অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১

লড়াই


অণুগল্পে তনিমা সাহা
===============


"And the award goes to Ms Nilam Kumar….", করতালিতে ফেটে পড়লো গোটা অডিটোরিয়াম।


"নিলম, অ্যাই নিলম….কোথায় রে গেলি...মরে গেলি নাকি রে….এই নিলম…..বলছি কথা কানে যাচ্ছে না নাকি….আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি নিলম….এবার কিন্তু খুব মার খাবি...ভালয় ভালয় বেরিয়ে আয়….নিলম, অ্যাই নিলম"। সুধীর একটানা ডেকেই যাচ্ছে। যাকে নিয়ে এতো কথা হচ্ছে সে তখন চিলেকোঠার ঘরটায় নীলরঙয়ের ড্রামটার পেছনে লুকিয়ে আছে। ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে। এখনো কালকের ঘাগুলো শুকোয়নি। দিনের পর দিন এই অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছে না নিলম।


গরীব ঘরে জন্মেছিল নিলম। ব্রিজেস মেয়ের ওই নিলাভ চোখ দেখে নাম দিয়েছিলেন নিলম। ভীষণ আগলে রাখতেন ব্রিজেস নিলমকে। একটু বড়ো হতেই নিলমের রূপ যেন বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। চারপাশের নরখাদকগুলো যেন সুযোগ খুঁজতো নিলমকে বাগে পেতে। ব্রিজেস স্পষ্টতঃই বুঝতে পারছিলেন যে নিলমকে এদের হাত বাঁচাতে গেলে পালাতে হবে এখান থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না ব্রিজেস। যে রাতে ব্রিজেস নিলমকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল সে রাতেই আততায়ীর হাতে খুন হন তিনি। তখন নিলমের নয় বছর বয়েস। নিলমকে সেখান থেকে নিয়ে অ্যাডামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তারই নিজের কাকা ললিত। সেখান থেকে হাত বদলে বদলে শেষে এই সুধীরের কাছে আসে নিলম।




নিজের ভাই ললিতকে খুব বিশ্বাস করতো নিলমের বাবা ব্রিজেস। এই ভাইকে শহর থেকে পড়াশুনো করানো জন্য নিজের জমিতে কাজ করার পরও ভাগচাষী হয়ে কাজ করতেন ব্রিজেস। কিন্তু নিলমের কাকা ললিত শহরে গিয়ে বদসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং বেশ কিছু কুঅভ্যেসও তৈরী করে সে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল নিষিদ্ধ মাদকসেবন করা।


বাবাকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেই প্রানরক্ষার্তে নিলম ছুটেছিল তার ললিত কাকার কাছে, এই আশায় যে কাকা তাকে বাঁচাবেন ওই আততায়ীর হাত থেকে। কিন্তু সেই কাকাই যেতার বাবাকে হত্যা করিয়ে তাকে মোটাঅঙ্কের বিনিময়ে অ্যাডামের কাছে বিক্রি করেছে সেটা জানতে পেরে নিলম বলেছিল, "তুমি ঠিক করো নি কাকা, খুব অন্যায় করেছো। ভগবান এর শাস্তি তোমাকে দেবেন"। নিলমের বলা এই কথা গুলো সত্যি হয়েছিল। ঠিক একবছর পর রাস্তা পেরোতে গিয়ে এক লড়ির তলায় পিষে মারা যায় ললিত।


সুধীরের ছিল চৌখস ব্যবসায়িক দৃষ্টি। সে একনজরে দেখেই বুঝতে পেরেছিল যে এগারো বছরের নিলমকে একটু ট্রেনিং দিলেই সে একজন পাকা এসকর্ট হবে। আজ দুবছর ধরে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন একজন করে কাস্টমারকে হ্যান্ডেল করে নিলম। নিলমের দেহকে বেশী ব্যবহার করতে দেয় না সুধীর। পাছে কোনো দাগ পড়ে যায় শরীরে। এরই মধ্যে তিন/চার পালাতে চেষ্টা করেছে নিলম। ধরাও পড়ে যেত যথারীতি। শাস্তি স্বরূপ একবেলা খাওয়া আর দু/তিন জন কাস্টমার সামলাতে হতো।

বয়সে নিলম থেকে দ্বিগুণরা যখন নিলমের দেহে এসে থাবা দিত তখন নিলমের নিজের উপর ঘেন্না জন্মাতো। রাগ হতো চরম নিজের মেয়ে হয়ে জন্মানোর উপর। একদিন উন্মুক্ত হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখেছিল নিলম। না তো রয়েছে তার নিটোল নিতম্ব, না তো রয়েছে তার উন্নতস্তন, কোমরের কটিদেশে এখনো তৈরী হয়নি কোনো খাঁজ। তাহলে কেন...কেন ওইলোকগুলো এসে তার দেহের উপর অমন পাশবিক অত্যাচার করে। এইখানে এসে নিলম আরো কিছু মেয়েকে দেখেছে এই একই কাজ করতে। মুখে মেক আপের পরদ জমিয়ে রাখলেও তাদের চোখ দেখে বোঝা যায় যে ভেতর থেকে তারা কবেই মরে গেছে। নিলমের এই জীবন চাই না। সে বাঁচতে চায়। জানে সে যে এদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেনা। তবুও নিজের জন্য লড়াই করতে চায় সে। জানে এখান থেকে বেরোলেও তার লড়াই আরো বাড়বে বই কমবে না। কারন সমাজ একজন এসর্কট গার্লকে মেনে নেয় না। তবুও সে থামবে না। লড়াই করবে নিজের জন্য। লড়াই করবে নিজের সুস্থুভাবে বেঁচে থাকার জন্য। এখানে থেকে এইভাবে দিনের পর দিন এক জ্যান্ত লাশে পরিনত হতে পারবে না। তাইতো গতরাতে যখন তার বাবার বয়সী লোকটি তাকে যত্রতত্র ছুঁয়ে, তার শরীরটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিল তখন আর সহ্য করতে না পেরে পাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা নিয়ে সজোরে মেরে দিল লোকটার মাথায়। সেদিন সুধীর তাকে প্রচন্ড মারধোর করেছিল। সেই থেকেই নিলম এই চিলেকোঠার ঘরটায় লুকিয়ে আছে।



প্রায় বছরখানেক পরের কথা….



এরমধ্যে বেশ কয়েকবার পালাতে চেষ্টা করেও ধরা পরেছে নিলম। ফলস্বরূপ ইলেকট্রিক শক দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছে নিলমকে। ধীরে ধীরে নিলমের ভেতর থেকে লড়াই করার জোরটাও মরে যেতে লাগলো। একা হাতে সকল প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত আজ সে। শরীরের আঘাতের চেয়েও তার নবাঙ্কুর মনটাই যেন আজ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ। বাহিত সময়ের সাথেসাথে সেই ক্ষতগুলো আরো গভীরতর হচ্ছে। কতই না নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, ক্ষত-বিক্ষত দেহ এবং চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয় নিয়ে আজ আঠাশের নিলম ওরফে ফ্লোরেন্স।




নিলম এখন তার নতুন জীবনকে মানিয়ে নিয়েছে। বুঝে গেছে যে এক মৃত্যুই তার এখান থেকে যাওয়ার ছাড়পত্র। কিন্তু এখনো টিমটিমে আলোর মতো কোথাও একটা আশা আছে হয়তো একদিন সে উদ্ধার পাবে এই নরকপুরী থেকে। নীলাভ চোখের জন্য তার নতুন নাম হলো ফ্লোরেন্স। সুগারগার্লদের বাজারে ফ্লোরেন্স একটা বেশ পরিচিত নাম। আজ সুধীরকে একটা বড়ো ডীল ফাইনাল করিয়ে দিয়েছে ফ্লোরেন্স ওরফে নিলম। ডীলটা ফাইনাল করিয়েই ফ্লোরেন্স চলে এসেছে এই নির্জন বাড়িটার সামনে। আজই শেষ করে দেবে নিজের এই বিষময় জর্জরিত জীবন। নিজের কুৎসিত এই জঘবনে চিরতরের মতো টুঁটি চিপে মেরে দেওয়ার মতোও স্বাধীনতা ছিলনা তার। সে ভেবেই নিয়েছে যদি পালাতে না পারি তবে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে অন্ততঃ এই বিষময় জীবন থেকে মুক্তি পাব। এতদিনে এই প্রথম নজরদারি থেকে ছাড়া পেল সে। সুধীরও হয়তো ধীরে ধীরে তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এখন। এই সুযোগটারই তো অপেক্ষা করছিল সে এতোদিন ধরে…….।


এতোটা পর্যন্ত বলে থামলো ডায়াসের উপর দাঁড়ানো আজকের ফ্লোরেন্স ওরফে নিলম কুমার। নিলম বললো, "যদি সেদিন বিথিকাদি আমার হাত না ধরতো তাহলে আজও হয়তো সেই অন্ধকার জগতেরই বাসিন্দা হয়ে থাকতাম আমি। হয়তো মৃত্যু না আসা পর্যন্ত আরো বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতাম। আজ 'আলোফাউন্ডেশনে'র কর্নধারের বিথিকা মজুমদার আমার মতো না জানি কতো হতদরিদ্র, অভাগীদের নতুন আশার আলো, বাঁচার পথ দেখায়"।

অডিটোরিয়ামটা সহস্র নীলমের করতালিতে গুঞ্জরিত হয়ে উঠলো।

 

 



 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন