অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

জীবনের পাঠশালা

 

জীবনের পাঠশালা
*********************
সুদীপ পাঠক
*********************



চিত্র : ১

মা -- স্কুল বাস থেকে নেমে এপার্টমেন্ট পর্যন্ত হেঁটে আসতে তোমার যাতে কোনো কষ্ট না হয় তার জন্য আমরা রিক্সার ব্যাবস্থা করেছি । মাসে মাসে কত টাকা খরচ হয় তা তুমি জান কি ?

বুবাই -- না মা জানি না ! তুমিই তো বল যে বড়দের সব কথার মধ্যে ছোটদের থাকতে নেই ।

মা -- আমি আশা করেছিলাম এটুকু বোঝার মতন বুদ্ধি তোমার হয়েছে । এখন দেখছি আমারই ভুল ।

বুবাই -- তুমি রাগ করছ কেন মা !? আমি কি দোষ করলাম সেটা তো একবার বলবে ?

মা -- রিক্সার ব্যবস্থাটা শুধু তোমার জন্য । তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের জন্য নয় । এবার বুঝলে কিছু ?

বুবাই -- কিন্তু মা পিকু তো আমার বন্ধু ! আমরা একই কমপ্লেক্সে থাকি , একসঙ্গে খেলি , একই ক্লাসে পড়ি , তাহলে...

মা -- চুপ কর , বাজে বোকো না । একই ক্লাসে পড়লে আর একসঙ্গে খেলা করলেই কেউ বন্ধু হয়ে যায় না বুঝলে । তুমি কোন স্কুলে পড় আর ও কোন স্কুলে পড়ে একবার ভেবে দেখছো কি ? স্টেটাস বলে একটা ব্যাপার আছে । ও সব তুমি এখন বুঝবে না । এবার থেকে কারকেই তোমার রিক্সায় তুলবে না , OK ?



চিত্র : ২

বাবা -- কতবার রিকোয়েস্ট করার পর তবে তোমার স্কুলের টিচার তোমাকে প্রাইভেটে পড়াতে রাজি হয়েছেন তা তুমি জানো না ?

বুবাই -- হ্যা জানি বাবা ।

বাবা -- জানো যদি তবে এত দয়ার সাগর হচ্ছ কিভাবে ? তোমার জন্য স্যার যে নোটস দিয়েছেন তা অকাতরে অন্যদের মধ্যে বিলোচ্চ কেমন করে শুনি ?

বুবাই -- কারণ ওরা সবাই আমার বন্ধু বাবা , আমার ব্যাচমেটস ।

বাবা -- বুলশীট । বন্ধুত্ব পাতাতে গেলে কেরিয়ার গড়তে পারবে না বুঝেছ ? কেন তোমাকে ঐ স্যারের কাছে কোচিং দেওয়ানো হচ্ছে তা জানো ?

বুবাই -- জানি বাবা , কারণ উনি খুব ভালো পড়ান তাই ।

বাবা -- তোমার মুণ্ডু , ফাইনাল এক্সামে উনি পেপার সেট করেন তাই । স্কুল টিচারদের প্রাইভেট টিউশন পড়ানো বারণ , তাও স্যার পড়াচ্ছেন শুধুমাত্র তোমার মুখ চেয়ে । এই কথাটা সকলে জেনে ফেললে কি সর্বনাশ হতে পারে তার কোনো আইডিয়া আছে তোমার ?

বুবাই -- কিন্তু যে কাজ করা উচিৎ নয় সেটাই যদি করা হয় তবে তো সেটা অন্যায় করা হচ্ছে ।

বাবা -- জাস্ট শাট আপ । ন্যায় অন্যায়ের তুমি কি বোঝো ? সে সব বোঝার মতন বয়স তোমার এখনো হয়নি । মনে রাখবে এই পৃথিবীতে কেউ তোমার বন্ধু নয় , সবাই প্রতিযোগি , OK ??



চিত্র : ৩

বুবাই -- পিসিমনি তুমি তো দেখছি বাড়িতেই রয়েছো , তবে সোমাদি যখন ফোন করল কেন বললে যে এখনই শপিং-এ বেরোবে ? তুমি তো টিভি দেখছো !!

পিসি -- এভয়েড করার জন্য সিম্পল । এটাও বুঝলি না !

বুবাই -- কিন্তু কেন এড়িয়ে যেতে চাইছো সেটা তো বলবে ?

পিসি -- বাড়িতে আছি বললেই এখনই চলে আসত যে ।

বুবাই -- বাহ তা হলে তো দারুণ হতো । ক্যারাম খেলা যেতো।

পিসি -- দুর বুধুরাম। তোর সোমাদি কেন আসতে চাইছিল জানিস ? সোয়েটার বোনার নতুন ডিজাইন শিখতে । তাই কাটিয়ে দিলাম আর কি ,বুঝলি ?

বুবাই -- কেন এমন করলে ! শেখালেই তো পারতে ?

পিসি -- তোর কি মাথা খারাপ নাকি বলতো ? আমি কত কষ্ট করে ঘুরে ঘুরে দামী বই কিনেছি , তারপর সেই বই পড়ে কত কষ্ট করে বুনতে শিখেছি ।এত সহজে সেটা অন্য লোককে শিখিয়ে দেবো , তাই আবার হয় নাকি !?

বুবাই -- কিন্তু সোমাদি তো তোমাকে কত নতুন নতুন রান্নার রেসিপি শিখিয়েছে । সরস্বতী পূজোর সময় কত বড় অল্পনাটা একা হাতে এঁকে দিলো তার বেলা ?

পিসি -- একেই বলে আর্ট অফ লিভিং । মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে লোকের কাছ থেকে কাজ হাসিল করে নিতে হয় । তাই বলে নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে দাতা কর্ণ হতে নেই বুঝলি ? ওতে কোনো লাভ হয় না , OK ???



চিত্র : ৪

বুবাই -- দাদু তুমি কেন বাড়ী ছেড়ে এসে ওল্ড এজ হোমে থাকতে শুরু করলে ? আমার একটুও ভালো লাগে না।

দাদু -- তুমি ভুল করছো গো দাদুভাই । এটা কোনো ওল্ড এজ হোম নয় । এটা হলো একটা আশ্রম । আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু যারা একইরকম ভাবে ভাবনা চিন্তা করি তারা সবাই মিলে নিজেরাই এই আশ্রম গড়ে তুলেছি । প্রাচীনকলে বানপ্রস্থ আশ্রম যেমন ছিল ঠিক সেরকম । আমাদের স্বভূমি ।

বুবাই -- এত নির্জন জায়গায় থাকতে তোমার ভালো লাগে ?

দাদু --নিশ্চই , ভালো লাগে বলেইতো এখানে থাকি । আমার প্রাণের আরাম , মনের আনন্দ , আত্মার শান্তি খুঁজে পাই যে এখানে ।

বুবাই -- দাদু তুমি যতই আমাকে ভোলাবার চেষ্টা কর না কেন , আমি এখন বড় হয়ে গেছি , আমি এখন সব বুঝতে পারি ।

দাদু -- হা - হা - হা তাই নাকি ! দাদুভাই আমার বড় হয়ে গেছে বুঝি ?

বুবাই -- হয়েছিই তো , আমি সব জানি সব বুঝি । তুমি চলে আসার আগে মাকে বলতে শুনেছি , মা বাবাকে বলছে "এখানে আমার সফোকেশন হচ্ছে । স্পেস চাই আমার নিজের স্পেস চাই , তুমি ইমিডিয়েটলি কিছু একটা ব্যবস্থা কর , না হলে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হব" । আমার খুব কষ্ট হয় দাদু , কান্না পায় ।

দাদু -- দুঃখ করো না দাদুভাই , তুমি চট করে বড় হয়ে ওঠো । খুব বড় মাপের মানুষ হবে তুমি ।দেশের দশের একজন হবে । কূপমন্ডুক আর স্বার্থপর কখনও হবে না । পরশ্রীকাতর আর হিংসুটে হবে না । যথাসম্ভাব মানুষের উপকার করবে । সমাজের কল্যাণকামী হবে তুমি । আমার দাদুভাই বলে কথা , আমার মুখ উজ্জ্বল করবে তুমি ।

বুবাই -- আমি যদি একটা বিরাট বড় বাড়ী তৈরী করতে না পারি তবে জীবনে কোনোদিন বিয়েই করব না ।

দাদু -- কেন গো দাদুভাই ! বিয়ে করবে না কেন !?

বুবাই -- তা না হলে যে বাবাকেও আশ্রমে এসে থাকতে হবে ।

দাদু -- আচ্ছা বেশ তাই হবে । তুমি না হয় একটা রাজপ্রাসাদ বানাবে । এবার তোমাকে একটা মন্ত্র শেখাবো মন দিয়ে শোনো কেমন ।

বুবাই -- কি মন্ত্র গো দাদু ?

দাদু -- পবিত্র এক মন্ত্র। জগতে এর চাইতে সেকুলার মন্ত্র দ্বিতীয়টি আর হয় না। এই মন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংযোগ নেই । যে কোনো মানুষ এই মন্ত্রপাঠ করতে পারে । কোনো বাধা নেই । যদি কেউ সততা ও বিশ্বাসের সঙ্গে এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তবে সে ধী শক্তির অধিকারী হয়ে উঠবে ।

বুবাই -- কি সেই মন্ত্র ? আমাকে শিখিয়ে দাও দাদু ।

দাদু -- ওম ভূ ভূবস্বহঃ তৎসবিতুর বরেণ্যম ।

ভর্গদেবস্য ধীময়ী ধিয়য়েনহ প্রচোদয়াৎ ওম ।

বুবাই -- এটাতো সংস্কৃত শ্লোক ! এর মানে কি দাদু ?

দাদু -- হে নিরাকার ব্রহ্ম , হে ধরিত্রী , হে পরিমন্ডল তোমাদের সকলকে শত কোটি প্রণাম জানাই । তৎপরে কৃতজ্ঞচিত্তে বরণ করি আদি ও অনন্ত মহাশক্তির উৎস নক্ষত্র শ্রেষ্ঠ সূর্যকে । হে প্রজনন ও উৎপাদন শক্তির দেব ও দেবী তোমরা আমার প্রতি প্রসন্ন হও ও শক্তি প্রদান কর । আমার মধ্যে আত্মস্থ হও । যার ফল স্বরূপ আমি জগৎ সংসারের সুখ ও সমৃদ্ধির ধারক ও বাহক হয়ে উঠতে পারি ।

বুবাই -- দাদু আমি আজ তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি আজীবন এই মন্ত্র মনে রাখবো ।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন