অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

রবীন্দ্র ভাবনায় জনস্বাস্থ্য ও মহামারী


  

 

রবীন্দ্র ভাবনায় জনস্বাস্থ্য ও মহামারী
=========================
বারিদ বরন গুপ্ত
=========================



বর্তমানে সারা বিশ্বে যখন জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত , সারা বিশ্ব যখন মহামারীতে কাঁপছে, জনস্বাস্থ্য নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনস্বাস্থ্য বিদ্যার প্রসঙ্গটি এসেই যায়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন, তিনি তাঁর জীবিত কালেই বেশ কয়েকটা মহামারী প্রত্যক্ষ করেন। শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যুও তিনি দেখেছেন, সেই সূত্রেই হয়তো তার জনস্বাস্থ্য বিদ্যার হাতে খড়ি।



ভয়াবহ মহামারীর কারণে সারা পৃথিবীর মানুষের জনস্বাস্থ্য যখন সংকটাপন্ন এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গোটা পৃথিবী যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের জনস্বাস্থ্য ভাবনা নিয়ে একটু আলোচনায় আমরা যেতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহে বা শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন ছিলেন, দেখেছেন কলেরা মহামারী জনিত কারণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে, এই ভাবনা তাকে প্রথম থেকেই গ্রাস করেছিল ।তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জনস্বাস্থ্য ও সমাজ গঠন, মহামারী কবল থেকে গ্রামের চাষি,তাঁতী, কামার ,কুমোর প্রভৃতি সম্প্রদায় কে বাঁচানো। এই উদ্দেশ্যে তিনি রীতিমতো পড়াশোনা শুরু করেন এবং বিশেষজ্ঞ মহলের সাথে যোগাযোগ ও পরামর্শ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।



উল্লেখ করা যেতে পারে যে ব্রিটিশ ভারতে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ম্যালেরিয়া মহামারীর আকার ধারণ করে, পল্লী গ্রামের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পরে, এর প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি যেমন কালীমোহন ঘোষ নেপাল রায় সন্তোষ কুমার বসু প্রমূখ স্বদেশী বন্ধুদের সাহায্য পেয়েছিলেন, তেমনি হ্যারি টিম্বার্স, চেন গ্রীন, এলমহাস্ট, স্কটিশ জীববিজ্ঞানী প্যাট্রিক গ্যাডেজের মত মহান বিদেশি বন্ধুদের ও পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার জনস্বাস্থ্য কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য শ্রীনিকেতন কেই বেছে নিয়েছিলেন।১৯২১ সালে তিনি এলমহার্স্ট কালীমোহন ঘোষ, নেপাল রায় প্রমুখদের নিয়ে গ্রাম গঠন পরিকল্পনার সার্থক রূপায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল গ্রাম পুনর্গঠন এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীর পূর্ণ রূপায়ন, গ্ৰাম্য জনগণের স্বাস্থ্য রোগ প্রতিরোধ ছিল এই কর্মসূচির মুখ্য বিষয়। সমকালীন সময়ে সমগ্র দেশজুড়ে ম্যালেরিয়া মহামারী আকার নিয়েছিল। এই মহামারী থেকে গ্রাম সমাজকে বাঁচানোর ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি শ্রীনিকেতনে তৈরি করেন ম্যালেরিয়া নিবারণী সমিতি।



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভয়াবহ মহামারী থেকে বাঁচতে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। রবীন্দ্রনাথের এই কর্মযজ্ঞে সাড়া দিয়ে বাংলার প্রখ্যাত পতঙ্গ বিজ্ঞানী গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ম্যালেরিয়া নিবারণী সমিতিতে যোগদান করেন। ডক্টর চট্টোপাধ্যায় তখন ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার গবেষণায় রত ছিলেন। এহেন মহামারী থেকে বাঁচতে যে ধরনের পরিকাঠমো দরকার তা এই সমিতির অভাব ছিল। বিশেষ করে অর্থ ,জনবল, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং উপদেষ্টা মন্ডলী। সেই সমস্যা নিবারণে তিনি আমেরিকার ফ্রেন্ডস সোসাইটির দ্বারস্থ হন, ফ্রেন্ড সোসাইটি তাহার আহবানে সাড়া দিয়ে ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ ডক্টর হ্যারি টিম্বার্স কে শান্তিনিকেতনে পাঠান। ডক্টর হ্যারি শান্তিনিকেতনে ম্যালেরিয়া নিবারনি সমিতির পরিকাঠামো রূপায়নে মনোনিবেশ করেন, শুধু তাই নয় তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে রাশিয়া ভ্রমণের সঙ্গী হোন এবং সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মসূচী সম্পর্কে অবগত হন।



রবীন্দ্রনাথ সেভিয়েত রাশিয়া থেকে ফিরে ভারতে জনস্বাস্থ্য এবং মহামারী প্রতিরোধে তিনি এক নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেন, এই কাজে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ ডক্টর হ্যারি টিম্বার্স।

বলতে গেলে হ্যারি টিম্বার্স শ্রীনিকেতন জনস্বাস্থ্য এবং মহামারী প্রতিরোধে এক সুঠাম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য নীতির মুখ্য বিষয় ছিল মহামারী-সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে জনগণকে অবগত করা, মহামারী প্রতিরোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং এই কর্মযজ্ঞে জনগণকে সামিল করা।



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুস্থায়ী সমাজ গঠনে জনগণের অংশগ্রহণ কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করতেন মহামারী প্রতিরোধ করতে জনসচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি, তিনি আরো মনে করতেন এরূপ গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞের সফলতা নির্ভর করে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশী সমাজ ও পল্লীসমাজ প্রবন্ধে এ বিষয়ে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন। তিনি মনে করেন প্রতিটি পল্লীতে চিকিৎসালয় স্থাপন করতে হবে, দরিদ্র নিপীড়িত মানুষজনের ঔষধ ও সেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, তাছাড়া পল্লীর পথঘাট নির্মাণ, পুষ্করিণী সংস্কার, পানীয় জলের সুব্যবস্থা করে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে হবে। ম্যালেরিয়া,কলেরা,বসন্ত, প্রভৃতি মহামারী আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং রোগে মৃত্যুর সংখ্যা,জনস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং অবনতির তথ্য বিবরণী লিপিবদ্ধ করতে হবে।


পল্লীর জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই কাজের শুভ সূচনা ঘটে পল্লী চিকিৎসালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে। তিনি পাতিসর, কামতা এবং রাতোয়ালে হাসপাতাল স্থাপন করেন। শুধু হাসপাতাল স্থাপন করি তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির স্বার্থে রাজ্যে গবেষণাগারে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি জাতীয় স্বাস্থ্যের উপেক্ষার দিকের প্রতিও দৃষ্টিপাত করেন, তিনি আরো বলেন ভারতে মহামারী এবং নিরাময়যোগ্য রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ও ব্যাপক, এ বিষয়ে সকলের চিন্তাভাবনার দিন এসে গেছে।



আজ যখন গোটা পৃথিবী মহামারীর কবলে, দেশ জাতি সমাজ এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে, জনস্বাস্থ্য যখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে, তখন মহামারী নিবারণে রবীন্দ্রনাথের পদক্ষেপ আমাদেরকে নতুন করে ভাবায়, নতুন করে শিক্ষা দেয়, নতুন আলোর পথ দেখায়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ যে চিন্তাভাবনা করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। একমাত্র জন সচেতনতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই কঠিন সংগ্রামের একমাত্র পথ, এই সহজ-সরল সত্যটা আজ আমরা উপলব্ধি করতে পারছি।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন