সমাজ একটি নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠান:
প্রসঙ্গ দুর্নীতি
==========================
আজকাল দুর্নীতি কথাটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত হয়ে উঠেছে, অফিসে বাসে-ট্রেনে হাটে বাজারে যত প্রকারের আলোচনা হয় তার মধ্যে অবশ্যই দুর্নীতির কথাটা যেন উঠে আসবেই, কারণ কথাটা যেন বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণভাবে বলা যায় নিয়ম নীতিহীন কাজই হলো দুর্নীতি, দুর্নীতি আজ সমাজের প্রতিটি স্তরেই, যেন এটা স্থায়ী রূপ নিতে বসেছে। তাই দুর্নীতি হলে কেউ আর আজকাল গায়ে মাখে না, যেন অনেকটা গাসহা হয়ে উঠেছে, কিন্তু এটা কেন গাসহা হয়ে উঠলো, এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন সমাজ যেহেতু একটা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, তাই সমাজের নিয়ন্ত্রক গুলো আজ যেন অনেকটা আলগা হয়ে উঠেছে ,তার ফলেই দিন দিন দুর্নীতি বেড়েই চলেছে।
বর্তমানে সমাজ অর্থের নেশায় ঘুরছে, মানুষ যেনতেন প্রকারে রাতারাতি অর্থবান হওয়ার চেষ্টা করছে, এই অর্থের নেশায় মানুষ আজ নৈতিকতা মূল্যবোধ গুলিকে শেষ করে দিচ্ছে, তাই রাতারাতি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশ সমাজতাত্ত্বিক মনে করেন সমাজের নিয়ন্ত্রণ বিধি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক উপাদানগুলো আলগা হওয়ার জন্য সমাজে দুর্নীতি হুহু করে বেড়ে চলেছে। এটা পুকুরের কচুরিপানা বাড়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে ,অনেকটা করোনা বাড়ার সাথে অতুলনীয়, অর্থাৎ আজকে দেখলেন পুকুরের কচুরিপানা একটা আছে, আপনি যদি ওটাকে পুকুর থেকে তুলে না দেন, পরদিন দেখবেন চারটে, তারপরের দিন ষোলটা,এভাবে একদিন দেখবেন গোটা পুকুরটাই কচুরিপানায় ভরে গেছে, আজ দুর্নীতি ও ঠিক এভাবেই বেড়ে চলেছে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হচ্ছে না, অনেক সময় তারা আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছ, সরকারি সংস্থায় কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতি করে ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন, অনেক সময় অধঃস্তন কাউকে বলির পাঁঠ হতে হচ্ছে, তার ফলে নিজেরা সাধুর তকমা পড়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে বিত্ত আর ক্ষমতা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষ অপরাধ করেও সমাজে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ,সাধারণ মানুষ তা দেখছে ,তাদের মনেও একটা বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যার ফলে দুর্নীতি নামক ব্যাধি আজ সমাজকে গ্রাস করেছে।
দুর্নীতি সত্যিই আজ সমাজে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে,এটা দূর করতে গেলে সবচেয়ে আগে যেটা দরকার তা হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দেশ ও সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কঠোরভাবে দুর্নীতিকে দমন করতে হবে দুর্নীতি বিরোধী আইন গুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে দুর্নীতিতে যুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে , সর্বোপরি সকলের সম্মিলিত শক্তির অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতির শিকড় তুলে ফেলতে হবে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল এমন এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যার সাহায্যে সমাজ তার সদস্যদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সমাজ বিশেষ কিছু সামাজিক রীতিনীতি মূল্যবোধ ,আইন, আদর্শের দ্বারা তার সদস্যদের দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে, সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয় ভাবে হতে পারে, যেমন পুলিশ প্রশাসন, আইন, দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে, অর্থাৎ পরোক্ষভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ঘটে, উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মনে হয় সমাজ নিয়ন্ত্রণ এর পক্ষে খুবই অর্থবহ ,এর দ্বারা ব্যক্তির মনে সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণার বিকাশ ঘটে ,ফলে ব্যক্তি দুর্নীতিমূলক কাজকর্ম থেকে দূরে থাকে।
আবার সমাজ কিছু ইতিবাচক বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করতে পারে, যেমন পুরস্কার প্রশংসা ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তিকে দুর্নীতিমূলক কাজকর্ম থেকে দূরে রাখতে পারে, আবার যখন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না তখন সমাজ অবশ্যই কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে থাকে, যেমন তিরস্কার, ধিক্কার, নিন্দা, অর্থদণ্ড,বা সামাজিকভাবে বহিষ্কার করে ব্যক্তিকে দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে।
আধুনিক সমাজে বিধিবদ্ধ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অবিধিবদ্ধ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিধি, যেমন লোকাচার , লোকনীতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে,তবে বর্তমানে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে অবিধিবদ্ধ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার চেয়ে বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা এই বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গুলি ভবিষ্যতে দুর্নীতি দমনে অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
যাই হোক দুর্নীতি দমন যেভাবে হোক করতে হবে তা না হলে আমরা ভবিষ্যতে দুর্নীতির সাগরে ভেসে যাব। আজ বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ভারত সহ এশিয়ার দেশগুলির অবস্থান খুবই খারাপ, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ছাড়া প্রায় সব দেশেই দুর্নীতির নিরিখে অনেকটা এগিয়ে। বর্তমানে ভারত 180 টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির তালিকায় 80 তম স্থানে রয়েছে,প্রতিবেশী বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের অবস্থান ও যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
আজ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে দুর্নীতিমূক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, এর জন্য সম্মিলিত শক্তির জাগরণ খুবই জরুরী, নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করতে হবে,সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরো বেশি করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, বিধিবদ্ধ এবং অবিভক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, ভুলে গেলে চলবে না যে সমাজ একটি নিয়ন্ত্রণ মূলক প্রতিষ্ঠান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন