অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ১২ এপ্রিল, ২০২১

একটি গল্পে রীতা রায়


 

রহস্যের চোরাবালি
============================


বহুদিন বাদে আমরা দুই বন্ধু মানে আমি আর জলি বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে একটি ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম..| রাস্তাটি খুব সুন্দর | পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্নিগ্ধ পরিবেশে হাঁটতে মন্দ লাগছিলো না ! গল্প করতে করতে একটি সুন্দর চওড়া রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ডানপাশে একটি বড় গেট চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ালাম | পাশে একটি ছোট গেট | কী মনে হলো সেখান দিয়ে ঢুকে পড়লাম | বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো কলেজ বা বড়সড়ো স্কুল হবে হয়তো, কিন্তু, ভেতরের দিকে কিছুটা ফাঁকা রাস্তা পেরোতেই একটা ছোটোখাটো পুরোনো প্রাইমারী স্কুলের মতো ছোট একটা বাড়ি নজরে এলো | চূন-সুড়কি বেরিয়ে পড়া কোনাকুনি দুটি ঘর | বাড়িটার সামনে একটি চায়ের দোকান .. সামনে পুরোনো সাইনবোর্ডে লেখা -- 'দিলীপের চায়ের দোকান' |



চারপাশ তাকিয়ে খুব চেনা চেনা মনে হলো | মনে হলো আগেও এখানে এসেছি | আজ একটু অন্যরকম .. মনে হয় অনেকদিন পর আসার ফলে এরকম মনে হচ্ছে কিন্তু কবে কার সাথে এসেছিলাম কিছুই মনে করতে পারলাম না | কী একটা আকর্ষণ আমাদের ভেতরে টানছিলো .. হঠাৎ একটি সুন্দর মেয়ের মুখ মনের প্রেক্ষাপটে ভেসে উঠলো | জলিকে বললাম, 'আগে যখন এখানে এসেছিলাম তখন একটা মেয়েকে দেখেছিলাম ! আজ স্কুলটা ফাঁকা ফাঁকা | মনে হয় প্রাইমারী স্কুলটা ভেঙে কোনো বড় স্কুল তৈরী হবে |' বলতে বলতে সেই চেনা মুখের মেয়েটি এসে হাজির .. হাসিটা এখনো একই রকম | সাথে আর একজন .. এ মুখটিও খুব চেনা লাগলো | এদিক ওদিক ঘুরে স্কুলের পেছনে এসে দেখি সেখানে একটি ছোট বাড়ি .. মনে হয় লোক বাস করে | এগোতেই সেই চেনা মুখের মেয়েটি আমাদের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো |



এটা বাড়ি না ক্যান্টিন সেটা ঠিক বোঝা গেলো না .. আবার শোবার ঘর না বসার ঘর সেটাও বোঝা যাচ্ছে না তবে ঘরটি খুব সুন্দর সাজানো গোছানো | ঘরের পর্দা, বেডসীট, বালিশকভার সবই একই ছিটকাপড়ে তৈরী | বিছানায় রোবট জাতীয় দুটো পুতুল | আশ্চর্য্য যে আমরা প্রশ্ন করতেই ওরা উত্তর দিল | প্রথমে জলি ওদের সাথে আলাপ জমালো, পরে আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম | একটি লোক ঘরে প্রবেশ করলো খাবারের দুটো প্লেট ও জলের গ্লাসসমেত ট্রে হাতে | আমরা কোনো খাবারের অর্ডার দিইনি অথচ দেখলাম আমাদের পছন্দমতো খাবার দেওয়া হয়েছে যেন মনে মনে এই খাবারগুলোরই আশা করেছিলাম | আমরা খেলাম | ঘর থেকে স্কুলের বাইরের দিকটা দেখা যাচ্ছিলো .. দোকানের ভেতরটাও | দোকানের ভেতরে দুটি চাকতি ঘুরিয়ে আটা তৈরী হচ্ছে | দোকানের প্রয়োজনীয় আটা তারা নিজেরাই তৈরী করে নেয় বোঝা গেলো | একটাতে কিছু অপরিষ্কার গম পরিষ্কার করা হচ্ছে আর অন্যটিতে সেই গম পিষে আটা বেরোচ্ছে |

সবাই যে যার মতো কাজে ব্যস্ত .. কেউ কারো সাথে কথা অব্দি বলছে না | কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা | জায়গাটা চেনা চেনা .. কবে এসেছি মনে করতে পারছি না কেন? আগে কি দোকানটা ছিল ? সেটাও মনে পড়ছে না | দিলীপের দোকান ? দিলীপটা কে ?



ঘরের চারপাশে আর একবার চোখ বুলালাম | ঘরের এককোনে একটি মূর্ত্তি .. দুর্গামূর্ত্তি !

মূর্ত্তিটিও খুব চেনা মনে হলো .. কোথায় যেন দেখেছি | ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল, মুখ গলা ঘামে ভিজে গেছে | ঘাম মোছার জন্য রুমাল খুঁজতে হাতের ব্যাগটি খুললাম | কিন্তু হাতে রুমালের পরিবর্তে উঠে এলো একটি কাগজের মোড়ক | মোড়ক খুলতেই ভেতরে চকচক করে উঠলো একটি স্বর্ণমুদ্রা ! মূদ্রার ওপরে আঁকা একটি দুর্গামূর্তি যা হুবুহু এই ঘরের দুর্গামূর্ত্তিটির প্রতিরূপ | মুদ্রাটি কাত করতে তাতে রিভার্সে ভেসে এলো একটি ছেলে ও মেয়ের ছবি | খুব চেনা মনে হলো | আমি কী ভেবে মূদ্রাটি ব্যাগে লুকিয়ে ফেললাম | যে লোকটি খাবার দিয়ে গেছিলো সেই লোকটি পুনরায় ঘরে এলে জলি খাবারের দাম চুকিয়ে দিল কিন্তু দশটাকা মতো কম পড়লো | আমি ভাবলাম আমার ব্যাগে কিছু খুচরো টাকা রয়েছে | ব্যাগ খুলে দিতে যাবো .. কিন্তু, আবারো হাতে উঠে এলো সেই স্বর্ণমুদ্রাটি |আমি অন্যমনস্কভাবে তা লুকিয়ে ফেলতে গেলাম | ঠিক তখনই সেই সুন্দর মুখের মেয়েটি ঘরে ঢুকলো আর আমার ব্যাগের মুদ্রাটির দিকে তার নজর পড়ে গেল |অমনি চিৎকার করে সকলকে ডাকতে শুরু করলো .. 'সবাই এসো, বিজয়কে এই খুন করেছে | এই মুদ্রাটি চুরি করেছে | হাতেনাতে ধরে ফেলেছি |'



আমি আর জলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম | কিন্তু কয়েকজন ছুটে এসে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো | মুহূর্তে সবকিছু মনে পড়ে গেলো | এই যে এতক্ষন সবকিছু চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো এগুলো গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম |

স্বপ্নের বাড়তি অংশটাও চোখে ভেসে উঠলো | আমরা আসলে একটি কেস এর ইনভেষ্টিগেশন করার জন্য এই বাড়িতে এসেছিলাম | আর এখন নিজেরাই ফেঁসে গেলাম | মনের ওপর জোর দিয়ে স্বপ্নের পরবর্তী অংশটি মনে পড়তেই একরাশ ভয় এসে জড়ো হলো | এতক্ষন তো ভয় পাইনি, হঠাৎ কী হলো ? কীসের জন্য এই ভয়ের উদ্রেক !



মনে পড়ে গেলো হাসপাতালের বেডে শায়িত দিলীপের নিথর দেহ | প্রাণচঞ্চল ছেলেটাকে এভাবে হঠাৎ শেষ হতে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না | দিলীপ আমার মামাতো দিদির মেজো ছেলে | আমাদের মধ্যে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল | নিজের প্রচেষ্টায় নানারকম ছোটখাটো ব্যবসা থেকে ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়া | শেষপর্যন্ত্য দোকান গাড়ি বাড়ি সব করলেও সংসার করা হয়নি | মা ও ভাইদের সাথেই থেকেছে | এমনকী সমাজসেবাতেই তার দিনপাত | রাতবিরেত যখনই খোঁজা যায় মানুষ তাকে পাশে পায় আর এই জন্যই পঞ্চায়েতের নির্বাচনে খুব সহজে জয়লাভ করে উপপ্রধান পদটিতে আসীন হলেও প্রধানের সমস্ত কাজ তাকেই সামলাতে হত কারন সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রধানের পদটি তপশিলী মহিলা প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত ছিল | একজন কাজে অনভিজ্ঞ নিরক্ষর তপশিলী মহিলা প্রধানের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে দিনরাত্রি মানুষের সেবায় ছুটোছুটি করেও কিছু মানুষের চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ রাজনীতিতে ভালো মানুষের জায়গা নেই | কারচুপি রুখতে গেলে কারো না কারো চোখে বিষ হয়ে উঠেছিল আর এটাই হয়েছিল কাল | এর জন্য তাকে বিনা অপরাধে জেলহাজতে বাস করতেও হয়েছিল যদিও শেষপর্যন্ত্য নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেলেও মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিল | তা সত্বেও এই কুচক্রীবৃত্তকে হাতেনাতে ধরে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য গোপনে পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছিলো শেষ লগ্নে পৌঁছেও শেষপর্যন্ত্য তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল | কার কার হাত ছিল এর পেছনে | সেকথা কেউ জানতে পারেনি কারণ দিলীপ এবিষয়ে কোনো আলোচনা কোনোদিন তার বাড়ির লোকজন বা বন্ধুদের কাছেও করেনি .. আমাদের কাছে তো নয়ই | কেশটা ধামাচাপা পড়ে গেছিলো কিন্তু মৃত্যুর পর তার বিছানার নিচ থেকে যে সমস্ত অবিশ্বাস্য জিনিসপত্র পাওয়া গেছিলো তার থেকে তার মৃত্যু রহস্য ঘনীভূত আকার নিয়েছিল .. বোঝা যাচ্ছিলো না তা তান্ত্রিক না ভৌতিক নাকী বিজ্ঞানের অপব্যবহার | তবে এর পেছনে যে কোনো সুচিন্তিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসম্পন্ন মাফিয়াচক্র জড়িয়ে আছে তা আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে দিনরাত্রি ঘুরপাক খাচ্ছিলো যার ফলস্বরূপ আজকের এই ঘটনা |



এতক্ষন রোবটের মতো যে দুজন বিছানায় পড়ে ছিল তারা রিভলভার হাতে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো | দিলীপ এদের আস্তানার খবর জানতে পেরে গেছিলো এবং অতর্কিত আক্রমণে মাফিয়া ডন বিজয়কে ধরে ফেলে এবং আত্মরক্ষার্থে বিজয় গুলি চালালে দিলীপের মৃত্যু হয় | কিন্তু বিজয়ের মৃত্যু রহস্য তখনো অজানা | যাই হোক এই দুটি রোবটের জন্যই আমরা এযাত্রায় বেঁচে গেলাম | কী করে ? তারাই তাদের সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো | মানুষেরা অমানবিক হলেও যন্ত্রেরা যন্ত্রের মতোই কাজ করলো শুধু অতর্কিতে তৃতীয় এক মুখোশধারী ব্যক্তি এসে তাদের রিভলভার ধরা হাত শত্রুর দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো আর সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটতেই সেই সুন্দর মুখের মেয়ে দুটি ধরাশায়ী | বাকিরা পলাতক |



আমি আর জলি প্রাণ হাতে ছুটতে ছুটতে বড় রাস্তায় এসে এতক্ষন যা ঘটলো তা ভেবে ভয়ে কেঁপেই যাচ্ছিলাম | মুখে কারো কথা নেই | আমি শুধু ভাবছি ..কে এই তৃতীয় ব্যক্তি ? সেই কী বিজয়ের হত্যাকারী ? আর দুর্গামূর্ত্তি ? কী তার রহস্য ? তাহলে কী দুর্গামূর্ত্তির ভেতরের রয়েছে গোপন কোনো রহস্য ? আর আমার ব্যাগে এই মূর্ত্তিচিহ্নিত স্বর্ণমূদ্রাটি কী করে এলো ? ভয়কে আশ্রয় দিলে সে মনে ঘাপটি মেরে বসে যাবে ভেবে ব্যাগ থেকে মূদ্রাটি বের করে ঝোপের দিকে ছুঁড়তে যেতেই সেই মুখোশধারী সামনে এসে দাঁড়ালো | বললো -- ওটা আমাকে দিন | এর মধ্যে যে সংখ্যাতত্ত্ব লেখা রয়েছে তা আসলে সুড়ঙ্গের দরজা খোলার কোড নম্বর | যে সুড়ঙ্গটি ওই দুর্গা মূর্তির নিচে রয়েছে আর যেখানে রয়েছে যত সব দুষ্কর্মের কারখানা |

-- কে আপনি ? প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলাম |

মুখোশ খুলতেই যে চেহারাটি সামনে এলো সে সেই দোকানের লোকটি যে খাবার নিয়ে এসেছিলো | আসলে তিনি সি আই বি ইন্সপেক্টর | অনেকদিন ধরে এই খানাতল্লাশি চালাচ্ছিলেন ওদের বিশ্বাসভাজন হয়ে | কাজ এখনো বাকি | শুধু যেতে যেতে বলে গেলেন -- সাবধানে থাকবেন |

উনি হয়তো রহস্যের কিনারা করে ফেলবেন কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারলাম না আমার ব্যাগে মূদ্রাটি কী করে এলো ? আর পুরো ঘটনাটি আমার স্বপ্নের ভেতরেই বা কী করে এলো ? এও কী সম্ভব ? অসম্ভব বলে কী কিছুই হয় না ! একটা অজানা ভয় ছেয়ে রইলো মনের গহনে |




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন