মরিয়ম বেওয়ার পয়লা বৈশাখ
=====================
লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মরিয়ম বেওয়া। অশীতিপর বৃদ্ধার হাত কাঁপছে। প্রাগৈতিহাসিক চোখ থেকে অশ্রু বেয়ে গড়াচ্ছে আফৃকার ম্যাপে; সেখান থেকে মাটিতে।
তখন সংলগ্ন বাড়ির যুবক কবির ওঁর পাশে গিয়ে বললো, ফুপু কখন আইলা? কী দেখতাছো অমন কইরা? এইটা তোমার বাড়িই। কেউ না থাকায় জঙ্গল হয়া গেছে!
মরিয়ম বেওয়া বললেন, পোলা দুইডা বউ লইয়া ঢাকা চইলা গেলো। ভিক্ষা কইরাও পেট পালতে না পাইরা দাদপুর চইলা গেলাম মেঝ মাইয়া আবেদার কাছে।
ওসব জানি! আবেদা বু তিনবেলা ভাত দেয় তো?
দেয়। জামাইডা খুব ভালা। নাতিরাও আমারে খুব পছন্দ করে।
আইজ কেনো আইছো ফুপু?
আইজ বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখ না রে কবির?
হ ফুপু।
যখন আমাদের জমিজিরাত আছিলো, তখন সকালে ঘুম থাইকা উইঠ্টা শাক টুকাইতে যাইতাম। সাত ধরনের শাক টুকায়া আইন্যা রাইন্ধাতাম। ঐদিকে তোর ফুপা নয়া ধান কাইট্টা আইন্না পারায়া ধান বাইর কইরা দিতো। নয়া চাইলের ভাত দিয়া ঐ শাক কী মজা কইরা খাইতাম! টোপা ধানের চাউলের ভাতে কী সুবাস!
কবির বললো, অহন ঢাকায় পয়লা বৈশাখে ইলিশ দিয়া পান্তা ভাত খায় ফুপু!
আমিও হুনছি। এই পথটা হাইট্টা আইতে অনেক পরাব হইছে। ক্ষিধাও লাগছে। শাক দিয়া চাইট্টা গরম ভাত খাইতে দিবি?
অহনো ভাত রান্ধে নাই। পান্তাভাত করছে। পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ নুন দিয়া আমরা খায়াম। তুমিও খাইবা। দুপুরে গরম ভাত খাইতে পারবা। আসো আমার লগে।
কাঁটা
=====================
কালপুরুষের জীবনে অনন্যার প্রেমলাভ আকাশের চাঁদ প্রাপ্তির চেয়েও বেশি। নখদর্পণে হিসাবের জমানায় শতভাগ বেকারের প্রেমে অনন্যা ছাড়া পড়েনি আর কেউ। এই ভাবনায় কালপুরুষ অনন্যার সামনে হয়ে যায় আব্দুর রহমান বয়াতি অথবা লালন শাহ।
অনন্যার প্রেম আগ্রাসী ভীষণ। সপ্তাহ ফুরোবার আগেই অনন্যা ওকে নিয়ে যায় বাড়িতে। কালপুরুষ প্রথমে যেতে চায় না। এতো তাড়াতাড়ি প্রেমিকার বাড়ি গিয়ে হবু শ্বশুর-শাশুড়ির বকা খেতে সে কোন মতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু প্রেমিকা গো ধরলে প্রেমিককে হতেই হয় কুপোকাত। সমস্যা দেখা দেয় ওর নাম ও পোশাক নিয়ে। অনন্যার ভাষায়: এই উদ্ভট নাম ও সয়ে নিলেও মা-বাবা কখনই সইবে না; ভাইটা তো প্রথমে বিদ্রুপ হাসবে, তারপর দিয়ে দেবে একটা আবোলতাবোল নাম। একবার ঐ নাম মা-বাবার পছন্দ হয়ে গেলে পাল্টাবে এমন সাধ্য কারো নেই।
অনন্যার টাকায় কেনা পোশাক পরতে কালপুরুষ রাজি হলেও নাম পাল্টাতে রাজি হয় না কিছুতেই। সে যতবার এই নাম রাখার শানেনূযুল বলতে চায়, ততবার অনন্যা ওকে দেয় থামিয়ে। ঘটনার দিন কালপুরুষকে দেখে অনন্যা বেকুব-রাগবে না কাঁদবে, বুঝতে পারে না। কালপুরুষ ওর কেনা পোশাক না পরে নিজেরটাই পরে আসে, যা অন্যন্যা গত এক সপ্তাহ ধরে ওর গায়ে দেখে আসছে: কুচকানো হাফহাতা শার্ট, নিচের দিকে বর্ডার ছেড়া জিন্সের প্যান্ট ও গোড়ালির দিকে ক্ষয়ে ফুটো হয়ে যাওয়া স্পঞ্জের চপ্পল। অনন্যা সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ফুটপাতে। পথচারীদের প্রত্যেকেই যাবার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে বারবার দেখতে থাকে। নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ায় বারবার ফোন আসতে থাকে বাড়ি থেকে অনন্যার মোবাইল ফোনে। অনন্যা আরেক সেট নতুন পোশাক কালপুরুষের জন্য কিনতে পারতো;কিন্তু ওর মনেও জেদ আসে যে এভাবেই ওকে বাসায় নিয়ে যাবে, যা থাকে কপালে। অত্যন্ত কঠিন কষ্ট হবে যদি এই নির্বিকার লোকটা বিয়ের পর গাছতলায় থাকার গো ধরে!
নিঃসঙ্কোচেই কালপুরুষ অনন্যার পাশাপাশি বাসায় ঢুকে।
নাম ও সম্পর্ক জানার সাথে সাথে অনন্যার বড় ভাই ইকরাম ফরিদ তেড়ে আসে ওকে মারতে। ড্রয়িংরুমে হৈ চৈ শুনে মা-বাবা একত্রেই ছুটে আসেন ড্রয়িংরুমে।
বাবা ফরিদ আজহার ছেলের হাত ধরে টেনে রাখেন আর মা আস্রফিয়া ফরিদ মেয়ের কাছে ঘটনা শুনে হাসিতে ফেটে পড়েন। সাথে সাথে ফরিদ আজহারও হাসতে থাকে। অনন্যা ও কালপুরুষকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে আস্রাফিয়া একটা একক সোফায় বসেন। ফরিদ আজহার ছেলেসহ একটি সোফায় বসেন।
হাসি থামিয়ে চোখের কোণের অশ্রুবিন্দু মুছে আস্রাফিয়া ফরিদ বলেন, খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি অনন্যার জন্য এমনই একটা ছেলে খুঁজছিলাম।
ইকরাম ফরিদ বিস্মিত হয়ে মার দিকে তাকিয়ে বলে, কী বলছো তুমি মা!
ছেলের মন্তব্য বিবেচনায় না এনে ফরিদ আজহার বলেন, ঠিক তাই। এই যে বাবা, তুমি কালকেই তোমার মা-বাবাকে নিয়ে এসো। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলবো!
আস্রাফিয়া ফরিদ বলেন, আমরা এখন হবু জামাতাকে নিয়ে হোটেল লা-মেরিডিয়ানে সেলিব্রেট করতে যাবো। ওকে?
কল্পনাতীত হলেও অনন্যা অত্যন্ত খুশি। সে বড় ভাইকে ভেংচি কেটে কালপুরুষের হাত ধরে চলে যায় নিজ শয্যাকক্ষের দিকে।
ওদিকে কালপুরুষ পড়ে যায় ঘোরের মধ্যে। রাতের ঘুম তার উধাও! আসলেও গতকাল ওরকম কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা যাচাই করার জন্য অনন্যার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। প্রকৃতপক্ষে ওর তরফ থেকে কোন টান সৃষ্টি না হওয়ায় অনন্যার মোবাইল ফোন নম্বর নেবার কথা মনে হয়নি ওর। সে বাসে করে এবং বাকি পথটা হেটে চলে আসে অনন্যাদের এপার্টমেন্টের সামনে।
এপার্টমেন্টের সামনে অনেক লোক। সবাই অনন্যাদের ফ্লাটের দিকে তাকিয়ে। আসলে এরা ফ্লাটটায় ঢুকতে পারছে না-এপার্টমেন্টের সামনে থেকে সিঁড়িঘর হয়ে ওদের দোতলার ফ্লাট পর্যন্ত প্রচুর লোক। অনেক ঠেলাঠেলি টানাটানি গুতাগুতি করেও কালপুরুষ সিড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না। উপরে উঠার হাল ছেড়ে দিয়ে উপরে কী হয়েছে একজনকে জিজ্ঞেস করে।
ভদ্রলোক বলেন, ফরিদ সাহেবের ভাস্তিটা গতরাতে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
পাশের আরেকজন বলেন, মেয়েটা মরে যাওয়াতে ছেলেটার পথ পরিস্কার হয়ে গেলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন