হনুমান সেজে ভিক্ষে করার পেশাটা প্রায় বছরখানেকের পুরনো। রোজগার টাও মন্দ হয়না। বাপ নেতাই ডোম আগে রিকশা চালাতো। এখন নেশা করে পড়ে থাকে। রিকশা টাও কম চালায়। তার রোজগারের টাকা নিয়ে বাপ মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। শেষমেশ রোজগারের টাকা আধাআধি ভাগ হয় বাপ মায়ের মধ্যে। মায়ের ভাগে সে খায়। বাঁকার ধারে এক নোংরা বস্তিতে থাকে সে। বর্ষায় ঘরের মেঝেয় জল ঢোকে। তখন রেললাইনের ধারে একটা পরিত্যক্ত সিগন্যাল রুমে মা ছেলেতে সংসার পাতে। জিআরপির লোকেরা মাকে জ্বালাতন করে। মাঝে মাঝে জিআরপির লোকেদের খূশি করতে হয় মাকে। তার খুব রাগ হয়। স্বপ্ন দেখে অনেক টাকা রোজগার করে মাকে এখান থেকে , এই অন্ধকারের জীবন থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। মা তাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু এটা সহ্য করতে পারে না হারুকাকা।
হারুকাকা ট্রেনে জল বিক্রি করে। রাতে সূন্দরী মাসির ঠেকে যায় মদ খেতে।আর জুয়া খেলতে। কি বিচ্ছিরি ওর চেহারা আর সেই সঙ্গে কথাবার্তাও মানানসই।
সেই হারুকাকা একদিন স্টেশনের ছাতিম গাছটার নীচে ফিসফিস করে মাকে বলছিল, চল আমরা পালিয়ে যাই। আসানসোলের রেলবস্তিতে থাকার ব্যবস্থা পাকা।
মা বলেছিল, না ও আগে বড়ো হোক।
হারুকাকা একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে রাগে গরগর করতে করতে চলে গিয়েছিল।
মা যদি সত্যিই চলে যায়?
একা একা থাকতে তার কষ্ট হবে। তবে সে ভয় পায় না। ফড়িং একা থাকে। সেও থাকবে।
হনুমানটা নাচ দেখাতে দেখাতে একেবারে মাঝের দিকের একটা কামরায় থেমেছিল। তারই বয়সী একটি মেয়ের কাছে সে এগিয়ে আসল। কিচিরমিচির করল , ভয় দেখালে। কিন্তু কি আশ্চর্য । মেয়েটি ভয় পেলনা । পরিবর্তে অল্প একটু হেসে বলল, এই হনূমান, তুমি পড়াশোনা করনা কেন?
হনুমানটা থমকে দাঁড়াল। তার মনে হলো কানের কাছে বুঝি ওই মেয়েটির কণ্ঠ বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পড়াশোনা করে বড় হওয়ার ইচ্ছে তার মধ্যেও ছিল। কিন্তু ওর বাপমা চেয়েছিল ও রোজগার করুক। তাই ওর শৈশবটাকে ওরা কেড়ে নিয়েছিল। ধরিয়ে দিয়েছিল ভিক্ষের ঝুলি। সেদিন রাতে বস্তির ভাঙা ঘরে ফিরে মাকে বলল, মা আমি পড়াশোনা করব।
মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, পড়াশোনা করবি তো হাঁড়ি চড়বে কি করে ?
পরদিন আবার তাকে হনুমানের পোশাক পড়তে হল। কাঁদতে কাঁদতে স্টেশনে আসল। সাড়ে নটার আসানসোল বর্ধমান ডাউনে চেপেই তার মনে হলো আজ বুঝি সে সেই মেয়েটির সামনে পড়ে যাবে। ভয় পাচ্ছিল সে। আবার কতকগুলো লোক তার লেজ নিয়ে টানাটানি শুরু করল। খুব রেগে গিয়ে এক ঝটকায় লেজটা ছাড়িয়ে নিল সে। ট্রেনটা সবেমাত্র চলতে শুরু করেছে। সেই অবস্থায় নামতে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে না পেরে হনূমানটা রেললাইনের ওপর পড়ে গেল। চার দিকের জনতা চিৎকার করে উঠল। ট্রেনটা যখন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল তখন সবাই দেখল একটা হনুমানের দ্বিখণ্ডিত দেহ। তার হাতে তখনো কয়েকটা খুচরো পয়সা। ঠোঁট দুটো বারকয়েক নড়ল। কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই মারা গেল সে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন