যে সময়ের কথা বলবো এখন তখনও কলকাতা মহানগরীর তকমা পায়নি। নবাবরা তখন নিজেদের দাপট দেখিয়ে চলেছে আর ব্রিটিশরা সদ্য বাংলায় পা রেখেছে। কলকাতা তখনও নেহাতই একটা গ্রাম। আর সেই সময়েরই সুদূর বাগবাজার অঞ্চলে পঞ্চানন আচার্য নামে এক পণ্ডিত বাস করতেন। তিনি ছিলেন নির্ভুল ভবিষ্যত বক্তা,অনেক নামি-দামী মানুষ তার ঘরে আসতেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য। তিনি সারাদিন জ্যোতিষবিদ্যা আর ঠাকুর দেবতা নিয়েই পড়ে থাকতেন। তাঁরই একমাত্র ছেলে এককড়ি। বাবার মতই ছেলেও পুজো অর্চনা নিয়ে থাকত।
প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে গঙ্গায় ডুব দিয়ে সূর্য প্রনাম করে দিন শুরু হত দুজনের। এরকমই একদিন ভোরে এককড়ি গেছিলো গঙ্গাস্নানে। গঙ্গায় ডুব দিয়ে সবে পারে উঠেছে হঠাৎ দেখে তার ধুতির কুচিতে শক্ত মতো কি একটা আটকে আছে। হাতে নিয়ে দেখে একটা সাধারন দেখতে পাথর। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হল পাথরটা দেখতে সাধারন লাগলেও সূর্যের আলোয় সেটা চকচক করছে। দেবতার দান ভেবে পরম যত্নে সেটা হাতে মুঠো করে বাড়ির দিকে চলল এককড়ি আচার্য, এরকম জিনিষ বাবাকে না দেখালেই নয়।
বাড়ি ফিরে বাবার অনুপস্থিতি দেখে ঝট করে ঘরের দরজা বন্ধ করে পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো এককড়ি। কে জানে কোন জাদুবলে যেনো আঙ্গুলের রুপোর আংটিটা সোনায় পরিণত হয় গেছে। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলনা এককড়ি। মনে মনে খুব খুশি হলো যাক এতদিনে ঘরে শান্তি ফিরবে। হাটখোলা দত্তদের মত সেও জমিদার হয়ে যাবে। বাবা পণ্ডিত মানুষ তাকে পাথরটির এই বিশেষ গুনটি বললে তিনি কিছু বিধান দিতে পারবেন।
কিছু সময় পর বাবা ফিরতেই এককড়ি ছুটলো বাবার কাছে, "দেখো বাবা দেখো কি অদ্ভুত জিনিস আজ গঙ্গার বুক থেকে পেঁয়েছি। এমন পাথর যা রূপোকে সোনায় করে দেয়।”
পঞ্চানন কিছুক্ষণ পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, "এ সত্যিই এক বিশেষ পাথর। পরশপাথর। এ পাথর তোমার সব মনস্কামনা পূর্ণ করবে শুধু তাই নয় এ পাথর যেকোনো কিছুকে সোনায় পরিণত করে দেবে। তবে খুব বিপদে না পরলে এ পাথর ব্যবহার কোরোনা, তবে কিন্তু উল্টো বিপদ দেখা দেবে। এ পাথর কোনো গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে যাতে কেউ জানতে না পারে এর কথা।"
বাবার নির্দেশ অমান্য করার সাহস এককড়ির নেই। তাই সেটা ঘরে গিয়ে একটা কাঠের বাক্সোর মধ্যে রেখে ঠাকুরের সিংহাসনে শালগ্রাম শিলার পিছনে যত্ন করে রেখে দিলো। বাবা যাই বলুন না কেন, মন কি মানে তাই মাঝে মধ্যে পাথরটা বের করে এককড়ি কিন্তু পাথরের গুণ পরীক্ষা করে দেখতে ভয় পায়। বাবা জানতে পারলে খুব বকাঝকা করবে। কিন্তু একদিন প্রচন্ড কৌতহল হলো পাথরের জাদু পরীক্ষা করার। তাই পাথরটা হাতে নিয়ে নিজের মনে মনেই ঠিক করল, "বড় বড় জমিদাররা সব সোনার পালঙ্কে ঘুমায় এই পাথরের গুণে আমিও আমার বিছানাকে সোনায় পরিণত করতে পারি!!!”
যেমন ভাবা তেমন কাজ, তখনই ঠাকুরের সিংহসন থেকে শালগ্রাম শিলার পিছন থেকে কাঠের বাক্সটা বের করে সেই পাথরটা বিছানায় ছোয়ালো, কিন্তু নাহ….. কিছু তো হলো না, আবার ছোঁয়ালো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তবে কি পাথরের গুন সব হারিয়ে গেল। তারপর কি মনে হতেই সে নিজের তামার নস্যির ডিবেটাতে ছোঁয়ালো। অমনি নস্যির ডিবেটা সোনার হয়ে গেল। তখন এককড়ির ফুর্তি দেখে কে। সাথে সাথে ও এও বুঝলো একমাত্র ধাতুর জিনিসই এ পাথর সোনায় পরিণত করতে পারে। আর এটা না হলে তো পাথর যে কাঠের বাক্সে ছিল সেটাও তো সোনার হয়ে যেত!!! এই কথা বুজে উঠতেই সে ঘরের কোণায় ডাই করে রাখা কাঁসার থালা-বাসনের দিকে এগিয়ে গেলো। “আজ আমিও রাজা মহারাজাদের মতো সোনার থালায় ভাত খাব!!!” কিন্তু হঠাৎ দেখে পেছনে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে।
ছেলের এই কান্ড দেখে পঞ্চানন রাগে ফেটে পড়লেন!!! ওদিকে বাবার হঠাৎ আগমনে এককড়িও কেমন একটা পাথরের মতো হয়ে গেছিলো!!! এমন সময় নীরবতা ভঙ্গ করে পঞ্চানন বললেন, "তোমার এতো বড়ো সাহস তুমি আমার আদেশ অমান্য করে আবার এই পাথর বের করেছো!!! ছোট হয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা ভালো দেখছিনা!!! আজ শেষ বার সাবধান করে দিলাম তোমায়। আর কোনোদিনও খুব বিপদে না পড়লে শুধুমাত্র মজা করার জন্য এই পাথরের গুনের অপব্যবহার করবে না!!”
“কিন্তু আমরা তো আজই এই এলাকার সবথেকে বড়োলোক হয়ে যেতে পারি!!!” অবুঝ এককড়ির এরকম নির্বোধ কথায় পঞ্চানন আচার্য রেগে ছেলের গালে ঠাস করে একটি চর বসিয়ে দিলেন। “যে কথা বোঝোনা, সেই বিষয়ে নিজের মতামত দেবেনা!!! আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আজকের পর কখনও খুব দরকার ছাড়া এই পাথর তুমি বের করবেনা!!” বাবার ধাতানিতে চুপ মেরে যায় এককড়ি। সে তখন পাথরটা আবার বাক্স-এ ভরে সিংহাসনে নিজের স্থানে রেখে দিল।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৫ বছর। এককড়ি এখন তার বাবার মতই যজমানি করে দু-চার পয়সা উপার্জন করছে। প্রচুর পয়সা না থাকলেও সংসারে অভাব বলে কিছু নেই। ঘরে সুখ শান্তি আছে। ইতিমধ্যে এককড়ি বিয়েও করেছে। ঘর আলো করে তার একটা পুত্রসন্তানও হয়েছে। সেই পাথরের গুনে তার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। এর মাঝে এককড়ি পাথরটার জাদু একবারও ব্যবহার করেনি। কিন্তু সে এটা মেনে চলে পাথরটা তার জীবনে কতোটা মূল্যবান। পাথরটা তার জীবনে ভাগ্যলক্ষীর কাজ করছে।
কিন্তু মানুষের জীবনে লোভ বড় বালাই। ছেলেটা ছমাস বয়স হয়েছে। এবার অন্নপ্রাশন করতে হবে। এককড়ির ইচ্ছা তার ছেলের অন্নপ্রাশন জমিদারদের মত ধুমধাম করে করবে, প্রচুর লোককে খাওয়াবে। কিন্তু তার অতো সামর্থ্য কোথায়!!!!!
তার মনে পড়ে পাথরটার কথা।বাবার নির্দেশে পাথরটা এতদিন ব্যবহার করেনি। কিন্তু এখন একবার ব্যবহার করতেই পারে। কি এমন আর বিপদ ঘটবে। বরং ধুমধাম করে করলে সবাই এককড়ির প্রশংসাই করবে। সবার মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পরবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ এককড়ি নিজের ঘরে গিয়ে সিংহাসনের পিছনের দিক থেকে সেই বাক্সটা বের করল তারপর ধীরে ধীরে সেই পাথরটাও বের করলো। এত বছর বাদেও তার জৌলুস এখনও উজ্জ্বল আছে। এককড়ি পাথরটা তার ঘরে থাকা কিছু রূপো আর তামার জিনিসপত্রে ছোঁয়াল। ওমনি পাথরের গুনে সেগুলো সোনায় পরিণত হয়ে গেল। এককড়ির আনন্দ আর দেখে কে। ঘরের অনেক জিনিস সোনায় পরিণত করে সেগুলো নিয়ে স্যাকরার কাছে গেল এবং বিক্রি করে প্রচুর টাকা ঘরে নিয়ে এল।
তারপর এক শুভদিন দেখে ধুমধাম করে ছেলের অন্নপ্রাশন পালন করলো। বাইরে থেকেও প্রচুর লোক খেল তার মধ্যে কলকাতার অনেক বাবু জমিদার ও আছে। সবাই এককড়ির জয়গান গাইতে লাগলো। কিন্তু সবার মনেই একটা প্রশ্ন, “এই সামান্য যজমানী করে সে এত টাকা পেল কি করে??” অনেক চেনা জানা এককড়িকে চেপে ধরলো আসল কারণ জানার জন্য কিন্তু এককড়ি কিছুতেই বলছিল না। কিন্তু শেষে চাপে পড়ে এককড়ি পাথরটার কথা জানাতে বাধ্য হল। এই অদ্ভুত কথা কি আর চেপে রাখা যায়। ফলে লোকেমুখে এককড়ির পাথরের কথা সারা কলকাতাবাসী জেনে ফেলল। সবার মুখেই তখন এই পাথরের কথা।
এভাবেই লোকেমুখে পাথরের কথা নবাবের কানে গেল। যখনকার কথা বলছি তখন বাংলায়য় নবাবি শাসন। নবাব হুকুম দিল যেভাবেই হোক এই পাথর এককড়ি র থেকে নিয়ে আসতে হবে। এককড়ি প্রমাদ গুনল, এ পাথর হাতছাড়া সে কিছুতেই করতে চায় না, আবার না দিলে হয়তও নবাবের সেনারা এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে, মেরে ফেললেও আশ্চর্যের কিছুই নেই। এককড়ি এবার বুঝলো কেন বাবা তাকে লোভে পড়তে না করেছিল। কিন্তু বিপদ যখন এসেই গেছে আর তো কিছু করার নেই।
গভীর রাতে, এককড়ি চিন্তায় চিন্তায় জেগেই ছিল তবুও যখন অল্প তন্দ্রা মতো এসেছে, হঠাৎ যেন শুনতে পেল নবাব তার সেনাদের সাথে নিয়ে তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে!!! তাকে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে গাছের মগডালে ঝোলানো হবে, আর গ্রামের সবাই যেন সেটারই অপেক্ষা করছে!!! হঠাৎ ছেলে কেঁদে উঠলো!!! স্বপ্নে না বাস্তবে বোঝা গেলো না!! কিন্তু ছেলের কান্নার পরেই যেন এককড়ি দেখতে পেলো, হ্যাঁ ঠিক, বাবা!!!! “যেভাবে পেয়েছিলে সেভাবেই ফিরিয়ে দাও!!!” বাবার কথাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো এমন সময় ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে এককড়ি লাফিয়ে বসলো!!!
ধীরে ধীরে কলকাতা মহানগরীর হল। ব্রিটিশরাও ভারত ছেড়ে ২০০ বছর হল চলে গেছে। পাথরের কথাও এখন সবাই ভুলে গেছে তার সাথে সাথে এককড়িকেও। এখনও হয়তো পাথরটা কলকাতারই আশেপাশে বয়ে চলা গঙ্গার বুকে গেঁথে আছে তার হদিস কেউ জানে না!!!
প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে গঙ্গায় ডুব দিয়ে সূর্য প্রনাম করে দিন শুরু হত দুজনের। এরকমই একদিন ভোরে এককড়ি গেছিলো গঙ্গাস্নানে। গঙ্গায় ডুব দিয়ে সবে পারে উঠেছে হঠাৎ দেখে তার ধুতির কুচিতে শক্ত মতো কি একটা আটকে আছে। হাতে নিয়ে দেখে একটা সাধারন দেখতে পাথর। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হল পাথরটা দেখতে সাধারন লাগলেও সূর্যের আলোয় সেটা চকচক করছে। দেবতার দান ভেবে পরম যত্নে সেটা হাতে মুঠো করে বাড়ির দিকে চলল এককড়ি আচার্য, এরকম জিনিষ বাবাকে না দেখালেই নয়।
বাড়ি ফিরে বাবার অনুপস্থিতি দেখে ঝট করে ঘরের দরজা বন্ধ করে পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো এককড়ি। কে জানে কোন জাদুবলে যেনো আঙ্গুলের রুপোর আংটিটা সোনায় পরিণত হয় গেছে। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলনা এককড়ি। মনে মনে খুব খুশি হলো যাক এতদিনে ঘরে শান্তি ফিরবে। হাটখোলা দত্তদের মত সেও জমিদার হয়ে যাবে। বাবা পণ্ডিত মানুষ তাকে পাথরটির এই বিশেষ গুনটি বললে তিনি কিছু বিধান দিতে পারবেন।
কিছু সময় পর বাবা ফিরতেই এককড়ি ছুটলো বাবার কাছে, "দেখো বাবা দেখো কি অদ্ভুত জিনিস আজ গঙ্গার বুক থেকে পেঁয়েছি। এমন পাথর যা রূপোকে সোনায় করে দেয়।”
পঞ্চানন কিছুক্ষণ পাথরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, "এ সত্যিই এক বিশেষ পাথর। পরশপাথর। এ পাথর তোমার সব মনস্কামনা পূর্ণ করবে শুধু তাই নয় এ পাথর যেকোনো কিছুকে সোনায় পরিণত করে দেবে। তবে খুব বিপদে না পরলে এ পাথর ব্যবহার কোরোনা, তবে কিন্তু উল্টো বিপদ দেখা দেবে। এ পাথর কোনো গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে যাতে কেউ জানতে না পারে এর কথা।"
বাবার নির্দেশ অমান্য করার সাহস এককড়ির নেই। তাই সেটা ঘরে গিয়ে একটা কাঠের বাক্সোর মধ্যে রেখে ঠাকুরের সিংহাসনে শালগ্রাম শিলার পিছনে যত্ন করে রেখে দিলো। বাবা যাই বলুন না কেন, মন কি মানে তাই মাঝে মধ্যে পাথরটা বের করে এককড়ি কিন্তু পাথরের গুণ পরীক্ষা করে দেখতে ভয় পায়। বাবা জানতে পারলে খুব বকাঝকা করবে। কিন্তু একদিন প্রচন্ড কৌতহল হলো পাথরের জাদু পরীক্ষা করার। তাই পাথরটা হাতে নিয়ে নিজের মনে মনেই ঠিক করল, "বড় বড় জমিদাররা সব সোনার পালঙ্কে ঘুমায় এই পাথরের গুণে আমিও আমার বিছানাকে সোনায় পরিণত করতে পারি!!!”
যেমন ভাবা তেমন কাজ, তখনই ঠাকুরের সিংহসন থেকে শালগ্রাম শিলার পিছন থেকে কাঠের বাক্সটা বের করে সেই পাথরটা বিছানায় ছোয়ালো, কিন্তু নাহ….. কিছু তো হলো না, আবার ছোঁয়ালো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তবে কি পাথরের গুন সব হারিয়ে গেল। তারপর কি মনে হতেই সে নিজের তামার নস্যির ডিবেটাতে ছোঁয়ালো। অমনি নস্যির ডিবেটা সোনার হয়ে গেল। তখন এককড়ির ফুর্তি দেখে কে। সাথে সাথে ও এও বুঝলো একমাত্র ধাতুর জিনিসই এ পাথর সোনায় পরিণত করতে পারে। আর এটা না হলে তো পাথর যে কাঠের বাক্সে ছিল সেটাও তো সোনার হয়ে যেত!!! এই কথা বুজে উঠতেই সে ঘরের কোণায় ডাই করে রাখা কাঁসার থালা-বাসনের দিকে এগিয়ে গেলো। “আজ আমিও রাজা মহারাজাদের মতো সোনার থালায় ভাত খাব!!!” কিন্তু হঠাৎ দেখে পেছনে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে।
ছেলের এই কান্ড দেখে পঞ্চানন রাগে ফেটে পড়লেন!!! ওদিকে বাবার হঠাৎ আগমনে এককড়িও কেমন একটা পাথরের মতো হয়ে গেছিলো!!! এমন সময় নীরবতা ভঙ্গ করে পঞ্চানন বললেন, "তোমার এতো বড়ো সাহস তুমি আমার আদেশ অমান্য করে আবার এই পাথর বের করেছো!!! ছোট হয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা ভালো দেখছিনা!!! আজ শেষ বার সাবধান করে দিলাম তোমায়। আর কোনোদিনও খুব বিপদে না পড়লে শুধুমাত্র মজা করার জন্য এই পাথরের গুনের অপব্যবহার করবে না!!”
“কিন্তু আমরা তো আজই এই এলাকার সবথেকে বড়োলোক হয়ে যেতে পারি!!!” অবুঝ এককড়ির এরকম নির্বোধ কথায় পঞ্চানন আচার্য রেগে ছেলের গালে ঠাস করে একটি চর বসিয়ে দিলেন। “যে কথা বোঝোনা, সেই বিষয়ে নিজের মতামত দেবেনা!!! আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আজকের পর কখনও খুব দরকার ছাড়া এই পাথর তুমি বের করবেনা!!” বাবার ধাতানিতে চুপ মেরে যায় এককড়ি। সে তখন পাথরটা আবার বাক্স-এ ভরে সিংহাসনে নিজের স্থানে রেখে দিল।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৫ বছর। এককড়ি এখন তার বাবার মতই যজমানি করে দু-চার পয়সা উপার্জন করছে। প্রচুর পয়সা না থাকলেও সংসারে অভাব বলে কিছু নেই। ঘরে সুখ শান্তি আছে। ইতিমধ্যে এককড়ি বিয়েও করেছে। ঘর আলো করে তার একটা পুত্রসন্তানও হয়েছে। সেই পাথরের গুনে তার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। এর মাঝে এককড়ি পাথরটার জাদু একবারও ব্যবহার করেনি। কিন্তু সে এটা মেনে চলে পাথরটা তার জীবনে কতোটা মূল্যবান। পাথরটা তার জীবনে ভাগ্যলক্ষীর কাজ করছে।
কিন্তু মানুষের জীবনে লোভ বড় বালাই। ছেলেটা ছমাস বয়স হয়েছে। এবার অন্নপ্রাশন করতে হবে। এককড়ির ইচ্ছা তার ছেলের অন্নপ্রাশন জমিদারদের মত ধুমধাম করে করবে, প্রচুর লোককে খাওয়াবে। কিন্তু তার অতো সামর্থ্য কোথায়!!!!!
তার মনে পড়ে পাথরটার কথা।বাবার নির্দেশে পাথরটা এতদিন ব্যবহার করেনি। কিন্তু এখন একবার ব্যবহার করতেই পারে। কি এমন আর বিপদ ঘটবে। বরং ধুমধাম করে করলে সবাই এককড়ির প্রশংসাই করবে। সবার মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পরবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ এককড়ি নিজের ঘরে গিয়ে সিংহাসনের পিছনের দিক থেকে সেই বাক্সটা বের করল তারপর ধীরে ধীরে সেই পাথরটাও বের করলো। এত বছর বাদেও তার জৌলুস এখনও উজ্জ্বল আছে। এককড়ি পাথরটা তার ঘরে থাকা কিছু রূপো আর তামার জিনিসপত্রে ছোঁয়াল। ওমনি পাথরের গুনে সেগুলো সোনায় পরিণত হয়ে গেল। এককড়ির আনন্দ আর দেখে কে। ঘরের অনেক জিনিস সোনায় পরিণত করে সেগুলো নিয়ে স্যাকরার কাছে গেল এবং বিক্রি করে প্রচুর টাকা ঘরে নিয়ে এল।
তারপর এক শুভদিন দেখে ধুমধাম করে ছেলের অন্নপ্রাশন পালন করলো। বাইরে থেকেও প্রচুর লোক খেল তার মধ্যে কলকাতার অনেক বাবু জমিদার ও আছে। সবাই এককড়ির জয়গান গাইতে লাগলো। কিন্তু সবার মনেই একটা প্রশ্ন, “এই সামান্য যজমানী করে সে এত টাকা পেল কি করে??” অনেক চেনা জানা এককড়িকে চেপে ধরলো আসল কারণ জানার জন্য কিন্তু এককড়ি কিছুতেই বলছিল না। কিন্তু শেষে চাপে পড়ে এককড়ি পাথরটার কথা জানাতে বাধ্য হল। এই অদ্ভুত কথা কি আর চেপে রাখা যায়। ফলে লোকেমুখে এককড়ির পাথরের কথা সারা কলকাতাবাসী জেনে ফেলল। সবার মুখেই তখন এই পাথরের কথা।
এভাবেই লোকেমুখে পাথরের কথা নবাবের কানে গেল। যখনকার কথা বলছি তখন বাংলায়য় নবাবি শাসন। নবাব হুকুম দিল যেভাবেই হোক এই পাথর এককড়ি র থেকে নিয়ে আসতে হবে। এককড়ি প্রমাদ গুনল, এ পাথর হাতছাড়া সে কিছুতেই করতে চায় না, আবার না দিলে হয়তও নবাবের সেনারা এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে, মেরে ফেললেও আশ্চর্যের কিছুই নেই। এককড়ি এবার বুঝলো কেন বাবা তাকে লোভে পড়তে না করেছিল। কিন্তু বিপদ যখন এসেই গেছে আর তো কিছু করার নেই।
গভীর রাতে, এককড়ি চিন্তায় চিন্তায় জেগেই ছিল তবুও যখন অল্প তন্দ্রা মতো এসেছে, হঠাৎ যেন শুনতে পেল নবাব তার সেনাদের সাথে নিয়ে তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে!!! তাকে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে গাছের মগডালে ঝোলানো হবে, আর গ্রামের সবাই যেন সেটারই অপেক্ষা করছে!!! হঠাৎ ছেলে কেঁদে উঠলো!!! স্বপ্নে না বাস্তবে বোঝা গেলো না!! কিন্তু ছেলের কান্নার পরেই যেন এককড়ি দেখতে পেলো, হ্যাঁ ঠিক, বাবা!!!! “যেভাবে পেয়েছিলে সেভাবেই ফিরিয়ে দাও!!!” বাবার কথাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো এমন সময় ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে এককড়ি লাফিয়ে বসলো!!!
ধীরে ধীরে কলকাতা মহানগরীর হল। ব্রিটিশরাও ভারত ছেড়ে ২০০ বছর হল চলে গেছে। পাথরের কথাও এখন সবাই ভুলে গেছে তার সাথে সাথে এককড়িকেও। এখনও হয়তো পাথরটা কলকাতারই আশেপাশে বয়ে চলা গঙ্গার বুকে গেঁথে আছে তার হদিস কেউ জানে না!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন