অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

একটি অণুগল্পে কল্পদেব চক্রবর্তী 


===============
আমার প্রথম প্রেম
===============

আমাকে প্রথমে যে আকাশের সাথে কথা বলা শেখালো, বাতাস কখন কি কথা বলে বোঝাল, পাখিরা কোথায় কখন বাসায় ফেরে, তখন তাদের ঠোঁটে ফুটে ওঠে কেমন ভাষা, সন্ধ্যা কখন কিরূপে নেমে আসে, নীল আকাশ তখন কিভাবে সেজে ওঠে তারাদের আলোকমালায়।সূর্য ডুবে গিয়ে চাঁদ টা যখন হেসে ওঠে ঠিক তখন আমিও বাড়ি ফিরি সযত্নে ওকে সঙ্গে নিয়ে।




বাস্তবতার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না কখনও আমার মন। প্রথমে সখ্যতা তারপর গভীর প্রেম ওর সাথে। এখনো যখনই আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি ওকে দেখতে পেলেই ফিরে যাই আমার কৈশোরে। কৈশোরের প্রতিটা দিন ফিরে আসে আবার জীবন্ত হয়ে।



আমাদের বাড়িটা ছিল একতলা। সেই ন‍্যাড়া ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিলনা। ছিল একটা জামগাছ বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে। বাবা অফিসে বেরিয়ে গেলেই সেই গাছ বেয়ে ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে উঠে যেতাম ছাদে। কাগজের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে বুঝে নিতাম বাতাসের গতি প্রকৃতি কেমন কোন দিকে। তারপর সুতোর সুনিপুন টানে উড়িয়ে দিতাম ঘুড়ি। ওর গতি বিধি থাকতো আমার হাতে নিয়ন্ত্রণে। সুতো ছাড়তে ছাড়তে ওকে দিতাম অবাধ স্বাধীনতা। যেন আমার পোষা পাখি। উদ্দাম খুশিতে আকাশের বুকে দাপিয়ে বেড়াত সে আমার মনকে সঙ্গী করে।




পেটকাট্টি, ময়ূরপঙ্খী, ঘয়লা আরো কতো তাদের নাম। পরস্পরের সাথে দেখা হলেই সুতোর টানের কারিগুরি তে মেতে উঠতো লড়াইয়ে। হঠাৎ চিৎকারে মেতে উঠতাম ভোকাট্টা বলে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ পরাজিত। দোল খেতে খেতে যেন ময়ূরপঙ্খী ভেলায় ভাসতে ভাসতে অপূর্ব ছন্দে তার মাটিতে নেমে আসা।

নিচে আমার বয়সী বাচ্চাদের দিগ্বিদিক শুন‍্য জ্ঞান রোহিত সেই ঘুড়িটাকে পেতে মরিয়া দৌড়। সেখানেও যে প্রথম ধরতে পেত সেই জয়ী হতো। কখনো সেই দলে আমিও থাকতাম।কাড়াকাড়িতে অনেক সময়ই ঘুড়িটা ছিড়ে যেত।আমি লক্ষ্য করতাম কতটা আহত হয়েছে ও।সারিয়ে তোলার উপায় আছে কিনা।


পথে-ঘাটে অনাদরে পড়ে থাকা পথশিশুদের মতো ওদের তুলে নিতাম।



বাবার কাছে কোনদিনও ঘুড়ি কেনার জন্য পয়সা চাইবার সাহস হতো না। উনি ছিলেন রাশভারী মানুষ।পড়াশোনা ছাড়া তেমন কিছু বুঝতে চাইতেন না। আমার মা ছেলে আনন্দে আছে এই ভেবে আমার আবদারে প্রশ্রয় দিতেন। দু'চার পয়সা যা পেতাম মায়ের কাছথেকেই। বড়লোক বন্ধুদের মতন খেলার পেছনে যথেষ্ট পয়সা খরচ করার সামর্থ্য আমার ছিল না। পয়সা দিয়ে ঘুড়ি কেনা ও তাই খুব বেশি হতো না।




সবাই বলতো আমাকে ঘুড়ির ডাক্তার। মুমুর্ষ সেই ঘুড়িগুলো কে বাড়িতে নিয়ে এসে শুরু হতো চিকিৎসা। মা ময়দা দিয়ে আঠা তৈরি করে দিত।পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাদ দিয়ে ডাক্তাররা যেমন নতুন অঙ্গ সংযোজন করে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলে তেমনভাবে কোথাও নতুন কাগজ লাগিয়ে কোথাও বা ভেঙ্গে যাওয়া কাঠি কে বাদ দিয়ে নতুন কাঠি লাগিয়ে ঘুড়িটাকে প্লাস্টিক সার্জারি করে প্রাণ ফিরিয়ে আনতাম।

মৃতপ্রায় ঘুড়িটা প্রাণ ফিরে পেয়ে আকাশে আবার পতপত করে উড়ে বেড়াতো।



সুতোর রিল কিনে এনে মাঞ্জা দিতাম ঘুড়ির প‍্যাঁচ খেলার জন‍্য। পয়সা মায়ের আঁচল ধরে ঘ‍্যান ঘ‍্যান করতে করতে একসময় আদায় করেই ছাড়তাম। মায়ের কাছ থেকে অনেক আবদারই এভাবেই আদায় করে নিতাম।


রান্নাঘরের হামাল দিস্তা লুকিয়ে নিয়ে এসে মাঠে চলে যেতাম। সেখানে কাচের বোতল, ভাঙা কাচের গ্লাস এসব জরো করে রাখতাম আগে থেকে। তারপরে মাঞ্জা দেওয়ার জন্য সেই কাঁচের টুকরোগুলো কে গুঁড়ো করতাম।


তখন রাস্তার পথে-ঘাটে-মাঠে অনেক গাছপালা ছিল চারিদিকে। শিরিষ গাছের ছাল কদিন আগে দা দিয়ে জাগায় জাগায় কেটে রেখে আসতাম। ক'দিন বাদে সেখানথেকে গাছের কষ বার হয়ে আঠা তৈরি হতো। সেই আঠা ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হত।তার সাথে সাবু ভিজিয়ে উনুনে জাল দিয়ে থকথকে একটা পেস্ট তৈরি করা হতো। মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গাছের কান্ডে সুতো টানা দিয়ে চলত সারাদুপুর মাঞ্জা দেওয়া।


আমার বড় লোক বন্ধুরা কিন্তু মাঞ্জা দেয়া দামি সুতো দোকান থেকে কিনে আনত। কিন্তু আমার সাথে ঘুড়ির প্যাচ খেলায় ওরা বেশিরভাগ সময়ই হেরে যেত।

এখনো এই মধ্য জীবনে বড় সাধ হয় ঘুড়ি ওড়াতে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন রাতে ছাদে উঠে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। আমার প্রথম প্রেমকে মনে পড়ে। তবে সেই সেদিনগুলোর মতো আকাশ ভরা ঘুড়ির মেলা এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।

ছেলেরা এখন বদ্ধ ঘরে কম্পিউটার নিয়ে গেম খেলায় মত্ত। আমাদের শিশুকালের আনন্দ আর ওদের শিশুকালের আনন্দ এখন আকাশ আর পাতাল দূরত্বের সমান। যুগ এভাবেই পরিবর্তিত হয়, যার পোশাকি নাম ব্যাকডেটেড।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন