মিনতি ঘোষ
==========
গ্ৰামের শেষে কঞ্চির বেড়ায় প্লাস্টিক ঝোলানো ঘর । থাকেন পুরোহিত ব্রজমোহন চক্রবর্তী । রেলের জমিতে জবর দখল । আশি ছুঁই ছুঁই বয়স । ঘরে আছেন ব্রাহ্মণী । সত্তোরোর্ধ । কোন এককালে পুজোআচ্চা করতেন চক্কোত্তি ঠাকুর । অনেক দূরে দূরে যেতেন । হেঁটেই পাড়ি দিতেন মাইলের পর মাইল । বয়স শরীরে, মনে বসালো থাবা । হাঁটতে পারেন না, মন্ত্র মনে রাখতে পারেন না । নিঃসন্তান দম্পতি । কে খাওয়াবে ? বার্দ্ধক্যের অসুস্থতায় কে নিয়ে যাবে সরকারি হাসপাতালে ? শুরু করলেন ভিক্ষা । ব্রাহ্মণীর কাঁধে হাত দিয়ে যতটুকু হাঁটা যায় । অসুবিধাও আছে । অঞ্চলটি মুসলিম প্রধান । ব্রাহ্মণ সন্তান কেমন ভাবে হাত পাতেন মুসলিম গৃহস্থের দরজায় ! তাই ভিক্ষানুসন্ধানে পাশের হিন্দুপ্রধান গ্ৰামে যান । সকালে বেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে যায় । চাল, আলু, আনাজ, খুচরো পয়সা । বাহুল্য বর্জিত খাবার । মাঝেমধ্যে একটু ডাল, সবজি পেলে তরকারি রাঁধেন ব্রাহ্মণী । । এক সময় চা খেতেন দম্পতি । এখন সে বিলাসিতা আর নেই । ওঁদের ভাষায় "ত্যাগ দিয়েছেন"। কচিৎ কদাচিৎ চায়ের দোকানে ডাক দিয়ে কেউ চা, বেকারি বিস্কুট খাওয়ায় । সে দিনটা বড় সুখের ওঁদের কাছে । ঘরের সামনের ছোট্ট খোলা জায়গায় মাটিতে উনুন পাতা । কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে তা দিয়ে জ্বালানি । খেতে খেতে বিকেল গড়ায় । রাস্তার কলে বাসনপত্র ধোয়া-পাখলা করে, রাস্তার পাশেই গাছতলায় বসে আলাপ বিশ্রাম যতক্ষণ দিনের আলো থাকে। আঁধার নামলেই ঘরে সেঁধোনো, কাঁথাকানি মুড়ি দিয়ে শোয়া । একটি ছোট্ট নেশা এখনোও বেঁচে আছে - দোক্তাপাতা । যা দু-চার পয়সা ভিক্ষা জোটে, তাই দিয়ে অল্পস্বল্প কেনা, গরম উনুনের পাশে রেখে, সেঁকে ঝনঝনে করে মাঝেমাঝে মুখে ফেলা - তা ঐ একবারই, খাওয়ার পর । অনেক দিন ধরেই দম্পতি একাহারী কিনা !
করোনা সংক্রমণের হিসাবে অঞ্চলটি লাল অর্থাৎ রেড জোন । সপ্তাহ খানিক ধরে ফুল লকডাউন চলছে এদিকে । চারিদিক বন্ধ । ভিক্ষায় বেরোনো যাচ্ছেনা । কাছেই ছোট্ট মুদিখানা । ভোর বেলায় ঝাঁপ সামান্য খুলতেই, বুড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজির - হাত বাড়িয়ে "দুটি ভিক্ষা বাবা …" কুড়ি টাকার একটা বড় মুড়ির প্যাকেট মুদি দেয় । তিন দিন ধরে জল মুড়ি খায় দম্পতি । আর খিদে সহ্য হচ্ছে না । আজ সকাল বেলায় কিছুটা শিথিল হয়েছে ঘেরাটোপ । নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে, খুব তাড়াতাড়ি যা পাওয়া যায়, তাই কিনে নিয়ে হাটে আসা মানুষ বাড়ি পালাচ্ছে । এ গ্ৰামের মুনির, আলম আর খালেক এসেছিলো হাট সারতে। ব্রজমোহন রাস্তায় বসে কাঁদছেন - "ও বাবারা আমায় দুটো খেদ্দে রে ...তিন দিন কিচ্চু খেতে পাইনি গো বাবারা …"
গাঁয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যাওয়ার মুখে মুনির চিঁড়ে আর চারটে কলা ব্রজমোহনের হাতে ধরিয়ে দেয়, আলম আর খালেক মিলে কেজিটাক চাল আর আলু দিয়ে যায় । ওরা জানেনা নবীর কাছে কোন গোস্তাকী হলো কিনা - যতই হোক হিঁদু বামুন বলে কথা ! ব্রজমোহনের মুখে একই সাথে হাসি আর কান্না লেপটে আছে । বুড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাছে এসে ফ্যাঁসফেসে গলায় বলেন "ও কি কল্লে তুমি ...বুদ্দিশুদ্দির মাতা খেয়েচো ? মোচলমানের হাত থিকে খাবার নিলে ?"
ব্রজমোহন কাঁদতে কাঁদতে ঘোলাটে চোখ তুলে গিন্নির দিকে তাকান । "বড্ড খিদে যে ! খিদে বড় বালাই গো ! এ অসুক জাত ধম্ম সব শেষ করে দেচ্চে । আজ দুটি খেতি না পেলি ঠিক মরতুম ...বাবারা বাঁচায়ে দেলে গো …"
মুহূর্ত খানেক আগের কথা ভুলে গিয়ে ব্রাহ্মণী ততক্ষণে চালের প্যাকেট খুলে ফেলেছেন - তাঁর মনের মধ্যে তখন একথালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, আলু সিদ্ধ উঁকি দিচ্ছে… আঃ যদি এট্টু কাঁচা লংকা পাওয়া যেতো ….ব্রাহ্মণীর মুখে জল কাটে !
প্রিয় লেখক, প্রিয় শব্দসৈনিক , অন্যমনে সাহিত্য সময়ের ইতিবৃত্ত সংখ্যায় আপনাকে পেয়ে গর্বিত ও আশান্বিত । আমরা আপনাকে শুভকামনা ও শুভেচ্ছা জানাই।
উত্তরমুছুন