অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ১২ মার্চ, ২০২২

ভালোবাসায় চন্দ্রাণী

 



ভালোবাসার নানা রূপ
====================
চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি
====================




বৃষ্টি পড়লেই মনটা কেমন যেন আমার উদাস হয়ে যায়। কিছুই ভালো লাগেনা ।টুপুর টুপুর শব্দটা যেন মন খারাপ করে দেয় ।আজও ভোররাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি হয়ে চলেছে ।ঘুমটা আমার বরাবরই বডড্ পাতলা । ঘুমটা ভেঙে যেতেই অভ্যাসবশত বালিশের ওপরে রাখা মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। মোবাইলের বোতাম টিপতেই স্ক্রিনে ফুটে উঠল সময়। ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। ফোন অন করা মাত্রই টুংটাং করে মেসেজ ঢোকার শব্দ পেলাম। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলা সেই কাঙ্খিত মেসেজ। খুবই সংক্ষিপ্ত মেসেজ। কিন্তু একান্ত ভালোলাগায় ভরে যাওয়া যায় সেই মেসেজে । মাধবের মেসেজ।

---" রাধা, হাউ আর ইউ?"



সাথে ভালবাসার চিহ্ন। ঠোঁটের কোণে আমার অজান্তেই একটা হাসি খেলে গেল ।না, পারবেনা।মাধব আমাকে কখনো ভুলতে পারবে না। আমিও কি পারব ? অনেক চেষ্টা করেছিলাম ভুলে যাওয়ার ।কিন্তু কখনো পারিনি। আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেল মাধবের সাথে আমার পরিচয় ।তারপর কথা বলতে -বলতে ভালো লাগা ।ভালোবাসা ।কখন যে নিজের অজান্তে তাকে এতটা ভালোবেসে ফেললাম নিজেই জানি না। সামাজিক মাধ্যম থেকে আমাদের আলাপ। মাধবই এসে আমার দিকে প্রথম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়।তখন তা ছিল নিছকই হালকা বন্ধুত্ব ।আমার মনে পড়ে প্রতিদিন রাত এগারোটা নাগাদ মাধব দেশপান্ডে মেসেঞ্জারে "হাই" লিখে পাঠাতো ।প্রথম প্রথম আমি তা খুলেও দেখিনি।তারপর একদিন কৌতূহলবশত আমি আমার ইনবক্স চেক করলাম ।প্রোফাইল ঘুরে দেখলাম মাধব দেশপাণ্ডের। মহিলাদের আকর্ষণ করার মত কিছুই মাধব দেশপাণ্ডের নেই। সাদামাটা একখানা চেহারা। মাথার চুল হালকা। বয়স চল্লিশের কোঠায়। নিতান্ত মজা করার জন্য আমিও তার "হাইয়ের" বদলে "হেলো" লিখে পাঠালাম। সেই থেকে শুরু।বিশদে নিজেদের পরিচয় আমরা দিলাম ।আমি একটা বাচ্চাদের স্কুলে নাচ ও গান শেখাই...

সেটা বললাম । মাধব জানালো যে সে মারাঠি। পুনেতে তার বাড়ি। পেশায় ডাক্তার ।সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ।আমি বাঙ্গালীদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে অনেক গল্প করতাম। অন্যদিকে মাধব চিকিৎসক জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই এর বিবরণ আমায় দিত ।আমরা দুজনই বিবাহিত। নিজেদের সংসার ও পেশা দুটো নিয়েই খুব ব্যস্ত। তাই কখনও সকাল-দুপুর-বিকেল সন্ধ্যেবেলা আমাদের বিশেষ কোনো কথাবার্তা হত না ।সারাদিনের কাজ শেষে রাতে আমরা দুজনেই ফেস বুক খুলে বসতাম। তখনই আমি মাধবের টেক্সট পেতাম। ছোট্ট একটা শব্দ ..."হাই"।মাধবও ততদিনে বুঝে গেছে আমি ও সারাদিনের পর রাত এগারোটায় অনলাইন হবো। আমার জন্য অপেক্ষা করত। ধীরে ধীরে আমিও যেন তার মেসেজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম ।অদ্ভুত সেই আকর্ষণ, অদ্ভুত সেই নেশা, অদ্ভুত সেই মাদকতা। কিন্তু কখনও কোন অশালীনতার পরিচয় আমি পাইনি। দুজন দুজনকে ভালোবেসে তলিয়ে যাচ্ছিলাম ।সেই তলানীতে ছিলনা অশ্লীলতা ।ছিল শুধুই মুগ্ধতা। নিজেকে বহুবার আমি প্রশ্ন করেছি। কিন্তু প্রতিবার একটি উত্তরই আমি পেয়েছি যা আমাকে আরো প্রবলভাবে মাধবকে ভালবাসিয়েছে। মাধব আমায় ভালোবাসায় সিঞ্চিত করেছে ঠিকই, কিন্তু সংসারকেও অবহেলাল করেনি। তবে মাঝে মাঝে এতগুলো সুন্দর মুহূর্ত মাধবের

সাথে কাটিয়েও আমি উতলা হয়ে উঠতাম। তার ব্যস্ত শিডিউলের জন্য মাঝে মাঝে সে আমায় সময় দিতে পারত না আগের মত। সেই রাত এগারোটায় রোজ হয়তো আমাদের আর কথা হয় না। কিন্তু এমন একটা দিন যায়নি যেদিন মাধব আমায় "সুপ্রভাত "জানায় নি। বরং আমি তাকে সময় না দেওয়ার অপরাধে বেশ কয়েকবার ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করেছি। কিন্তু সে কখনো আমায় সুপ্রভাত জানাতে ভোলেননি। বুঝি সে মারাত্মক রকমের ব্যস্ত। কিন্তু... সে তোমরা বুঝবে না ।আমরা কেউ কোনদিন কাউকে চোখে দেখিনি। শুধু ছবিতেই আমাদের ভালোবাসা আবদ্ধ ।শুধু মনের ছোঁয়ায় আমি হয়েছি রঙিন ...হয়েছি রূপসী ।তবে যে একদমই ইচ্ছে হয় না একে অপরকে চর্ম চক্ষুতে দেখার তা অস্বীকার করব না। কিন্তু সময়ের ঘেরাটোপে কখনোই তা বাস্তবে পরিপূর্ণতা পায় নি। এখন আর অত কথাবার্তা আমাদের মধ্যে হয়না। কিন্তু আমরা জানি আমরা একে অপরের জীবনে ভীষণভাবে আছি ।পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমাদের দিনের শুরুটা ও শেষটা একসাথেই হবে। মাধবের কথা ভাবতে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মাধবকে ভালোবেসে বুঝেছি ... রূপ নয়, হৃদয়টাই আসল। মাধবের হৃদয়টা এক সীমাহীন আকাশের মতো। গোল্ডেন হার্ট যাকে বলে।





(২)

আজ আমাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করবে। আমার একটা গাইনি অপারেশন হয়েছে ।বেশ খরচসাপেক্ষ ।সেটা মাধব যেদিন জেনেছে ,সেদিনই আমার একাউন্টে জি-পে করেছিল ।একটা মোটা অংকের টাকার। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে শুধু ভালবাসা-টাই থাকনা। অর্থের কি প্রয়োজন সেখানে? সেই অর্থটা আবার সস্থানে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।



---" ম্যাম, ঘুমিয়ে পড়েছেন?"



নার্সের গলার আওয়াজে সাড়া দিলাম।

---" না, ওই একটু চোখ বুজে ছিলাম। একটু দুর্বল লাগছে।"



---"হ্যা, তা তো লাগবেই একটা অপরেশনের পর ধকল তো থাকেই।"



চোখ খুললাম কিন্তু নার্সের মুখটা দেখতে পেলাম না।থ একটা বড় ফুলের বোকের পেছনে নার্সের মুখটা ঢেকে গেছে। দুহাতে তার বোকেটা। হলুদ গোলাপ ।



---"আপনার জন্য ম্যাডাম। নামটা বলতে পারলাম না। লেখা নেই ।"



আমি জানি হলুদ গোলাপ আমাকে কে পাঠাবে ।শুধু দুহাত বাড়িয়ে হলুদ গোলাপ গুলো কে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম। 




(৩)

ধীরে ধীরে নার্সের সাহায্যে পোশাক পাল্টে নিলাম। আজকে বাড়ি যাচ্ছি ।মোবাইলে মেসেজ ঢুকলো ।বুঝতে পারছি। হাতে তুলে নিলাম। মাধবের মেসেজ। ইংরেজিতে লেখা ।শত চেষ্টা করেও না পারলাম মারাঠি শিখতে, না ও পারলো বাংলা শিখতে। বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায়।



---" রাধা,

আমি কলকাতায় তোমার অপারেশনের জন্য এসেছি ।তা তো তুমি জানোই।কিন্তু তোমার শহরে এসেও তোমার কাছে আসতে পারছি না। তোমায় দু'চোখ ভরে দেখতে পারছি না। আমার দুর্ভাগ্য ।তুমি সুস্থ থেকো। কলকাতায় যতদিন ছিলাম হসপিটালে এসেছি। তোমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ তুমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছো। সাবধানে থেকো। আমিও আজ পুণে ফিরে যাচ্ছি। তুমি যখন গাড়ি করে হসপিটাল থেকে বেরোবে তখন আমি মেনগেটে তোমায় একবারটি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব। যদি সৌভাগ্যক্রমে দেখা হয়। ভালো থেকো।"



আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। শ্রাবণ ধারা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার কোন রূপ হয় না। শুধু সমাজ সেটাকে পরকীয়া বলে তুচ্ছ করে। ভালোবাসাকে কোন নামের মধ্যে আটকে রাখা অর্থহীন।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন