গিরগিটি
===================
গত পরশু মনতোষ কাকাবাবুর শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেল। আজ লৌকিক ক্রিয়ার শেষ কাজ প্রীতিভোজ। প্রীতিভোজ সেই লৌকিক ক্রিয়া,যার মধ্য দিয়ে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ভক্তি শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসা জানানোর বা দেখানোর বোধহয় শেষ সুয়োগ।তাই বাড়ির উঠোনে আকাশ ঢেকে বাঁধা হয়েছে বিশাল বাঁশের প্যান্ডেল। আত্মীয় স্বজন মিলে হাজার বারো'শ লোকজন আমন্ত্রিত।মোটা টাকা দিয়ে আনা হয়েছে পদ্মার ইলিশ।আগাম টাকা দিয়ে আনা হয়েছে গলদা পাবদা। বাড়িতে কারিগর এনে তৈরি হয়েছে দই মিষ্টি।কলকাতা থেকে এসেছে রান্নার লোক, যাতে আমন্ত্রিত লোকজন তৃপ্তি ভরে খেয়ে গুনগান করতে সংকোচ বোধ না করে।তাই অতিথি আপ্যায়নের কোন কার্পণ্য করেননি মনতোষ কাকার একমাত্র স্কুল মাস্টার ছেলে।
আমাদের বাড়ির দু'তিনটে বাড়ির পরে মনতোষ কাকাবাবুর বাড়ি।ছোট বেলায় কাকাবাবুর বাড়ি আমার ভাত বাড়ি ছিল বললে ভুল হয় না।দিনে একবার হলেও কাকা কাকিমার কাছে ছুটে যেতাম কতো আবদার ও বায়না নিয়ে।তারা সাধ্যমতো চেষ্টাও করতেন সেই সব বায়না মেটাতে। ভালো-মন্দ রান্না হলে কাকামি আমাকে বাড়িতে নিয়ে কোলে বসিয়ে খাওয়াতেন।মাঝে মধ্যে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া,কাকাবাবুর কাঁধে চড়ে নদীর বালুচরে ঘুরে বেড়ানো আরো কতো কি!সবই এখনো স্মৃতির অন্ধকার থেকে উঁকি দেয় মাঝে মধ্যে।সদাহাস্য কাকাবাবু খুব পরিশ্রমি।ধান চালের ব্যবসা করতেন।কাকা কাকিমা খুব অভাব কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন।বড় মেয়ে ললিতা বি এ পাশ করে অনেক চাকরি খুঁজে ব্যার্থ হয়ে অবশেষে বিয়ে করে সংসার পেতেছে।ছেলে মলয়,আমার থেকে বছর আটের ছোট।বছর দশেক হল স্কুল মাস্টারি চাকরি পেয়েছে সে। তার ও দুই ছেলেমেয়ে।ভালো স্কুলে পড়া শোনা করে।
ছেলের চাকরি পাওয়ার পর কাকিমা নিজে দেখে শুনে ছেলের বৌকে ঘরে এনেছিলেন। কাকিমা প্রায়ই বলতেন-"আমার এক মেয়েকে দূর করে আর এক মেয়েকে ঘরে এনেছি"।যেই সংসারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এল তখনই কাকিমা চলে গেলেন ভবপারে। কাকিমা চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু আগের মতো আর হাসি খুশি ছিলেন না।ঘরের বাইরে বেশি দেখা যেত না।আর দেখা গেলেও চোখে মুখে সব সময় একটা আতঙ্কের ছায়া।ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করলেই কি যেন লুকানোর চেষ্টা করে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচতেন।বেশ কিছু দিন হল কাকাবাবুকে আর ঘরের বাইরে একেবারেই দেখা যেত না বললেই চলে।তার পর হঠাৎ কাকাবাবুর এই মৃত্যু সংবাদ।
প্রীতিভোজ বলে কথা। দুপুর হতেই সেজেগুজে এক তোড়া রজনীগন্ধা নিয়ে হাজির হলাম প্রীতিভোজ বাড়ি। দেখলাম প্যান্ডেলের একদিকে চলছে দেদার খাওয়া দাওয়া। মনতোষ কাকাবাবুর ছেলে মানে আমাদের মলয়বাবু,প্যান্ডেলের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে অতিথি আপ্যায়নে …সদাহাস্য অতি বিনয়ী হয়ে করজোড়ে বলছেন…"আসুন …আসুন… বসুন। যৎসামান্য আয়োজন,সবাই পেট ভরে খাবেন…।" এক অতিথির মুখে "যেমন আয়োজন তেমন রান্না,তৃপ্তি করে খেলাম"-এমন কথা শুনে মলয় বাবু আত্মপ্রসন্নতার সুরে বললেন… সবই আপনাদের আশীর্বাদ…।
প্যান্ডেলের আর দিকে ছোট একটা বেদির উপর কাকাবাবুর সাদাকালো একটি ছবি।ছবিতে একটা সাদা ফুলের মালায় দেওয়া।বেদির পাশে চেয়ারে বসে কয়েক জন মহিলা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।আর কিছু বাচ্ছা ছেলে মেয়ে কি জানি কি আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
দুই এক পা করে হেঁটে বেদির সামনে গিয়ে কাকাবাবুর ছবিটা কাছ থেকে দেখতেই মনে পড়ে গেল সে দিনের সেই ভোর রাতের ঘটনা…
গত ভাদ্রমাসের শেষের দিকের একটা ভোরের দিন।ভোরের দিকে ঘুম ভাঙায় বিছানা ছেড়ে অন্য দিনের থেকে একটু আগে হাঁটতে বেরিয়েছি নদীর পাড় ধরে।অন্ধকার তখনো কাটেনি ।তবে পাখির ডাক শুরু করেছে গাছে গাছে।নদীর পাড় ধরে একটু হাঁটতেই দূর থেকে দেখি- বাঁশ ঝাড়ের ঝোঁপে তাল গাছের তলায় কেন যেন সাদা কাপড় মুড়ে বসে!প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।পরে সাহস করে আর একটু এগিয়ে দেখি,আমাদের মনতোষ কাকা। পাকা তাল ছাড়িয়ে আঁটি চুষে চুষে খাচ্ছেন।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি…
-একি ,কাকা আপনি, এখানে?কি করছেন তাল তলায়?
কাকা আমার কথায় একটু লাফিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি হাতের তালের আঁটিটা পিছনে লুকিয়ে বলেন…
-জীবনের তাল হারিয়ে গেছে তাই এই তাল তলায় বসে তাল খুঁজছি।
-তা এই ঝোঁপের মধ্যে কেন…?পাকা তালের আঁটি ও বা চুষে চুষে খাচ্ছেন কেন…?কি হয়েছে কাকা আপনার…?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে কাকা মাটির দিকে মুখ করে বসে থাকেন।আর শুকনো বাঁশের পাতায় চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ জল পড়তে থাকে।আমি কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলতে চায় না।আমি জোর করলে বলেন…
-এই তিন দিল হল ছেলে বৌমা আমাকে ভাত খেতে দেয়নি।বৌমা বলেছে "হাতির ভাগাড় পুরণ করতে তিন বেলা ভাত রান্না করে খাওয়াতে পারবো না,হাত পা আছে রান্না করে খাও"।এই বয়সে আমি কি রান্না করে খেতে পারি বাবা?তার উপর কোথায় চাল কোথায় ডাল।তোমার কাকিমা চলে যাওয়ার পর আমার শরীরটা ভালো যায় না।খিদেতে আর থাকতে না পেরে কাল দুপুরে এই তাল গাছের পাকা তাল খেয়ে জল খেয়েছি।আর আজ ভোর রাতে এখানে…
-আমার বাড়িতে যেতে পারতেন!গিয়ে মাকে তো বলতেন এক মুঠো ভাত দিতে!মলয় কিছু বলে না কাকা?খেয়েছেন কি খাননি তার খোঁজ খবর নেয় না?
-সেই সকালে স্কুলে বেরিয়ে যায়।বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়।তার আর সময় কখন আমার খোঁজ খবর নেবার!
-এখন চলুন তো আমার সঙ্গে।
-কোথায় যাব বাবা?
-আমার বাড়ি।ভাত খাবেন, চলেন।এবার থেকে তিন বেলাই আমার বাড়ি খাবেন।
-না…না…তা হয় না বাবা।
-কেন হয় না কাকাবাবু?
-এতে যে আমার ছেলে বৌমার সম্মান নষ্ট হবে।লোকে বলবে "স্কুল মাস্টারের বাবা আজ লোকের বাড়ি খেয়ে বেড়াচ্ছে"।এতে আমার ছেলের সম্মান কোথায় যাবে বলতো?সারা জীবন পরিশ্রম করে, না খেয়ে না দেয়ে যে সম্মান ছেলেকে এনে দিয়েছি সে সম্মান তোমার বাড়ি ভাত খেয়ে শেষ করবো?এটা যে হয় না। তুমি কিছু মনে করো না।যাও,বাবা… যাও…বাড়ি যাও।
-আপনি খাবেন কি?এভাবে না খেয়ে বাঁচবেন কি করে?
-এই ভাবে খেয়ে এই ভাবে বাঁচবো…।
কাকাবাবুর কথায় বুকের ভিতরে তীব্র যন্ত্রণা হতে লাগল।এ অন্যায়ের একটা প্রতিবাদ করতে হবে এমন একটা মানসিকতা নিয়ে বাড়ি ফিরতে যাব এমন সময় কাকাবাবু আমার ডান হাতটা টেনে ধরে বলেন…
-আমার একটা অনুরোধ একথা তুমি কাওকে বলো না।আর আমার ছেলে বৌমাকেও না।আমাকে না খেতে দিয়ে যদি ওরা ভালো থাকে,সুখে থাকে তো থাক না।ওদের এই সুখের জন্য তো তোমার কাকিমা আর আমি পরিশ্রম করেছি! তোমার কাকিমা ওদের সুখ দেখে যেতে পারেনি। কিন্তু আমি যেন এই সুখ দেখে মরে যেতে পারি…।
-ঠিক আছে কাকাবাবু,এবার বাড়ি তো চলুন…
চোরের মতো কাকাবাবুর হাতটি ধরে বাড়িতে আনতে শুনি তাল পাতার সোঁ…সোঁ…বাতাসের শব্দ যেন থেমে গেছে, নদীর স্রোতের কল কল ধ্বনি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে।পরে অনেক বার কাকাবাবুর সামনে এলেও কখনো জিজ্ঞাসা করতে পারেনি কাকাবাবু ভাত খেয়েছেন?কারণ মনের গুপ্ত অপরাধ আরো না বেড়ে যায় সেই ভয়ে।
দুচোখের জলে ঝাঁপসা হয়ে এলো মনতোষ কাকার সহাস্য ছবিটি দেখে।জামার তলাটা দিয়ে চোখের জল মুছে নিলাম। ফুলের তোড়াটা বেদিতে রেখে এটা প্রণাম করে না খেয়ে বড়ি ফিরে এলাম।বুকের ভিতরের সেই গুপ্ত অপরাধটা যেন আরো ভারি হল।ঘরে এসে বুকের তলায় বালিশটা চেপে ভাবেছি পৃথিবীতে কতো বিচিত্র সাদা কালো মানুষ,কতো বিচিত্র সাদা কালো তার শিক্ষা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন