লকডাউনের যাঁতাকলে জনজীবন: একটি সমীক্ষা
=================================
বারিদ বরন গুপ্ত
=================================
প্রায় দেড় বছর লকডাউনের যাঁতাকলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, মানুষের মন থেকে শান্তি উধাও হয়ে গেছে, বলতে গেলে মানুষ মৃতপ্রায় হয়ে জীবন যাপন করছে, কিভাবে বেঁচে থাকবে? জীবন বাঁচানোর জন্য অক্সিজেন কোথা থেকে কিভাবে জোগাড় করবে?জীবিকার পথ কিভাবে খুলবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে মানুষ! সত্যি বলতে কি করোনার আতঙ্ক থেকেই জীবন এবং জীবিকা কে বাঁচানোর জন্য, রসদ জোগাড়ের আতঙ্ক বর্তমানে মানুষ কে ভাবিয়ে তুলেছে, মানুষ দিশেহারা হয়ে ভেবে পাচ্ছেনা আগামী দিনে জীবনটা কিভাবে টিকে থাকবে।
লকডাউনে সবচেয় সঙ্গিন অবস্থা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনের। করোনা জনিত পরিস্থিতিতে লকডাউনের যাঁতাকলে জনজীবন কিভাবে অতিবাহিত হয়েছে আমরা বেশ কয়েকটা পর্যায়ে ফেলে আলোচনা করতে পারি। করোনার প্রথম পর্যায় অর্থাৎ গত বছর মার্চ এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঘর বন্দী জীবন যাপন করেছে, তখন তাদের মধ্যে জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন ছিল, গোটা ইউরোপ বিধ্বস্ত, আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ডের মতো দেশ করনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছি, এহেন পরিস্থিতিতে মানুষের কাছে জীবন বাঁচানো ছাড়া আর কি থাকতে পারি, সত্যি কথা বলতে কি হাজার হাজার মানুষ যারা বাইরে কাজ করতো, যেনতেন প্রকারে জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরে ফিরেছে, জীবিকার প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে উঠেছে।
করোনার দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ জুলাই আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর অক্টোবর পর্যন্ত, মানুষ জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জীবিকার সন্ধান করেছে, কিভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচা যায় সেই ভাবনা মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অনেকেই করোনার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, কারণ পেটে গামছা বেঁধে তো জীবন চলে না,তাই অনেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, হাটে বাজারে গ্রামে ফেরি করে কোনরকমে পেট চালানোর জন্য সংগ্রাম করে গেছে।
করোনার তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ আগস্ট সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর নভেম্বর পর্যন্ত মানুষ জীবন-জীবিকার পাশাপাশি শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছে, কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থা টাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার জন্য অনলাইন শিক্ষা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এদিকে লকডাউনের ঘোড়া টেপে বন্দি থাকার জন্য মানুষের সঞ্চয়ের ভাড়ার শূন্য হয়েছে, বাজারে জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়েছে, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাঁটাই করছে, সর্বোপরি জনজীবনে এক বিভীষিকার ছায়া নেমে এসেছে।
ডিসেম্বর মাস থেকে করোনার প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে, লকডাউন শিথিল হতে থাকে, মানুষজন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকে, অনেক জায়গায় স্কুল-কলেজ ও খুলতে থাকে, পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে, কিন্তু আবার শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, আবার লকডাউন আবার জনজীবন গৃহবন্দি হয়ে পড়ে, অফিস-আদালত প্রায় সব বন্ধ হওয়ার মুখে, পৃথিবীজুড়ে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে, জীবন বাঁচানোর জন্য অক্সিজেন দামি হতে থাকে, চারিদিকে একটা আতঙ্কের সুর, হসপিটাল, চিকিৎসা কেন্দ্র সব জায়গায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে করোনার মোকাবিলা করতে থাকে, প্রায় গোটা বিশ্ব জুড়ে একটা আতঙ্কের চোরা স্রোত বইতে শুরু করে। করোনার এই তান্ডব নৃত্য চলে প্রায় এ বছরের জুন জুলাই মাস পর্যন্ত।
আমরা করোনাকালীন সমাজব্যবস্থা অর্থাৎ জনজীবন নিয়ে যে ছবি পেলাম তাই একটু বিচার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, এই পরিস্থিতিতে আর্থসামাজিক জীবন কিরূপ চলবে তার একটা ছবি আমরা অঙ্কন করতে পারি। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যার মুখে পড়েছে গতর খাটা মানুষজন। দীর্ঘকাল লকডাউনে ঘরে থাকার জন্য অনেকেই প্রায় মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়েছিলেন, কারণ করোনা আতঙ্ক থেকে তাদের জীবনের অর্থাৎ পেটের আতঙ্ক টাই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল, তাই করোনার তোয়াক্কা না করে অনেকেই যেনতেন ভাবে রুটি রোজগারের চেষ্টা করে গেছে, গ্রামের থেকে শহরের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল, সাধারণ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষজনের গ্রামে-গঞ্জে তবুও 2-4 বিঘে জমি জায়গা আছে, কিন্তু শহরের সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের তো গতর টাই পুঁজি, লকডাউনে এইসকল মানুষজনের কি অবস্থা হয়েছে তা একটু ভাবা যেতে পারে, একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে নগরজীবনের এরূপ শ্রেণীর মানুষজন অনেককেই আত্মহত্যার পথে পা বাড়িয়েছিলেন, কারণ লকডাউনে পেট তো মানে না, যদিও সরকারের তরফ থেকে অনেকটাই সাহায্য করা হয়েছিল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা তো যথেষ্ট ছিল না। করোনা জনিত পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছিল পরিযায়ী শ্রমিক, এরা প্রাণের তাগিদে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল, কিন্তু গ্রামেগঞ্জে কাজ না থাকার জন্য এদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে, তাই অনেকে করোনার ভ্রকুটি উপেক্ষা করে আবার পুরনো কর্মস্থলে ফিরে যায়।
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে লকডাউনের যাঁতাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু ছাত্র সমাজ, তারা প্রায় দেড় বছর গৃহবন্দী, স্কুল-কলেজের মুখ দেখতে পায়নি, মনে জেগেছে আতঙ্কের স্রোত, এরূপ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক পড়াশোনা চলে না,আর সেটাই হয়েছে, যদিও অনলাইন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পড়াশোনা এবং পরীক্ষা চালু রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনো অনলাইন পরিকাঠামো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি, তাছাড়া ছাত্র-ছাত্রীরাও এই কাঠামোতে অভ্যস্ত ছিল না, যার জন্য তাদের জীবনে একটা দুরাশার ছায়া বিরাজ করেছে, অনেক মনস্তত্ত্ববিদ মনে করেন এই করোনাকালীন পরিস্থিতিকে ছাত্র সমাজের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল, ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
করোনা জনিত পরিস্থিতি বেকার যুবক যুবতীদের কাছে অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছে, তারা না পারছে একটা কাজ জোগাড় করতে, না পারছে অন্য পেশায় যুক্ত হতে। যেনতেন প্রকারেন কোন একটা কাজের জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অতিসম্প্রতি বেশ কয়েকটা চতুর্থ শ্রেণীর পদে কর্মখালি বিজ্ঞাপনে আবেদনকারীদের যোগ্যতা দেখে নিয়োগকর্তাদের মাথায় হাত, অতিসম্প্রতি কলকাতার নীলরতন মেডিকেল কলেজে ল্যাবরেটরি এটেনডেন্ট পদে, এবং উত্তরপ্রদেশে ম্যাসেঞ্জার পদে হাজার হাজার পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ার, ডক্টরেট, ম্যানজমেন্ট, মাস্টার ডিগ্রিধারীদের দেখা যাচ্ছে, এহেন পরিস্থিতিতে ভাবতে অবাক লাগে দেশের বেকার সমস্যা কি অবস্থায় পৌঁছেছে? উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীরা জানো একটু অক্সিজেনের জন্য ছোটাছুটি করছে, তা অবশ্যই জীবন বাঁচানোর তাগিদে।
এহেন পরিস্থিতিতে সকলের কাছে একটাই প্রশ্ন, আগামী দিনের সমাজের অবস্থানটা ঠিক কি হবে? এর মধ্যেই করোনার তৃতীয় ঢেউ এর ভ্রুকুটি দেখা যাচ্ছে, যদিও দেশব্যাপী জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচি সমানে চলছে, তা সত্য বলা ভালো যদি সমাজ এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে তাতে করে কোন গঠনমূলক চিন্তা ভাবনা আসতে পারে না। গোটা বিশ্বসমাজ ঠিক এভাবেই একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছে। বিগত 100 বছরের ইতিহাসে সমাজকে এতটা চ্যালেঞ্জ এর মুখে পড়তে হয়নি, সভ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বর্তমান সমাজ বিবর্তন গামী বা চক্রাকার পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে, আগামী দিনেও নানা সংগ্রামের পথে সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে, সকলকে সে ভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন