অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সময় হারিয়ে যায়


কল্পদেব চক্রবর্তী
============

সম্পর্কে আপন মাসি। মার একমাত্র বড় বোন। দূরত্ব বেশি নয়, কলকাতার যাদবপুর আর বর্ধমানের " মশাগ্রাম। "

আসা-যাওয়া যাদবপুরের তরফে একদমই নেই। হবে কি করে করুণা দেবীর তিনটি ছেলে মেয়ে। দুটি মেয়ে একটি ছেলে। ওরা যে খুবই ছোট।

করুনা দেবী সেকেলে গৃহবধূ। স্বামী প্রণব বাবুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। দু পা এগিয়ে বাজারের পথটাও তেমন চেনেন না। আর প্রণব বাবু আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক থাক সেটা চাইলেও নিজে " আমার ইচ্ছে করেনা "মনোভাব নিয়ে এতগুলো বছর বেশ চালিয়ে গেলেন।

করুনা দেবী ছেলে শুভ। শুভর মাসির মেয়ের নাম গৌরী। গৌরীর দুটি মেয়ে, লক্ষ্মী আর তৃণা। গৌরীর স্বামী, মানে, মাসির জামাই বিরেনের একটু ঘোরাঘুরির শখ ছিল। সেই শখের কারণেই যতটুকু যোগাযোগ। বছরে একবার দুবার সে যাদবপুরে আসতো। তাতেই যতটুকু খোঁজখবর পাওয়া যেত।

শুভ যখন হায়ার সেকেন্ডারি পাস করল কত আর বয়স হবে বছর সতের। সেই প্রথম কলকাতার বাইরে পা রাখা।

একটা নিমন্ত্রণ পত্র এল গৌরির মেয়ে লক্ষ্মীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।সেই অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ।

শুভর মনটা আত্মীয় সঙ্গ পাবার আনন্দে নেচে উঠলো। রক্তের টান তো একটা থাকেই। তার উপর নিজের মাসি। নতুন জায়গার হাতছানি সেটাও আছে। অজানা আনন্দে তাড়িত হয়ে সে বায়না ধরে বসল, ' বর্ধমান সে যাবে।'

শুভর জেদের কাছে অগত্যা হার মানলো ওর বাবা ও মা। শুভ ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল বর্ধমানের উদ্দেশ্যে। ব্যাগে বিয়ের উপহার একটি মাঝারি মূল্যের লাল শাড়ি।

যাই হোক শুভ পৌছল মশাগ্রামে। কেউ তো কাউকে চেনে না। একমাত্র জামাই বিরেন ছাড়া। শুভর পরিচয় পেয়ে মাসিতো আনন্দে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। শুভরও সেরকমই অবস্থা।কত আবেগ আর কথা বুকের মধ্যে আটকে থেকে মুখ থেকে কোন কথাই বার হলো না।

বড় মাসতুতো বোন গৌরী আর তার দুই মেয়ে লক্ষী আর তৃণা ওরাও আনন্দে বিহ্বল। চোখ মুখ থেকে যেন সূর্যের কিরণের মতো উচ্ছ্বাস ঠিকরে বার হচ্ছে।


একটু থিতু হয়ে শুভ মার দেওয়া উপহার লাল শাড়িটা বার করে সবার সামনে লক্ষীর হাতে দিল। লক্ষ্মী খুব খুশি। ভাঁজ খুলে তখনই গায়ে উত্তরিয়র মতো জড়িয়ে আয়নার সামনে বিভিন্ন পোজ দিয়ে দেখে নিল কেমন লাগছে দেখতে।

তৃণার চোখে-মুখে উচ্ছাস। বলল, ' দিদি পরে আমাকে একদিন পড়তে দিস শাড়িটা।'

দিদি লক্ষী বলল, 'সে হবে খন। বিয়েটা তো হতে দে। এখন নজর দিস না। '


সোল বছরের লক্ষ্মী আর চোদ্দ বছরের তৃনা আর সতের বছরের শুভ সম্পর্কে মামা ভাগ্নি।

তৃণা বললো, ' মামা আমার যখন বিয়ে হবে তখন এমন একটা সুন্দর লাল শাড়ি আমাকে দিতে হবে কিন্তু।' শুভ লাজুক ভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো।

বিয়ে হয়ে গেল। দুটি দিন শুভ যেন আন্তরিকতার জোয়ারে ভেসে গেল।সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে শুভ আবার কলকাতায় ফিরে এলো।

না তৃণার বিয়েতে আর শুভর যাওয়া হয়নি।সেই প্রথম সেই শেষ মাসির বাড়িতে যাওয়া। বাড়ি ফিরেই কিছুদিনের মধ্যেই চেন্নাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল।


শুনেছিল তার বছর দুয়েক পরেই তৃণার বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রামে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়।

তৃণার থেকে বয়সে অনেক বড় ওর বর। বছর খানেক না ঘুরতেই টিবি রোগে মারা গেল। এসবই নাকি অলক্ষী অপয়া তৃণার আগমনে। প্রচুর অত্যাচার সহ্য করেও শ্বশুরবাড়ি টিকে থাকতে পারেনি তৃণা। বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিল।

অজগ্রামে বিয়ের পরে বাপের বাড়িতে ফিরে আসা, পরসিদের উৎসাহ আর বাক্যবানে বিদ্ধ অসহায় তৃণা মৃত্যুর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। তারপর সেই নদীর জলে একদিন তৃণার লাশটা ভেসে উঠতে দেখা যায়।

শুভকে আনমনা করে দেয় আজও সেই ফেলে আসা দুটি দিন। সেই নদীটা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যে নদীতে তৃনা শুভকে নিয়ে গিয়েছিল চান করাতে। তারপরে নদীর পাড়ে বসে বিকেল বেলা কত গল্প। পড়ন্ত বিকেলে হাত ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুভকে গ্রাম দেখানো। নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে থাকা। হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠা। হেসে বলতো, ' তোমার মত এত ছোট মামা গ্রামে আর কারো নেই গো ! তোমার সাথে আমার দুটো সম্পর্ক, একটা মামা আরেকটা বন্ধু।' বলেই আবার হেসে গড়িয়ে পড়তো।

শুভর আজও মনে পড়ে তৃণা ওর বিয়েতে একটা লাল শাড়ী চেয়েছিল দেয়া হয়ে ওঠেনি।কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও ওর চোখের কোনটা অজান্তে আজও ভিজে ওঠে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন