ভালবাসা কারে কয়
======================
শংকর ব্রহ্ম
======================
রবি বিলেত থেকে সবে ফিরেছে,মাত্র ঊনিশ বছর বয়স তার।
আর একুশের কাদম্বরী তার ঘর স্ংলগ্ন ছাদে একটা শৌখিন বাগান গড়ে তুলে ছিল অনেক যত্নে। রবি তার নাম দিয়ে ছিল 'নন্দন কানন'।সেখানেই তাদের দেখা হত অন্তরঙ্গ ভাবে।একদিন রবি আবেগে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে প্রথম চুমু খায়।
কাদম্বরীর শরীরে বিদ্যুৎ চমক লাগে,গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সে রবিকে ফিসফিসে বলে,আমার ভয় করে খুব, কেউ দেখলে,
কী হবে বলো তো?
রবি হেসে বলল, এ যে নন্দন কানন, মর্তলোকের দৃষ্টি এখানে পৌঁছায় না।
- তোমার সাথে কথায় পারব না,কেউ জানলে খুব বিপদ হবে? তাই আমার খুব ভয় করে।
- ভয় কীসের তোমার?
- তোমাকে হারাবার ভয়। তুমি ছাড়া আর আমার যে কেউ বন্ধু নেই এ বাড়িতে। আর আমার মন বোঝে না কেউ তোমার মতো।
- আমি সত্যিই কি বুঝি তোমার মন? বুঝি না, হয় তো কিছুটা অনুভব করি মাত্র।
এ কথা শুনে কাদম্বরীর বুকের ভিতরটা
মোচড় ওঠে। ফাঁকা হয়ে যায়। একেবারে নিঃস্ব মনে হয় তার নিজেকে।
- তোমার এ কথা শুনলে আমার খুব কষ্ট হয়,তুমি এ'ভাবে আর বোলো না ঠাকুর পো।আমার সমস্ত মনটাই আমি তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। তুমি যখন আমার চোখের দিকে তাকাও, আমি অনুভব করি,তুমি আমার হৃদয়ের বেদনা টের পাচ্ছো।
- তাই ? রবি মৃদু হাসে।
- তুমি কি সত্যিই বোঝ না, আমার মনের ভিতরে তোমার জন্য কেমন করে?
- না বুঝি না। সত্যিই বুঝি না কিছু।
- আমার মনের ভিতর যে কষ্ট আমি দিনরাত চেপে রাখি,তা তুমি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলো? তোমার দাদা তো আমাকে উপেক্ষা করে, জ্ঞানদা দিদির (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী)প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী, সেই ন বছর বয়স থেকে তোমার সাথে আমার পরিচয়। মনে আছে,ছাদে গিয়ে ঘুর ঘুর করতে আঁচার খাওয়ার লোভে,কাক তাড়াবার অছিলায়।
যাক এ সব কথা এখন। শোন বলি, বানিয়ে কথা বলতে আমি শিখিনি। শুধু তোমাকেই আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। তোমার মতো কোনো পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি - রূপে, গুনে,গানে, প্রাণের উচ্ছলতায় তুমি যে অনন্য ঠাকুরপো। তোমাকে আমি হৃদয়ে আসনে অনেকদিন আগেই বসিয়েছি, তা তুমি জান না।
রবি এবার হেসে,গেয়ে ওঠে -
- "চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল
এ কথা বলিতে চাও বোলো
এই ক্ষণটুকু হোক চিরকাল
তারপরে যদি তুমি ভোলো
মনে করবো না আমি শপথ তোমার
আসা যাওয়া দু'দিকেই খোলা রবে দ্বার
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই
আবার আসিতে হয় এসো।"
- এই কথা বলে রবি তা'কে, আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে। তারপর দীর্ঘ চুম্বন করে।
কাদম্বরীও নিবিড়ভাবে চোখ বুজে আবেশে তার স্বাদ গ্রহণ করে তৃপ্ত হয়। চোখ মুখ তার উজ্জল হয়ে ওঠে খুশিতে।
এ ভাবে তাদের প্রেম আরও চার বছর গোপনে চলেছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়টা কোন ভাবে আচ করতে পারেন। এবং রবির বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান । জমিদারীর এক সামান্য কর্মচারীর মেয়ে মৃণালিনীর সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেলেন। তার কথা ফেলার মতো দুঃসাহস বাড়ির কারও বুকেই ছিল না। রবির তো নয়ই। তাই সে পিতৃআজ্ঞা পালন করে , মৃণালিনীকে বিয়ে করতে বাধ্য হন।মৃণালিনীর সঙ্গে ঘটা করে রবির বিয়ে হয়ে যায়। আর সেই কষ্ট সহ্য করতে পারে না কাদম্বরী, নিজের ভিতর দগ্ধে দগ্ধে মরতে থাকেন। ঠিক তার চারমাস পর একদিন
রবির লেখা একটি চিরকূট হঠাৎ কাদম্বরী দেবীর হাতে এসে পড়ে, তাতে লেখা ছিল, 'পুরাতন কে বিদায়'। সেই চিরকূট তার বুকের ভিতর আগুনের স্ফূলিঙ্গের মতো এসে পরে, ভিতরটা তার দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। তারিখটা ছিল একুশে এপ্রিল।
সেদিনই সে একদলা আফিম গিলে নিজেকে শেষ করে দিতে চান । তারপর তিনদিন বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল তিনতলার ঘরে, চব্বিশে এপ্রিল সকালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন