অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.
শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সময়ের ইতিবৃত্ত
ভাস্কর পাল
===========
অবশেষে সময়ের টিকটক যন্ত্রটি সেই রামচন্দ্রের দিন থেকে দুলতে দুলতে এই করোনা কালে এসে পুরোপুরি স্তব্ধ। সময় একদম স্থবির। চলতে থাকা সময়ের শুরুর থেকে ফ্ল্যাশ ব্যাকে পিছিয়ে গেলে আমরা পেয়ে যাবো তাঁর রাজ্যাভিষেক। সদ্য সদ্য দ্রাবিড় হননের বীর গাঁথা রাজ্যজুড়ে। সময় কে আর একটু পিছিয়ে নিলে এসে পড়ে সরযূ নদী, কুলু কুলু বয়ে চলেছে....পর্ণ কুঠির... বা ছোট রামের ছোটবেলা ,পুষ্পক রথ ।
সময়ের কাঁটা আরও অনেকটা পিছিয়ে নিয়ে আরও আরও পিছিয়ে গেলে প্রায় আজ থেকে প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে, চোখের সামনে ভেসে উঠবে বিগ ব্যাং নামের এক মহাজাগতিক ঘটনা যার ফলে বস্তু, শক্তি, সময় এবং স্থানের উদ্ভব ঘটেছিল। বিগ ব্যাং এর প্রায় তিন লক্ষ বছর পর, বস্তু ও শক্তির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় পরমাণু নামের বিভিন্ন জটিল কাঠামো তৈরি হতে থাকে । কিছু পরমাণু পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে অণুতে পরিণত হয়।এই পরমাণু, অণু এবং তাদের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় কিছু বৃহৎ ও জটিল কাঠামো গঠিত হলো । জন্ম নিলো প্রাণ। আর প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে, হোমো সেপিয়েন্স নামক একটি প্রজাতি বিস্তৃত সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করে । সময়ের আবর্তে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, আচার আচরনিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি এই সব কিছুকে বেঁধে কিছু জটিল সামগ্রিকতা মিশিয়ে সৃষ্টি হয় সংস্কৃতি।আর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে সময়ের হাত ধরেই ।
সময়ের পাল তোলা নৌকায় চেপে ভাসতে ভাসতে প্রাচীনকালের দার্শনিকগন চেয়েছিলেন সময়ের রহস্য ভেদ করতে। কিন্তু কোন কূল কিনারা পাননি। তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে সময় এক অতিপ্রাকৃত বিষয়। ফলে একটা সময় তাদের ধারণা হয়েছিল যে, সময় সম্ভবত মানুষের মস্তিষ্কের একধরনের উপলব্ধি। এরপর অনেক সময় চলে গেছে । দর্শনের আধিপত্য শেষ হয়েছে। এসেছে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ।আমাদের চেতনার ঘড়ি ২০২০ বছর এক নাগাড়ে চলে চলে আজ এসে সময় স্তব্ধ । সময় থেমে আছে।কলকারখানার সাইরেন থেমে আছে।শিল্প উৎপাদন থেমে আছে। সর্বোপরি চাকা থেমে আছে।
আদৌ কি চাকা থেমে আছে? মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার সেই মুহূর্তগুলি। টিভি র মেগা সিরিয়াল "মে হুঁ সময়...... " - এক মস্ত চাকা সারাটা স্ক্রীন জুড়ে ঘুরে চলেছে। পেছনে অনন্ত ব্রহ্মান্ড। সকলেই একসাথে এক ছন্দে ঘুরে চলেছে। আর ঘুরছে বলেই একদিন পরে থাকা পাথর ও ঘুরতে ঘুরতে চাকা হয়েছে। চাকা উন্নত হয়ে কলকারখানা হয়ে উঠেছে। শ্রম এর বিকাশ ঘটেছে। শ্রমের বিভাজনও এসেছে।কৃষি বিপ্লবের অভিজ্ঞতা শিল্প বিপ্লবকে তরান্বিত করে ফলে সমসাময়িক সমাজব্যবস্থায় কিছু চরম পরিবর্তন এসেছিল। দেখা যাচ্ছিল, শিল্প ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পপতি বা পুঁজিপতিরাও বিপুল সম্পদের অধিকারী উঠলো , তাদের কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠছিল, কিন্তু সেই একই সমান্তরালে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছিল সাধারণ শ্রমিকরা। সময় ,মুনাফা আর আরও বেশি মুনাফা এর পিছনে ছুটতে ছুটতে পুঁজিবাদ তখন মগজে প্রবেশ করেছে। শুরু হয়েছে শ্রম চুরি।এই সময়ের হাত ধরে এসেছে ক্রম উন্নতি। এসেছে আস্ফালন। শক্তির মদমত্ততা। আমাদের অহংবোধ, অপরিকল্পিত বাস্তব জ্ঞান, দিশাহীন প্রয়োগ, মাত্রাতিরিক্ত লালসা ও সমগ্র কে কুক্ষিগত করার অপূরণীয় আকাঙ্খা সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামহীন ব্যবহারে চুরমার হয়েছে পৃথিবী, লিটিলবয় আর ফ্যাট ম্যান এ বিধ্বস্ত জাপান। এই সময়কালের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে চলেছে দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ।এমন একটি সময় মানুষ একটি সমাজের স্বপ্ন দেখলেন, যেখানে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রতিযোগিতা নয়, বরং প্রাধান্য পাবে সমাজের সকল মানুষের মধ্যকার সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধতা। সেই সমাজে মুক্ত বাজারই নিয়ন্ত্রণ করবে সকল পণ্যের চাহিদা ও যোগান।
মনে পড়ে গেল সেই স্থবির মুহূর্তের কথা । মহাযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের মুহূর্তে তিঁনিই তাঁর হাত ধরে সময়কে স্তব্ধ করে দিয়ে দেখালেন তাঁর অনন্তরূপ। মুহূর্ত কে ভেঙে দিলেন ভগ্নাংশে আর ভগ্নাংশ কে ইউক্টোসেকেন্ডে। আর এই থেমে থাকা প্রবাহমান সময়েও ঘটে চলেছে সেই একই মুহূর্ত গুলির প্রতিচ্ছবি। সময়ের এই খন্ডিতাংশে ঘটে চলেছে রাজনীতির হিসেব নিকেশ । ভগ্নাংশের হিসেব যা আমাদের জিডিপির ঋণাত্বক গতি নির্ধারণ করে চলেছে। সময়ের ভেতর অন্যরকম সময়ের আবর্তে বাঁধা পরে অসাম্য সময়ে হারিয়ে ফেলছি রাষ্ট্রায়ত্ত ভাবনার হিসেব।
তাহলে সময় কী? আর অসময় ই বা কী?আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগৎ কে ধারন করার জন্য একটা চতুর্মাত্রিক বস্তু প্রয়োজন যাকে আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় বলতে পারি। ক্যালকুলাসের ভাষায় (d/dt (x,y,z)= constant) । অর্থাৎ সময় এলো । সময়ের সাথে এলো দুঃসময় । তাহলে একটি দাঁড়িপাল্লার এক দিকে সময় রাখলে অপর ওই পাল্লায় কি অসময় বা দুঃসময় !! অর্থাৎ যে সময় কেউ ভালো সময়ের আবর্তে আনন্দ করছেন ঠিক সেই সময় সময়ের অন্যদিকে কি কেউ সময়হীনতায় ভুগবেন? সময়ের সংজ্ঞা হল, “দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী ব্যবধান।” কিন্তু, আমাদের অভিজ্ঞতা দেখায় যে সময় কোন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, কিছু ঘটুক আর না ঘটুক, সময় তার নিজের মতোই বয়ে চলে।এই বয়ে যেতে যেতেই রাম জন্মভূমি আসে, আসে রাফায়েল পর্যায়ক্রমে চলে আসে শবরীমালা মন্দির আসে সার্বিক শিক্ষা, ভুয়ো এনকাউন্টার হটাৎ ভ্রু ভ্রূউম ভ্রূমম করে চলে আসে হার্লে ডেভিডসন । একজন দার্শনিক দাবি করেছিলেন যে সময় বলে আদৌ কিছু নেই, এটা শুধু কল্পনা। কিন্তু যে সময়কে ঘিরে আমাদের জীবনে এত অভিজ্ঞতা, এত ঘটনা রয়েছে সেটা কি শুধুই আমাদের কল্পনা?
কিছু তো কৌশল ছিলই। যখন আমরা এটোসেকেন্ড আর ফেমটোসেকেন্ডের সময় পার্থক্য মাপতে ব্যাস্ত সেই সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুকনার প্রবল প্রতাপে আমাদের সমাজ বিপর্যস্ত। একসাথে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে আমরা হয়ে যাই একক। ঠিক যেন কুচকুচে কালো আকাশের ভেতর এক একটি বিন্দু। সকলেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যাস্ত পারস্পরিক দূরত্ব নিয়ে। থালা বাজানোর শব্দতরঙ্গে সময় হীন সময় কে ফিরিয়ে আনে! মোমবাতির আলোকবিচ্ছুরণে নির্গত আলোক তরঙ্গ সময়ের এই থেমে থাকার তাৎপর্য বাড়িয়ে তোলে ।
দুঃসময়, তাই পথ হয়ে চলে অসীম। তবুও পায়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে সময়ের আবর্তে সময়হীন বিন্দু গুলো এগিয়ে চলে মহাপ্রস্থানের পথে। কেউ কেউ পথেই রয়ে যায়। শব জমে শব জমতে থাকে, শবের পাহাড় হয়। পাহাড়ের উপর রাজসিংহাসন। রাজা ব্যাস্ত রাজকার্যে।তাঁর শাসনে মুদ্রা আসবে, তাঁর বদল আসবে। বিপর্যস্ত হবে অর্থনীতি , দেশের উৎপাদন বাণিজ্য নিন্মমুখী। শিল্পনীতি একমুখী । স্বাস্থ্য পরিকল্পনা উন্নয়ন শুধুই প্রচার সর্বস্য। এই সময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাই একমাত্র সম্বল। আর যুদ্ধের জিগির তুলে দেশবাসীর ভাবনার অভিমুখ বদলে দেওয়াই তো রাজার খেলা ।সময়ের এই এলোমেলো সময়ে রাষ্ট্রের সম্রাট গান গেয়ে চলেন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের পক্ষে গানের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ে দশক থেকে দশকে TINA (There is no alternative), বা ‘ক্যাপিটালিজমের কোন বিকল্প নেই’ কিম্বা ‘অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দেশের বাজার কে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে, উদারীকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।’ ।আর এসব ঘটে যায় স্থবির সময়ের ভেতর। সময়ের এই ঘূর্ণি পাকে আমরা ক্রম নিমজ্জিত হবো প্রাচীন রীতিনীতিতে, ধর্ম ভিত্তিক শ্রেণী বিভাজনে ভেঙ্গে যাবে আমাদের সমাজ । প্রাচীন ঝাড় ফুঁক , মন্ত্র তন্ত্র আর স্বৈরাচারী মননে ।চেতনার পরাশক্তি জাগ্রত হবে ।আমরা পেছাতে থাকবো ।আমাদের মননের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকবে সংস্কার এবং এক পর্যায়ে এসে আমরা আমাদের নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে দাস হয়ে পড়ব ধর্মের, যাকে “ধর্মীয় অনুশাসন” নামে চালানো হয়। এই অনুশাসন মানুষ কে মুসলমান বানায়, হিন্দু বানায়, শিখ বানায় তারপর একজনকে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক চিন্তার জায়গাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ধর্ম।
সময়ের এই ঘড়ির কাঁটায় দ্রুত বয়ে যাওয়া বিষাদের দরবারী রাগে নাকি বুক জুড়ে থাকে নিযুত স্মৃতির শালবন এক একটা পাতা ঝরার মত দূর প্রবাস কিংবা দেশ প্রবাসে মন ভার করে থাকে প্রেয়সীর অশ্রু বিন্দু ।এর আবেশে টলমল করে ওঠে পা ভেজানো টলটলে দীঘির জল ।কুয়াশায় হারিয়ে ফেলা ট্রাম,ব্যাস্ত রাস্তায় অস্পষ্ট তরুণীদের মশগুল গল্পবিলাস।রাস্তার মোড়ে লাল চায়ের বাহাদুরি ।এসবই তো সময় যা আমাদের ক্যালেন্ডার মানচিত্র জুড়ে থাকে।শুধু শব্দভূখ প্রহরে প্রতিটি নুতন ভোর চেষ্টা করে অতিক্রমের ।
এই সময়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্সকেই সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ ক্ষেত্র হিসেবে ভাবা হয়। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বমতে, আমাদের এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই সমান্তরাল কিছু মহাবিশ্ব রয়েছে, যেখানে সময় ঠিক আমাদের উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, বিশ্বজগতের কোথাও হয়তো বা এমন একটি মহাবিশ্ব আছে, যেখানে হয়তো আমাদের মতোই ছায়াপথ আছে, আছে নানা নীহারিকা। সেখানেও হয়তো সৌরজগতের মাঝে পৃথিবী নামে নীলাভ একটি গ্রহ আছে, যে গ্রহে হয়তো এই মুহূর্তে আপনার মতো দেখতে কেউ একজন সময়ের এই অতলস্পর্শী আবাহনে অসীম আগ্রহ নিয়ে লেখালেখি নিয়ে মগ্ন ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন