অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

একটি অণুগল্পে নাসির ওয়াদেন

 

=============
যিশুর মালা
=============


বড্ড শীত । কনকনে হাওয়া বইছে । সায়নের খুব শীত করছে আজ। সায়নদীপ এক কোলভরা আলোফোঁটা শিশিরবিন্দু। নিস্তব্ধ আলোর ঝলকানি তার চোখেমুখে । সাত বছরের আরও এক শিশু, অয়ন, মেঘের কোলে ছন্নছাড়া ভেলায় ভাসমান দ্যুতি । অয়ন বড়ো আর সায়ন ছোট ,কিন্তু দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে । চারিদিকে করোনা দৈত্যের দাপাদাপিতে সাবধানে থাকতে হয় তাদের। বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই কবে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, বাড়িতে থাকতে থাকতে তাদের মন খারাপ করে। বন্ধুদের সাথে খেলা করতে পারে না, দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না ,সারাদিন গৃহবন্দি । বাড়ির লোকেরা মাসে মাসে স্কুল থেকে মিড ডে মিলের চাল, আলু,ছোলা আর সাবান নিয়ে আসে । দেখতে দেখতে দশ মাস কেটে গেলেও স্কুল খোলার কোন লক্ষণ নেই । খাঁচার পাখির মতো ওরা শুধু ছটফট করে ।
ওদের পাড়ার এক এঁদোগলিতে সুরভিদের বাড়ি । সুরভির বয়স দশ বছর । তাদের অভাবের সংসারে বাবা, মা আর ছোট ছোট দুই ভাইবোন । সুরভির স্কুল বন্ধ থাকায় সে তার বাবা মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে। ওর বাবা শহর থেকে ফুল কিনে আনে আর গলির মোড়ে ফুটপাতে ঝুড়ি নিয়ে রোজ সকালে বসে ফুলের মালা বিক্রি করে । পাড়ার লোকেরা মালা কিনে নিয়ে যায়, কেউ কেউ ফুল মালা দিয়ে ঠাকুরের পূজো করে। বিক্রি করে যা পয়সা পায় তাতে তার পরিবারে সাহায্য হয়, সংসারে লাগে। তবু মাঝে মাঝে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয় তাদের ।
একদিন ফুল বেচে ফুটপাত থেকে বাড়ি ফেরার পথে গলির আলো-অন্ধকারে এক শিশুকে দেখে অবাক হয় সুরভি। ছোট শিশুটির বুক থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, কেউ তার বুক চিরে দিয়ে চলে গেছে, কাঁটার আঁচড়ে বুক ক্ষতবিক্ষত । এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। মনে মনে কষ্টবোধ করে, ভাবে পৃথিবী নিষ্ঠুর, নইলে ফুলের মত শিশুকে কেউ এমন করে আঘাত করতে পারে! কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কী করে তোমার আঘাত লেগেছে? কাঁটার উপর পড়ে গেছিলে? শিশুটি নীরব, কোন কথা বলে না, কিন্তু যন্ত্রণায় ছটফট করে।
-- তোমার নাম কী ?
-- যিশু ।
থতমত খেয়ে যায় সুরভি । সত্যিই তুমি যিশু!
--ওরা আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে ।
সুরভি স্কুলের বইতে যীশুর গল্প পড়েছে। কীভাবে দুর্জনেরা যীশুর শরীরে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল । কিন্তু অবাক হয়ে ভাবে এখানে যীশু আসবে কীভাবে ।
-- তোমার বাড়ি? ।
-- বেথেলহাম।


আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে সুরভি । কী দেখতে পাচ্ছে সে। মাথার উপর লাল সূর্যের তেজ, আলোকময় রৌদ্রহাসি, উত্তাপে ভালবাসার গন্ধ । অবাক হয় । একখণ্ড কাঁচামেঘ এসে দাঁড়ায় শিশুর ওপর । ছায়া এসে ঢেকে দেয় মুখমণ্ডল । এক অদ্ভূত আলোকবর্তিতা ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে যাচ্ছে । নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুরভি। কী আশ্চর্য, দিনের আকাশে তিনটি তারা জ্বলজ্বল করে ভাসছে । যিশু আঙুল তুলে বলে ওই যে মাঝের তারাটি আমি আর ডানপাশে বাবা যোসেফ, বামপাশে মা মেরী। আমরা প্রতিদিন আকাশের জলে ভাসি। এবার বিশ্বাস হচ্ছে?
নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের শীত হাসি অবাক করে তাকে । তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হেঁটে চলে। বাড়িতে পৌঁছে দেখে ওদের ভাঙা উঠোনে অয়ন আর সায়নদীপ খেলা করছে, তাদের কাছে ছুটে যায়, ছোট্ট সায়নকে বুকে চেপে ধরে।
অয়ন বলে, দিদি, আমাকে একটা মালা দেবে?
-- মালা! কেন ভাই?
-- আজ পঁচিশ ডিসেম্বর । বড়দিন । দিদিমণি একটা মালা নিয়ে যেতে বলেছে । ছবিতে মালা পরাবে ।
সেদিনে একখান মালা বিক্রি হয়নি । সুরভি ছোট্ট যীশুর গলায় পরিয়ে দিয়েছে। বলে--
' আর নেই তো ভাই! যেটা ছিল সেটা তো এক শিশুকে পরিয়ে এসেছি।
হঠাৎ চমকে উঠে সুরভি, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিশু যীশু । গলায় ঝুলানো সেই পরিত্যক্ত মালা । পাশে দাঁড়িয়ে দিদিমণি ।
তিনজনেই হাত তোলে আকাশের দিকে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন