অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

গল্পে তপাশ্রী

  

 


জীবন আর জীবিকা
=========================
তপাশ্রী (তপা ব্যানার্জী)
=========================



......সকাল হতেই শুরু হয় জীবন আর জীবিকার লড়াই । বলি আর কতদিন চলবে এই লড়াই । মানুষের কোন নিশ্চয়তা নেই বুঝি । একে কাজকর্ম নেই তার ওপর রোগের জ্বালা । কত আর পারা যায় বাপু ! কারখানা বন্ধ ,ঘরের মানুষ কাজে যাচ্ছে না কতদিন হয়ে গেল ! আর ভালো লাগে না , ঘরে ভীষণ অভাব । মাঝে মধ্যে কোথায় যায় কে জানে ! ফিরে এসে কমলির হাতে গুঁজে দেয় কটা টাকা । তাই দিয়ে আর কটাদিন চলে তিনটে পেট । এদিকে ঘরে বুড়ি শাউড়ি মা যে জ্বরে পড়েছে , বলি সে খেয়াল আছে নাকী তার ছেলের ! ওষুধ আনতে হবে , সঙ্গে যে পথ্য দেবে তাও যে কোথা থেকে আসবে ! এই গরীবের সংসারে দুবেলা খাবার জোটাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে । নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তার ওপর ফল- ফলারী বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয় । এমন অনেক কথা কমলি রোজ সকাল হলেই আওড়াতে থাকে । তাতে তেমন কোন কাজ হয় বলে তো মনে হয় না । মিনশে সেই রোজকার মত দাওয়ায় বসে শোনে কিনা কে জানে , সময় হলেই বাইরে বেরিয়ে যায় । আবার দুপুরে ঘরে আসে ,খেতে দিলে দুটি খায় নইলে শুয়ে পড়ে ।

.......এই পাঁচ বছর হলো সংসার করছে দুজনে । ছেলেপিলে নেই বলে তেমন কোন অভিযোগ নেই । অভাবের সংসারে মনে হয় বাড়তি খরচা হবে তাই ভেবে চুপ থাকা । নইলে কেউ এমন করে থাকে বলে মনে হয় না । যাক একদিকে স্বস্তি বৌটার বয়স কম তাই সময় আছে । কমলির রোগা পাতলা চেহারা , দেখতে শুনতে মন্দ নয় । শাড়ি পরলে বেশ লাগে কিন্তু ,তা মিনশের চোখে পরলে তো হয় । সে সব দেখার সময় আছে না ইচ্ছে আছে । অভাবে সব গেছে । দুটো ভালো কথা কইবে তাও সময় হয় না , একটা তো টালির ঘর আর দাওয়া । সকাল থেকে দাওয়ায় রান্না- খাওয়া হতে রাত হয়ে যায় তখন শাউড়িকে শোবার বিছানা পেতে দেয় কমলি । তবে যদি ঘরটা একটু ফাঁকা হয় ,মনের দুটো কথা কইতে পারে দুজনে । আজকাল ভুবনের আর তেমন কোন কিছুতেই ইচ্ছে নেই । সেটা কমলি কিছুদিন আগে থেকেই বেশ বুঝতে পেরেছে । তবুও মুখে কিছু বলে না অশান্তির ভয়ে । রাত বেরোতে আবার ঝামেলা হবে , মুখ তো ভালো নয় ভুবনের । তার ওপর গালি দিলে পাশাপাশি বস্তির ঘর সবাই শুনে নেবে এই ভয়ে চুপ করে থাকে । তবে কতদিন সেটা সম্ভব । একটু ভালো কথা শোনা , সোহাগ এসব তো সব মেয়েমানুষ স্বামীর থেকে আশা করে নাকী । এমন কী বয়স হয়েছে কমলির , তার ওপর ছেলেপুলে হয় নি উঠতি বয়স এখন যেন আরও সুন্দর লাগে । শরীরে একটা জেল্লা দিচ্ছে দিনে দিনে ,তবু নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই সংসারে ।

......রাগের চোটে একদিন তো বলেই ফেলেছিল , আমি চলে যাবো যেদিকে দুচোখ যায় । সঙ্গে সঙ্গে মিনশে বলে উঠলো ,"কোথায় যাবি , তোর কোন নাগরের কাছে বুঝি !" ভালো হচ্ছে না কিন্তু এসব কথা কইবে না । "একদম বাজে কথা কইবে না বুঝলে, লজ্জা করে না পেটে ভাত দিতে পারো না বৌকে ,সখ করে বিয়ে করতে গিয়ে ছিলে কেন বাপু ! তোমায় কি কেউ দিব্যি দিয়েছিল নাকী ! যে রোজগার না করলেও বিয়ে করে সংসার পাততে হবে ! জেনে বুঝে আমার এমন ক্ষতিটা কেন করলে বলতে পারো !" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে কমলি মনের ঝাল মেটালো বটে । ভুবন অমনি ছেড়ে দেবার পাত্র নয় , বলে উঠলো "তাই বুঝি , আমি বুঝি একাই বিয়ে করেছি ! তুই এলি কেন আমার কাছে ! যা চলে যা এখন ! আমার সংসার করতে হবে না তোকে ।" এই বলে সেই রাতে খুব ঝামেলা বাঁধলো দুজনের । শাউড়ি গিয়ে মিটমাট করে দেয় শেষে । তবে ঝামেলার কি আর শেষ আছে পরদিন আবার যে কে সেই ! কটাদিন দুজনে কথা না কইলে কি হবে , অভাবের তাড়নায় ঝগড়া বাঁধে বেশ মাঝে মধ্যে । সাধ করে কি আর কথা কইতে হয় ।

.......মাঝে মাঝে কত কি যে ভাবে কমলি । বাপের ঘরে যাবে সেখানেও অভাব । ছোট ভাইবোন নিয়ে বাপ ছাড়া মা কোনমতে সংসার চালায় । ওখানে গেলে বাড়তি ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না । নিজে যদি কিছু করতে পারে তবেই শান্তি , এভাবে ঘরে বসে আর কতদিন থাকবে ! এদিকে ঘরের মরদ রাজী নয় যে , সুন্দরী যুবতী বৌ বাইরে বেরোলে খারাপ সঙ্গে পড়ে যায় যদি ! সেই ভাবনায় ঘরবন্দি করে রেখেছে কমলিকে । নিজের সখ- আহ্লাদ বলে কি কিছুই থাকতে নেই নাকী ! ভাবে আর মনে মনে হাসে ! হায় রে বিধি , কি তামাশা দেখালে, পেট ভরা ভাত জোটে না , তার ওপর সখের কথা মুখে আসে কোথা থেকে ! এসব ভাবাও যে পাপ ! এক সময় নিজের ওপর ভারী রাগ হয় কমলির, ভাবে কেন যে এই পোড়ার কপাল নিয়ে জন্মেছে ! কত সখ ছিল ঘর- বর ছেলেপুলে নিয়ে আনন্দে ভরা সংসার করবে । কোথায় সে সব , ভাবনায় বুঝি জল ঢেলে দিয়েছে ভগবান । কি পাপ করেছে কে জানে ! জ্ঞানে তো করে নি , হয়তো আর জন্মের কোন পাপের ফল পাচ্ছে এ জন্মে ! এ সব সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন রাতে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতেও পারে না ! ভোরে উঠে আবার সব ভুলে যায় । রাগ গলে জল হয়ে যায় মিনশের মুখের দিকে তাকিয়ে । মায়ায় পড়ে যায় তখনই কেমন যেন হয়ে যায় ! ভাবে এই বুঝি সংসার , তা না হলে এমন করে পড়ে থাকবে কেন এখানে ! কিসের বাঁধন ,এই কি তবে ভালোবাসা ! কি জানি , নিজের কাছে প্রশ্ন করে কোন উওর পায় না ।খানিক ভেবে আবার ঘরের কাজ শুরু করে ।

.........কত রাগ কত ঝগড়া সব এক মুহুর্তে উবে যায় , যদি একবার কমলি বলে স্বামী ডেকে ওঠে । তা নাহলে এতকটা বছর রয়েছে কিভাবে এর সঙ্গে ,সেটাও তো ভাবতে হবে না । একটা বাঁধন তো আছেই নাহলে সংসার কয় কারে ! কমলি এত কষ্ট মেনেও পড়ে আছে কেন এখানে । মায়ার টান বলে বা ভালোবাসা যাই হোক কিছু একটা তো আছে বটেই ! সেদিন কি যে হলো সকাল হতেই খুব তাড়াহুড়ো লেগেছে । কোথায় যাবে যেন বলেছে ,ভালো বাজার করেছে । ফিরে এসে দুপুরে খাবে বলে গেল । অনেক দিন পর ঘরে মাছ এসেছে দেখে কমলি মন দিয়ে বেশ জমিয়ে রেঁধেছে । খেতে বসে শাউড়ি আরও দুটো ভাত চাইল , "বলল মাছের ঝালটা ভালো হয়েছে । জ্বরের পরে মুখে বেশ ভালো লাগছে ।" ভুবনও সেদিন পেট ভরে ভাত খেল । খাওয়া হতেই আবার চলে খেল । কমলি জানতে চাইলে বলল ,দূরে যাবে একটা কাজের সন্ধান পেয়েছে রাতে ফিরে সব জানাবে । এদিকে সন্ধ্যে হয়ে গেল ভুবন আজ ঘরে এলো না দেখে খুব চিন্তায় পরলো । শাউড়ি বললো," ঠিক আসবে , ভাবিস না বৌ । এমন রাত কিন্তু কখনও করে না ব্যাটা , তবে গেলো কোথায় ! তোমায় কিছু বলে নি বুঝি !" শুনে বলল ," না শুধু বলেছে একটু রাত হবে।"

......ভাবতে ভাবতে কখন যে ভোর হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না কমলি । এদিকে বেলা বাড়তেই বাড়িতে পুলিশ এলো ভুবনের খোঁজে। কানাঘুষো শোনা গেল ও নাকী মালগাড়ী থেকে কয়লা চুরি করেছে । আগেও করেছে কিনা এমন কিছু খবর জানতে ঘরে তল্লাশি চালাতে এসেছে ।প্রতিবেশীরা ঘর চিনিয়ে দিতে পুলিশ এসে ঘরের সব ওলোট- পালোট করে খুঁজতে লাগল । জিনিস বলতে দুটো টিনের ট্যাঙ্ক আর জামা কাপড়ের বাক্স কটাতে তেমন কিছুই পেল না । কোন টাকা - পয়সাও নেই যে চৌকির তলায় খুঁজে পাবে । কটা খুচরো টাকা ছাড়া ঘরে তেমন কিছুই নেই । কমলি আর শাউড়ি তো হতভম্ব হয়ে রইল । কিছুই বুঝতে পারছে না । ভুবন কেনই বা এসব করতে গেল আর কিই বা করেছে তাও বলতে পারছে না । অনেক খুঁজে কিছু না পেয়ে পুলিশ চলে গেল । পাশাপাশি সবাইকে জিজ্ঞাসা করেও ভুবনের নামে খারাপ কিছুই জানতে পারলো না । ইদানিং কাজকর্ম নেই বলে এসব করতে হয়েছে সেটাই বুঝল । নিজের বুদ্ধি নয় অন্যে বুদ্ধিতে করেছে বলে হাত পাকানোর সময় পায় নি সেটাও বুঝেছে । নইলে আর কাউকে ছাড়া পুলিশ ওকেই কেবল ধরতে পেরেছে কেন ! যাবার সময় বলে গেল থানায় কিছু টাকা লাগবে তবেই ছাড়া হবে ।

......এদিকে ঘরে অভাব তার ওপর থানার খরচা আসবে কোথা থেকে ভেবেই কমলির হাত- পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । শেষে পাশেই থাকে একজন মাসীমা ভুবনকে খুব ভালোবাসে সে বাড়িতে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছিল , সেই টাকা দিয়ে ওকে ছাড়াতে বলল । যদিও মাসীমাকে টাকাটা কমলি পড়ে শোধ দেবে কথা দিয়েছে। তেমন কোন প্রমাণ না পাওয়ায় পুলিশ এবারের মতো ছেড়ে দিল বটে । এর পরে আবার কিছু করলে সোজা ধরে কোর্টে চালান দেবে বলে দিল । কোর্ট কেসে ভালোই খরচা আছে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে তবেই জামিন পাবে এটাও জানা থাকে যেন নইলে জেল খাটতে হবে । সেদিন ঘরে ফিরে ভুবন যেন কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে থমকে গেল । এই কাজে যে পটু নয় তাই ধরা পড়তেই পুলিশ ভালোই বুঝতে পেরেছে ,নাহলে কি ছাড়া পায় এত তাড়াতাড়ি । কমলি এসব দেখে বেশ ভাবনায় পড়েছে স্বামীরে নিয়ে । ওর ভাবগতিক ভালো নয় সেটা ভালোই বুঝেছে । এখন ওকে অন্য কোন কাজে আটকে রাখতে হবে তবে যদি ভুবনকে ভালো রাখা যায় । এমন অনেক কথা শাউড়ির সঙ্গে আলোচনাও করেছে । কি কাজ করবে সেটাই ভেবে উঠতে পারছে না । ভুবনকে রাজী করানোটাই একটা ঝামেলা । ঘর থেকে মোটে বেরোতে চাইছে না , লজ্জা পেয়েছে । টাকার জন্য কাউর পাল্লায় পড়েই এমন কাজটা করতে রাজী হয়েছিল সেটা বলেছে । অসাধু কাজে পটু নয় বলেই সহজে ধরা পড়ে যায় । পুলিশের চোখে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয় । এখন কমলির যত চিন্তা ।

.......দু- চারদিন ভেবে একটা বুদ্ধি বার করলো কমলি ।পাশেই একটা খেলার মাঠ আর ছোট পার্ক মতো আছে যদিও সেটা বন্ধ । তবে সকাল বিকেল কিছু হলেও লোকজন আসে ।ওখানে যদি চা নিয়ে ভুবন ফেরি করে মন্দ হবে না । কিছু হলেও বিক্রি হবে এই ভেবে শুরু করলো । প্রথম প্রথম খুব বেশি না হলেও বিক্রি হলো কিছুটা । এরপর ঘুঘনি আলুর দম ঘর থেকে রেঁধে দিল কমলি , ভুবন সেগুলো নিয়ে বিক্রি করতে লাগল ঘুরে ঘুরে কখনও পার্কের পাশে নিয়ে বসে । দু- চারদিন কম করে হলেও লোকে খেয়ে মন্দ বলল না । কমলির হাতে জাদু আছে রান্নায় প্রশংসা পেয়ে ভুবন মনে মনে বেশ খুশি হলো । শাউড়িও বিকেল বেলা সব কেটে দিয়ে কমলিকে সাহায্য করে হাতে হাতে যতটা পারে । এইভাবে ওদের ব্যবসা ভালোই চলতে লাগল । ভুবন এখন বেশ মন খুলে কথা বলে । বিক্রি করে টাকা এনে দেয় কমলির হাতে । বাজার থেকে এনে দেয় রান্নার জিনিসপত্র । ওদের মধ্যে এখন আর ঝগড়া নেই অভাব কিছুটা মিটেছে । পেট ভরে খেতে পায় তিনজনে । একসঙ্গে খেটে কাজ করে । তবে মানুষ যে কেবল পণবন্দি হয়ে বা নিজেকে পণ্য ভেবে বিকিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না এটা এই দুজনে ভালোই বুঝেছে জীবন দিয়ে । জীবন যেমন আছে জীবিকাও আছে , তাকে অনুসন্ধান করতে সময় দিতে হবে । সব কিছুই শেষ হয় না । শেষ থেকেও শুরু হয় । একটু অক্ষরজ্ঞান জানা কমলি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে । জীবনের কাছে হেরে যায় নি ,নিজেকে বিকিয়েও দেয় নি । বাঁচার তাগিদে স্বামীকে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে পেরে কমলি আজ ধন্য মনে করে নিজেকে ।এইভাবে কষ্ট করেও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা যায় তা প্রমাণ করেছে এই দম্পতি । এখন দিনের শেষে শান্তিতে ছোট্ট ঘরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর বলে ঈশ্বর আছেন তাই তিনি মুখ তুলে চেয়েছেন আমাদের দিকে ।

 

 


 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন