অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

ছোট্ট টিয়ে গুনগুনি

 


ছোট্ট টিয়ে গুনগুনি  

******************************
নাসির ওয়াদেন
******************************

" চাঁদ ওঠেছে , ফুল ফুটেছে
কদম তলায় কে?
হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে
সোনামণির বে '-"


জ্যোৎস্নামাখা স্ফূর্তিভরা আলো এসে পড়েছে উঠোনের উপর । রমাপতি তার চার মাসের নাতিকে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে ছড়া কাটছে । অস্থির সায়ন চুপ করে আছে দাদুর কাঁধে । কী এক অসীম ভালবাসার জোছনা বশ করেছে শিশু মনকে । আকাশের চাঁদ ফালি ফালি মেঘের ফাঁক দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অন্য দেশে, অন্য আলয়ের খোঁজে ।


সকাল হয়েছে সবেমাত্র । পুবের আকাশে সোনালি কিরণ নিয়ে সূর্য্যিমামা জেগে ওঠেছে এক লম্বা ঘুমের বিছানা থেকে । হঠাত বাড়ির ছাদের লম্বা রেলিঙে উড়ে এসে বসল একটি ছোট্ট টিয়েছানা । মুখে শিস কাটছে, পিসু ! পিসু !


সাতসকালে ' পিসু ' ডাক শুনে চমকে উঠে রমাপতি । কে ডাকছে পিসুকে । পিসু রমাপতির বড় ছেলে । ত্রিশ বছর আগে আলোর দেশে চলে গেছে । লেখাপড়ার সাথে সাথে ছবি আঁকার নেশা ছিল তার । একবার এক কম্পিটিশনে একটা ছবি এঁকেছিল, " ছোট্ট পাখি গুনগুনি "।


একটা বাচ্চা টিয়ে ছানা । মাহারা ছানাটির পায়ে শেকলের দাগ। কোন এক হতভাগা ছেলে গাছে চড়ে বাসা থেকে চুরি করে এনেছিল ছানাটিকে। তারপর শেকলের বেড়ি পরিয়ে খাঁচাবন্দি করে রাখা । মাতৃহারা শিশুছানাটি মনের দুঃখে, বন্দিদশায় জীবন কাটিয়ে বড় হয়েছে এতদিন । অবশ্য যত্ন আত্তির ত্রুটি ছিল না, কিন্তু মাতৃপিতৃহীন সন্তানের কিছুতেই মনে শান্তি নেই ।


বনের ধারে ছোট ডালিম গাছে বাসা বেঁধেছিল এক টিয়ে দম্পতি । তাদের কোল ভরে দিয়েছিল গুনগুনি । চাঁদের আলোর মত উজ্জ্বল ছিল তাদের লতাপাতা খড়কুটো দিয়ে নির্মিত একটি ছোট নীড়।
সকালবেলা হলেই পাখিমা আর বাবা উড়ে চলে যেত খাবারের খোঁজে, দূরে গাঁয়ের পথে । বাড়ি বাড়ি খোঁজ চলত পরিত্যক্ত খাবারের । এক সময়ে কিছু পরিত্যক্ত খাবার পেলে ভাঁড়ার থেকে ঠোঁটে তুলে এনে খাওয়াত গুনগুনিকে। নদীর ধারে ফোটা কাশফুল উজ্জ্বল আলোর ছন্দে ঢেউ খেলে, তেমনি বেশ সুখে কেটে যাচ্ছিল এক সুখি দম্পতির সোনায়গলা এক আলোর সংসার । 


এক চঞ্চল কালবৈশাখী ঝড় এসে একদিন তছনছ করে দিয়েছিল সুখি কুলায় ।ভেঙে পড়ে সোহাগের সংসার, সোনালি বাসা, নির্মল আনন্দভূমিতে । ভেঙে গেল বাসা, সেই ভগ্নালয় থেকে এক দুষ্টু বালক চুরি করে নিয়ে আসে খোকা গুনগুনিকে । সেই যে মাতৃহারা হল, আজও খুঁজে পাইনি তার হারিয়ে যাওয়া পরিবারকে । মনে দুঃখ নিয়ে খাঁচাজীবন কেটে যাচ্ছিল তার।


বিধাতার নির্মল আর ভাগ্যের পরিহাসে একদিন খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে অনন্ত আকাশে পাড়ি দিয়ে চলেছে সেই ছোট্ট ছানাটি । তার " পিসু! পিসু! " ডাক তার কাছে পরমাত্মীয় হয়ে গেছে । পলাশ, শিমুলের রঙিন ফুলের সৌরভ যা তার খুব পছন্দের ছিল, আজ শরতের আকাশে আগমনী বাজনার সুর সঙ্গে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার মিস্টি ডাক, শিউলি,শেফালির গন্ধকে বুকে টেনে আনে। 


" আতা গাছে তোতাপাখি
ডালিম গাছে মউ,
হীরেদাদার মড়মড়ে থান
ঠাকুরদাদার বউ । "


ছোট্ট সায়ন দাদুর কাঁধে চড়ে, ভোরের স্নিগ্ধ শেফালি বাতাসের ঠান্ডার স্পর্শ মেখে অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে । ছানাটির মিস্টি ডাক শুনে রমাপতি একবার তার দিকে তাকাল । দেখে, একটা ছোট্ট টিয়েছানা তাদের বাড়ির ছাদের রেলিঙে বসে ডাকছে -- ' পিসু! পিসু! '


সেই পাখিছানাটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দাদু তার নাতি সায়নকে কিছু বলতে চাইছে। ছোট্ট শিশুটি এক অচেনা অদ্ভূত পাখির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে । দুই অবোধ শিশুর মাঝে দীর্ঘ এক ব্যবধান, মুহূর্তে কাছাকাছি এসে এক সমবিন্দুতে মিলিত হতে চাইছে । মুখের ঠোঁটে এক অফুরন্ত আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সায়নের । ভোরের বাতাসে মিশে যাচ্ছে এক অদ্ভূত অনুভূতি মেশা দেবীমায়ের ঢাকের আওয়াজ ।


ছোট সায়নের দিকে চেয়ে নীরব হয়ে গেল পাখিছানাটি । জানা নেই, কী বুঝেছে সে, তবুও যেন এক ভালবাসার, আনন্দের ছবি তারও চোখেমুখে । উল্লাসে দু' ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এল তারও চোখ থেকে । সেই দু'ফোঁটা অশ্রু মুক্তোর মত মনে হল রমাপতির । নাতির চোখেও দু'ফোঁটা অশ্রু নেমে আসছে ।
এক বিরল দৃশ্যের ছবি রমাপতির হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন