অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

করোনা কালের চালচিত্র




অব্যয়কথা
========================

আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল করোনা কালের সাঁঝে আমার দিন ফুরালো পৃথিবী ব্যাপী সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ যাদের এই সময়ে দিন ফুরিয়ে গেল সাক্ষাৎ মৃত্যু শিয়রে নিয়ে আরও কয়েক ঘন্টা জীবনের শেষ শ্বাস নিতে নিতে পরিবার প্রিয়জন হৃদয়ের সম্পর্ক শরীরের সম্পর্ক অর্থ বিত্ত নাম যশ প্রতিপত্তি এইসব কিছু ছেড়ে যেতে যেতে যাওয়ার সময়ে কি ভাবে জীবনের শেষ অংক মেলাচ্ছিলেন তাঁরা ? যাঁরা তখনো সজ্ঞান কিন্তু বুঝতে পারছিলেন দিন ফুরিয়ে এলো আর উপায় নাই লিমিটেড ওভার ক্রিকেটের মতো হাতে আর একস্ট্রা ওভার নাই দেরি নাই শেষ বলের ডেলিভারির কি এক আশ্চর্য্য সমাপতন একদিন ডেলিভারি রুমেই হোক আর আঁতুর ঘরেই হোক ডেলিভারি হয়েছিল শিশুরূপে মাতৃগর্ভের পর্ব থেকে আর এবার শেষ বলের ডেলিভারির সামনে অসহায় আত্মসপর্মণ জীবনের পার্থিব পর্ব থেকে মৃত্যুর কোলে ডেলিভারি না কেউই প্রস্তুত ছিলেননা ২০২০- এই শেষ ওভারের মতো এও যেন সেই টি-টুইয়েন্টি ক্রিকেটের মতোই নাই কোন সেকেণ্ড ইনিংস নাই কোন একস্ট্রা ওভার শিয়রে মৃত্যু নিয়ে যাঁরা শুয়েছিলেন তাঁদের শেষ কয়টি দিন এই পৃথিবীর শেষ শয্যায় কি ভাবছিলেন সেই মানুষগুলি ? অবশ্যই প্রিয়জনদের মুখগুলিই সেই ভাবনা প্রকরণের মুখ্য অংশ হওয়ার কথা কিন্তু তবু সজ্ঞানে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় এই পৃথিবীর যাবতীয় রূপরস রহস্য ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে জেনেও নিশ্চয় শেষ ভরসা রাখতে চেয়েছিলেন হাসপাতাল , চিকিৎসা পরিকাঠামো, ডাক্তার ওষুধের উপরেই যদিও জানাই ছিল করোনা জব্দের কোন ওষুধ নাই মানুষের তূণে হয়ত নিজ নিজ ইষ্টদেবতারই স্মরণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেই মানুষগুলি ঘোর নাস্তিক না হলে

কিন্তু আমরা কি অনুমান করতে পারি সীমাহীন শারীরীক কষ্টের ভিতরে মরণাপন্ন সেই মানুষগুলির মনের অবস্থা এই হঠাৎ মৃত্যুর সামনাসামনি হয়ে কি ভাবছিলেন তাঁরা কি ভাবার চেস্টা করছিলেন বা বিশ্বব্যাপী এই মহামারীর ঘোরে একাকার সব মহাদেশ একাকার সবদেশ একাকার সব জাতি একাকার সব বর্ণ একাকার সব ধর্ম একাকার সব সম্প্রদায় মৃত্যু আর এই করোনা জাত ধর্ম বর্ণ ভাষা দেশ মহাদেশ নাগরিকত্ব সবকিছুর উর্ধে উঠে সব মানুষকে মৃতদেহে পরিণত করে দিয়ে সব একাকার করে দিয়ে চলেছে আর আমরা জীবিতেরা তখনো মহাশক্তিধর পাশ্চাত্য মিডিয়ার তর্জনীর নির্দেশে নৃত্য করছি মিডিয়াযার বিরুদ্ধে আমাদের রাগ দেখাতে বলছে মিডিয়া যাকে করোনার জন্য দায়ী করতে বলছে আমাদের আমরা কেমন যুদ্ধং দেহী হয়ে সেই মিডিয়ার প্রোপাগাণ্ডায় আস্ফালন করে চলেছি আবার মিডিয়া যখন করোনার জন্য নিজামুদ্দিন নিজামুদ্দিন করে আসরগরম করছে আমরাও কেমন ভেড়ার পালে পরিণত হয়ে গিয়ে সেই দিকেই তাকিয়ে থাকছি অন্ধের দৃষ্টির মতো স্থির চোখে আর আমাদের আশেপাশে মৃত্যুর মিছিল এগিয়ে চলেছে সবকিছু একাকার করে দিতে দিতে সেখানে কার কোন দেশের পাসপোর্ট কার ঈশ্বর কত বড়ো অমোঘ কার অভিজাত্য বিশ্বশ্রেষ্ঠ কে ধনী কে নির্ধন কেমন সব কিছু নিরর্থক করে দিয়ে শেষ হাসি হাসছে সেই অমোঘ মৃত্যুই তবু আমাদের চোখ ঘুরছে মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত নির্দেশেই
আজও আমাদের অসাড় চিন্তা চেতনার জড়তা কাটলোনা বরং আরও বেশি করে থালা বাজানো আলো নেভানো পুষ্প বৃষ্টি দেখার মিছিলে ভিড় বাড়তেই থাকলো আরও বেশি করে ট্রাম্প সাহেবের দেওয়া হোমটাস্কে চীন চীন চীৎ কারে গগন বিদীর্ণ করে দুই টাকার রাফায়েল বিমান দুই হাজার টাকায় কিনে শত্রুর বুকে হৃদকম্প ধরিয়ে দিলাম ভেবে কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে উঠছি প্রত্যেকেই এদিকে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরী শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বেশি করে সরকারীলগ্নী জ্ঞানবিজ্ঞান গবেষণায় অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধির মতো জরুরী বিষয় গুলির দিকে না তাকিয়ে আমরা তাকিয়ে আছি, সেইসব দিকেই যে সবদিকে আমাদের দৃষ্টি আটকিয়ে রাখলে লাভ শুধু মাত্র ক্ষমতার মগডালে বসে থাকা হনুদেরই আমাদের নয়

করোনাকালের এই ঘোরসংকটও আমাদের সংবেদনশীলতায় সেরকম কোন ঢেউ তুলতে পারেনি যতটা ঢেউ তুলতে পেরেছে ক্ষমতার মদত পুষ্ট মিডিয়া সেই মিডিয়ার নির্দেশেই বাঁদর নাচ নেচে চলেছি আমরা প্রতিদিন আর ভাবছি আমি নিরাপদে রয়েছি তাই যে মানুষটির মৃত্যুর টিকিট কনফার্ম হয়ে গেল এই মুহুর্তে তার মনের নাগাল পাচ্ছিনা কোন ভাবেই আমি তখন লাইভে আসর জমিয়ে তুলছি লকডাউনের নিয়োনর্ম্যাল জীবন শৈলীর রাজপথে দাঁড়িয়ে আমি ভাবতেও চাইছিনা সেই সব মৃত মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষগুলির কথা যাদের জীবন কাহিনীর দ্য এণ্ড হয়ে যাওয়ার কথা ছিলনা এই ২০২০-তেই সাত লক্ষেরও বেশি মৃত দেহ বহন করতে করতেও আমার মনের বন্ধ দরজা খুলছেনা আমি ভাবতে চাইনা বুঝতে চাইনা আমি ভাববো বুঝবো বলবো শুধু মিডিয়ার মুখস্থ করিয়ে দেওয়া বুলিই না, তার বাইরে চোখ মেলতে কে আর চায় বরং এই যে সান্ধ্য লাইভের জলসায় পরস্পরের মুখ দেখার দৈনন্দিন মৌতাত এওতো করোনারই দান এতখানি অবসর আমাদের নিত্যদিনের জীবনে আগে কবে ছিল আর?

তাই যে মানুষটি কেএইমাত্র ঢোকানো হলো আসিসিইউতে এই বিশ্বের এতো হাওয়া এমন মধুর বাতাস লকডাউনের হাতে গরম ফলাফলে অনেক বেশি নিরাপদ দূষণহীন বাতাস সেই বাতাসই কম পড়ছে এই মুহুর্তে যাদের সেই কষ্টগুলি কেন ছুঁতে পারছেনা আমার হৃদয় ? কেন স্পর্শ করতে পারছেনা আমার চেতনা কেন ঠেলতে পারছেনা,  আমার বিন্ধ্যাচলের মতো অটল স্থবির জড়পিণ্ডবৎ অনুভুতিকেই ? নাকি , রোজাকার দুইবেলা মিডিয়ার বড়ি সেবনে আর উপায় নাই কোন ? মৃত্যুর আগেই মৃত হয়ে গিয়েছে আমার মানবিক অনুভুতি সংবেদনশীল মন মনন

নয়তো আমিইবা কেন, এমন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছি কে আমার শত্রু কাকে আক্রমণ না করলেই নয় ? কাদের হাত থেকে দেশ কে রক্ষা করতে গেলে কোন স্লোগান আউড়িয়ে দেশ প্রেমের প্রমাণ দিতে হবে এখন ? অথচ কিছুতেই বুঝতে চাইছিনা, শিয়রে মৃত্যু নিয়ে শেষ কয়টি মুহুর্তগুনতে থাকার মর্মন্তুদ বেদনাকে যখন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ লক্ষ লক্ষ প্রাণের শেষ ঘন্টা বাজিয়ে দিচ্ছে, ঠিক তখনই আমিও শিং বাগিয়ে যুদ্ধযুদ্ধ আস্ফালনে গগন বিদীর্ণ করে হুঙ্কার দিয়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছি কেন হচ্ছি ? বাধ্য ? সেই প্রশ্নটুকু করার ক্ষমতাও আজ আরআমার নাই অথচ সেই আমিই কিন্তু কষ্ট পাচ্ছিনা এই সাত লক্ষ মৃতদেহের ভারও আমার বোধকে নাড়া দিতে পারছে না কেন এই মৃত্যু মিছিল কেন প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে বেড নাই হাসপাতালে কেন প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে ভেন্টিলেটর নাই? অথচ প্রতিটি মানুষেরই জন্য রয়েছে হাজার হাজার বুলেট লক্ষ লক্ষ মিসাইল শতশত এটোমবোম না তাতেও আমাদের আপত্তি নাই কোন প্রতিটি মানুষের জন্য একটা জীবিকার নিশ্চয়তা নাই কিন্তু প্রতিটি মানুষের উপরে নির্ধারিত ট্যাক্স রয়েছে যে ট্যাক্সের টাকাতেই দুইটাকার রাফায়েল কেনা হচ্ছে হয়েছে হবে দুই হাজার টাকায়

মানুষে মানুষে বিভেদ বিদ্বেষ বিভাজনের এই রাজনীতির শিকার হতেহতে আমরা আসলেই কি আর জীবিত রয়েছি ? চোখের সামনে করোনার দৌরাত্ম্য আমাদের সামনে বোধবুদ্ধির দিগন্তকে সম্পূর্ণ খুলে দিতে চাইছে অথচ আমরা কেউ সেইদিকে তাকাবোনা করোনা প্রমাণ করে দিয়েছে রোগ শোক আর মৃত্য মানুষের বিভেদ বিদ্বেষ বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় অসম্ভব যেদিন আমাদের অন্ধকার চেতনায় আলো ফুটবে সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই সেইদিনই মানুষ প্রতিরোধ করতে পারবে মানুষে মানুষে বিভেদের ভাইরাস থেকে শুরু করে যুদ্ধের ভাইরাস, বিদ্বেষের ভাইরাস, শোষণের ভাইরাস, ধর্ম রাজনীতির ভাইরাস নয়তো শুধুমাত্র করোনার সাথে মোকাবিলায় মানুষ সত্যিই কোন নতুন দিনের আলোতে গিয়ে পৌঁছাতে পারবেনা একটা করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে করতে হানা দেবে আরও ভয়ঙ্কর নতুন একটি ভাইরাস চলতে থাকবে মৃত্যুমিছিল যুদ্ধ মাহামারী দুর্ভিক্ষের

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন