অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

আমার একলা রবি

 

 আমার একলা রবি

====================
সম্পূর্ণা
====================



যতোবার লিখি ততবারই মুছি

মেঘেরা ধুয়ে দেয় রোদের বৈশাখী স্নান

এ জীবনেরর অক্ষর অব্যয়ে নির্বাক হয়

তবুও পূর্ব আর পরে যুগ লেখে তোমারই জয়গান...



না! হচ্ছেনা। অনেক্ষণ আছি বসে। একটা লাইনও মনোমত নয়। লিখছি আর কাটাকুটিতে দিচ্ছি ভরিয়ে! প্রত্যেকবার এমন করেই তো আসো তুমি। কেমন যেন এসেই সব দাও গুলিয়ে!যা লিখি তা আর লেখার মতো হয়না! যত ভালো শব্দ বাছতে বসে দেখি যেন পারবনা বলেই লিখে ফেলেছ আগে! সবাই চিৎকার করে বলে তুমি নাকি অনেক ঊর্ধ্বে! ছোঁয়া যায়না তোমায়! আমার তো তেমন লাগেনা! যখন কেউ আমার আবোলতাবোল কাব্যি শোনেনা বড় ঘরের তোমার বড় করে টাঙানো ছবিটার সামনে এই অকাব্যিগুলো তোমায় শোনাই। তুমি ঠিক শোনো। যে দুপুরগুলোয় স্মৃতি ভারী হয়ে আসে বারান্দার চৌখুপি রোদে ডাইরিতে তোমার জন্য এলোমেলো আমিকে নিয়ে ঘুরছি শিলংয়ের সেই ছোট ঝরণার পাশে। তোমার তখন আশি, আমি তখন সতেরো! কিভাবে যেন কাঁপুনি ধরা শীতে ভালোবাসতে শিখছি শেষের কবিতায়! ভেতরের যে জায়গায় আমার সারা বছরের মউসিনরাম। সন্ধ্যে বেলায় আকন্ঠ মেঘ নিয়ে আস। ভিজি। ভিজতে ভিজতে মেতে উঠি উৎসবে! নিরুৎসবের অলিন্দ জড়িয়ে গাই..


"যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে সে কাঁদনে সেও কাঁদিল
যে বাঁধনে মোরে বাঁধিছে সে বাঁধনে তারে বাঁধিল॥"


সহজ সহজিয়ার ও প্রান্তে তুমি! গানের কথার গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়া লুকোনো গোপন ঘরের ছাদ! সুর থেকে আমার সুর ভুলে আবারও ফিরে আসা। আমি তো এই রবিকেই চিনি। আমি তো রোজ এই রবিতেই ফিরি।


ইতস্তত পায়ে এগিয়ে যাই দেখি সামনে অনেক ভিড়। রবি তখন আমার পাহাড়ের বিছানার ওপর অনন্ত আকাশ, পৃথিবীময় প্রত্যেক সুন্দর আলোর ছোট ছোট কণায় ছড়িয়ে পড়ছে! আমার ভেতর অথচ খালি! নাকি এও আমার বুঝতে পারার ভুল, যে আমার থেকে তুমি যাওনা কোথাও! তাই হারাই প্রতি সময় , অসংখ্য মুহূর্তে! একজন্মে বারবার তবুও তোমাকেই ভালোবাসা !তোমার আলোয় দ্বিধান্বিত অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকা !


বোশেখের ২৫শে যখন চারপাশটা আরও তুমিময় হয়! শহর জুড়ে যেন অলিখিত ব্রতপালনের নিয়মাবলী , জুঁই , বেলে সেজে ওঠে সিংহাসনে বসা পুজোপাঠের ঘোষিত "ঠাকুর " তখন ভালোলাগেনা। ওই যে শুভেন্দু, কলেজের প্রথম পঁচিশে বৈশাখে বলেছিল তোমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মাথায় বেল বা জুঁইয়ের মালা সাথে বিশেষ সাজের রীতিতে সেজে আসতে! নাহলে নাকি রবির জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথই যাবে হারিয়ে! সেবারে জোর করেও কেউ আমায় গান গাওয়াতে পারেনি। যে দিনে তোমায় ছুঁতে গেলে উদযাপনকে ধরতে হয় আঁকড়ে সেদিন তো তাহলে তোমার খাঁচাটুকু পড়ে থাকে। কবিতা,গান,আলোচনা, শ্রদ্ধার অকুণ্ঠ আবেদনে তুমি! অধরা তবুও সবকিছু ! তারপর থেকে এমন ছ্যুৎমার্গের বৈশাখে তোমার কাছে যাইনা। সবাই যায়। আমি যাই আমার অভ্যেস অনভ্যেসের অনভ্যস্ত ছোট বড় পরিসরে! ভীষণ রকম বেসুরে দিলখোলা হাওয়ায় গেয়ে উঠি

"এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্‌ ছলছল্‌–
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্‌ ছলছল্‌॥...."


আমি কিন্তু তেমনভাবে গুণমুগ্ধ নই তোমার। যাতে চোখ যায় বুঁজে! অন্ধ অন্ধত্বে তুমি নেই কোথাও কিন্তু! মাঝেমধ্যে তাই বিস্তর অভিযোগের দিস্তা খুলে বসি! মনে হয় বারবার, চারুলতার মতো নষ্টনীড়ের বিবাহবহির্ভূত ভালোবাসা , দামিনীর সাহসী বৈধব্য , লাবণ্যর নদীর মতো প্রেমে অমিতের ডুব দিয়ে স্নান, ভালোবাসাকে বিচ্ছেদের প্রান্তে অচ্ছেদ্য করে যাওয়া সবটাই তোমার আঁকা অদুর্ভেদ্য আলোয় নিখুঁত রমণীর প্রতিচ্ছবি! কোনো এক সাধারণ মেয়েও তোমার কাছে আর্জি জানাতে পারেছিল, "একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।/বড়ো দুঃখ তার।/তারও স্বভাবের গভীরে/অসাধারণ যদি তলিয়ে থাকে কোথাও/কেমন করে প্রমাণ করবে সে..."!

কিন্তু কাদম্বরী, তোমার নতুন বৌঠান। যার মৃত্যুর অন্ধকারে তোমার রবি জন্মের পুনর্জন্ম! পেরেছিলে তার দুঃখ কষ্ট দীর্ঘশ্বাসের বিষাক্ত ক্ষয় জানতে ! আর আরেকজন! শুধুমাত্র তোমার জন্য বেণীমাধব রায়চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিণী থেকে মৃণালিনী হয়ে ওঠার দুর্গম রাস্তাটা কতোটা আগুনে পুড়িয়েছিল তার ঝলসানো আঁচ তোমায় দগ্ধে ছিল?? শীতল, নিষ্পৃহ ভীষণ দূরের কেউ! সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা পার্শ্ববর্তীনি নয়, সমান্তরাল সহবাসে বিপরীত মেরুর একটা সম্পর্ক! তোমার জন্য সখ করে বানিয়ে আনা সেই সোনার বোতাম! প্রিয় মানুষকে কিছু দেয়ার আনন্দ বুকে চেপে কাঁপা হাতে দিয়েছিল উপহার তুলে। তুমি দেখেই ভীষণ বিরক্ত! বলেছিল, গয়নাগাটি পড়ে থাকার অভ্যেস নেই! তখন খেয়াল করোনি হয়তো সব আলো নিভে যাওয়া পাংশুটে মুখের মৃণালকে! অবাধ্য চোখটার কোণে জমে মেঘের বর্ষাটুকু হাপিত্যেশ গলার তেষ্টার দলাটা নীল দমবন্ধে কালো কালশিটে বানিয়ে ফেলতে !

অথচ সেই তুমিই, জলজ্যান্ত নারী মনের অবাধ ভাষ্যকার ! ঘরের কোণে গৃহস্থালি সজ্জায় সুখী মগজহীন নারীর থেকে, বারবার খুঁজেছ তাকে স্বাধীনতায়, মুক্তিতে, উদার মনের আশ্চর্য আলোয়! তারা ভীষণ পরিচিত বা চেনা তবুও চেনাজানায় তারা যেন অনেক উঁচুস্তরের বাসিন্দা ! হয়তো সত্যিই সাধারণ থেকে অসাধারণের ঊর্ধ্বে পাথরে দিয়ে গড়া "ঠাকুর" তুমি! সম্পর্ক ছোঁওনি, সবটা তোমার প্রাত্যহিকের বাইরে, শুধু হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা দিয়ে বানিয়েছ অসংখ্য প্রেম, বিরহ, জীবনের কবিতা! এমন সাদামাটা গৃহস্থ জীবনটা হয়তো তুমিই চাওনি ছুঁতে! চাওনি কোনো বন্ধন! শুধু চেয়েছ শুনতে গুণীর প্রতি স্তব্ধবাক অনুসরণ!অননুকরণীয় হয়ে থাকতে অবিস্মরণীয় কীর্তির মহাকাশে একক সূর্যের মূর্তিতে! তোমার প্রেমের কবিতাগুলোয় ভালোবাসা কতটুকু ছিল কবি! বিচ্ছেদ, বিরহকে তুমি কতোটা জড়িয়ে ছিলে একাকীত্বের নির্জন অরণ্যে! কতোটা কেঁদেছিলে যেদিন মৃণাল আর কখনও ফিরে আসেনি! সেদিন কিন্তু তুমি তোমার ছুটিকে লিখেছিলে কালজয়ী চিঠি!


জানি, জানি....এ কোনো জন্মদিনের লেখা নয়। তবুও এ লেখা আমার রবির। যে রবিকে উঁচু আসন থেকে নামিয়ে রেখেছি বুকের খুব সাধারণ সব কিছুতে জড়িয়ে। বাস ট্রাম ভিড় পেরিয়ে রাস্তাঘাটে ভিজে যাওয়া স্বাধীনতার রবি।দাউদাউ বৈশাখের রোদে মেঘ দিয়ে স্নানে স্নিগ্ধ করা রবি! ঈশ্বর প্রথার বাইরে আমার নিভৃত একলার সেই জন যেখানে রোজ ওঠেন রবি, তবু কোনো রবীন্দ্রনাথ আর জন্মায়না।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন