প্রেম প্রসঙ্গে
রবীন্দ্র -নজরুল
===============================
ভাস্কর পাল
===============================
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য জগতের দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। বাংলা সাহিত্যাকাশে উভয়েরই বিশাল ব্যাপ্তি।স্বীয় প্রতিভার আলোকে বাংলার সাহিত্যাকাশকে অতীব আলোকিত করেছেন দুই মনীষীই। সর্বগ্রাসী প্রতিভা দিয়ে সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় হীরকদ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন যখন রবীন্দ্রনাথ, সে সময়ে নজরুল এলেন ভিন্নপথের আলোর দিশারী হয়ে।রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে তৈরি করলেন নিজস্ব পথ, উন্মুক্ত করলেন গতিময় আলোর ফটক। অতি অল্পসময়ে জনপ্রিয়তার চূড়ায় অবস্থান নিলেন। জয় করলেন জনহৃদয়।অথচ প্রেমের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল উভয়েই সেই উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক যাঁদের আলোকধারায় স্নাত হয়েছে মানবজাতি।
প্রেম কী? প্রেম(Romance) হল ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত একটি উত্তেজনাপূর্ণ, যৌনতাপূর্ণ এবং রহস্যময় অনুভূতি। এটি হল কোন ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত কোন আবেগীয় আকর্ষণ হতে উদ্বুদ্ধ একটি বহিঃপ্রকাশমূলক ও আনন্দঘন অনুভূতি।মনোবিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডহোমের সংজ্ঞানুযায়ী প্রেম হল "একটি প্রবল আকর্ষণ যা কোন যৌন-আবেদনময় দৃষ্টিকোণ হতে কাওকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে, এবং যাতে তা ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার মনোবাসনাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর ভালোবাসা (Love) একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা।আমরা কল্পনা করলে দেখতে পাই আমাদের অন্তরে বিরাজমান অশান্ত শিশুটি যেন আরেকজনের হৃদয়ে নতুন জন্ম লাভ করছে। অনুভব করতে গেলে বুঝতে পারি, দ্বিতীয় এক অস্তিত্বের নাড়ীর স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে আমাদের দেহে, তার নয়নের জ্যোতি মুহুর্তের মধ্যে জ্বলে উঠে আমার চোখে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনুভব করি, হৃদয়ের উষ্ণ রক্তে সিঞ্চিত ওষ্ঠাধরের প্রত্যুত্তরে উষ্ণ অধরের স্পর্শ । এই হল প্রেম। এই হল বাঁধন। এই হল সেই মহাজাগতিক আকর্ষণ , যা শুধুমাত্র মানুষকে মানুষের সঙ্গেই আবদ্ধ করে না, বরং যা কিছু অস্তিত্বমান, তাকেই একের বাঁধনে বাঁধে। আমাদের জন্ম এই জগতেই। আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাদের জীবনের উপলক্ষ্য। যা আমাদের আত্মার তৃষ্ণাকে আপনিই নিয়ে চলে পরম পরিতৃপ্তির পথে।
শ্রীচৈতন্যদেবের পৌরহিত্যে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার আপামর জনসাধারণ যে প্রেমরস সাগরে ভেসেছিল, তার উৎস ছিল স্বদেশ। আর বঙ্কিমের
প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাংলায় যে
প্রেমরসের সমাবেশ ঘটল, তার প্রেরণা ও উৎস মূলত ইউরোপ। উৎস বা প্রেরণা যা-ই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের কলমের ডগা আর মনের সংযোগে বাংলা কবিতায় প্রেমের যে জগৎ
গড়ে উঠল, তার ব্যবহার ছাড়া সমকালীন শিক্ষিত বাঙালির প্রেমানুভূতির যেন পূর্ণ প্রকাশ
হতো না।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার হাত ধরে
বাংলায় যে ‘আধুনিকতা’ প্রবেশ করে, তা ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তাজগতে একটা ঘোরতর আলোড়ন তোলে। প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি যেহেতু
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, তাই স্বাভাবিক নিয়মেই এখানেও ইউরোপ-আগত প্রেমের ধারণা একটা
বড়সড় ধাক্কা দেয়। বন্যার জলের মতো প্রেমের উচ্ছ্বাস
আছড়ে পড়ে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মনের
দোরগোড়ায়।
'বাঙালি জীবনে ইউরোপ হইতে আনা “রোমান্টিক” প্রেম সেই যুগেই বাংলাদেশে বিলাত হইতে আনা নতুন গোলাপের মত ফুটিতে লাগিল'। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এই নতুন গোলাপের প্রথম মালী বা বলা যায় ‘বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জীবনে নূতন “রোমান্টিক” প্রেমের প্রবর্তক।
রবীন্দ্রনাথের
প্রজন্মে এসে ইউরোপীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে আগত এই রোমান্টিক প্রেম দাম্পত্য জীবনের অন্দরমহল পর্যন্ত ঢুকে পড়ে।যে অমোঘ জলস্রোতে ভেসেছিলেন সয়ং কবি নজরুলও।
সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালবাসা রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘প্রেম’ বলেছেন। বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ্য অনুভব করে আপন সত্তাকে সমর্পণের
আকুতিই মানব-মানবীর প্রেমের প্রথম ও প্রধান নির্দেশক।
কবির ভাষায়— “আমি তোমাকে ভালবাসি অস্থিমজ্জাসহ”। সত্যিকারের প্রেমের প্রকাশ তো এটাই।
সম্পর্ক গঠনের ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’ —এমন প্রশ্নও উঁকি
দেয় অনেকের মনে। একজন মানব কিংবা মানবী যখন বিপরীত
লিঙ্গের কাউকে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’; তখন সেটা আসলে
প্রেমেরই নির্দেশক।
গ্রিক উপকথা
অনুযায়ী, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে দেবতা
কিউপিড যখন কাউকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়েন বা কাউকে তিরবিদ্ধ করেন তখন ওই মানব কিংবা মানবীর ভেতর প্রেমের ক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই সময়কে বলা হয় ‘অবসেশন পিরিয়ড’ (ঘোর লাগা সময়)।
শেষের কবিতায়
লাবণ্য’র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অমিত রায় বলছে, “সেই শৈশব থেকে সমস্ত দিন যেন অবচেতন মনে তোমার পায়ের শব্দ শুনে আসছি। মনে
হয়েছে, কত অসম্ভব দূর থেকে যে আসছো —তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছুলে তো আমার জীবনে”। (শেষের কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
বৈষ্ণব পদাবলীর পরে বাঙালি তার বিচিত্র
প্রেমানুভূতি সবচেয়ে বেশি খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। শিক্ষিত ‘আধুনিক’ বাঙালি সমাজ শুধু সমকালে নয়, রবীন্দ্র পরবর্তী শতাব্দী ধরে ব্যবহার
করছে নিজের প্রেমানুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য।
মানব
রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম এসেছিল নীরবে। সেই প্রেম সরব হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। আমরা রবীন্দ্র-জীবনে যে সব নারীদের পরিচয় পাই তাদের মধ্যে অন্যতমা হলেন মারাঠি কন্যা আন্না তড়খড়, কাদম্বরী বৌঠান, আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং
রবীন্দ্ররচনার গুণমুগ্ধ পাঠিকা হেমন্তবালা দেবী।
মুম্বাই থাকাকালে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন কবি
রবীন্দ্রনাথ। অধুনা মুম্বাইয়ের মারাঠি কন্যা,নাম আন্না তড়খড়। এই প্রেম খুব অল্প সময়ের
জন্য হলেও বেশ তাৎপর্যময়। কবি তখন সবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে। মারাঠি কন্যা কবির কাছ থেকে ভালোবেসে একটি ডাক নাম চেয়েছিলেন। কবি তাকে ডেকেছিলেন ‘নলিনী’ বলে ।সেই নাম পেয়ে
আন্না বলেছিলেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণ
দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি”।
‘নলিনী’ নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ই প্রিয় ছিল। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহু
কাব্য-গল্প-নাটকে এই নামটি এসেছে বহুভাবে। পরবর্তীতে তরুণীর কথা স্মরণ করতে দেখা যায় কবিকে। আন্নার সঙ্গে কবির প্রেম ছিল মাত্র মাসাধিক যদিও
বহুদিন তার সঙ্গে কবির পত্র যোগাযোগ ছিল ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বয়ঃসন্ধির দিনগুলোতে কাদম্বরী বৌঠান খুব বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন। কাদম্বরী বৌঠান ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্থপতি। কিশোর মনে ছাপ ফেলতে কাদম্বরীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। জ্যোতিদাদার সহধর্মিণী কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনে প্রায় সমবয়সী ছিলেন। কবির অনেক সাহিত্য ও কবিতা সৃষ্টি এই নিঃসঙ্গ, রিক্ত এই নারীটিকে ঘিরেই। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখেন, “সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল”।
এই লেখাটি প্রকাশের পরেই ঠাকুরবাড়িতে তার
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় আর এর কিছুকাল পরেই কবি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন। কিশোরী বৌদিটির সঙ্গে বালক রবির সম্পর্ক ছিল সৌখিন ও খুঁনসুটির। দুজনের মধ্যে
বোঝাপড়ার সুসম্পর্ক “চারুলতা” এবং “নষ্টনীড়ে” এই লেখার ভেতর দিয়ে সেই অনুভব স্পর্শ করা যায়।
কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই
প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই
বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর
সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা
সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম কথাটি আলোচনায় এলেই দৃশ্যপট জুড়ে এসে পরে আর্জেন্টিনার প্লাতা নদী। যে নদীর তীর ঘেঁষে বিশ্বকবির সঙ্গী হয়ে পথ চলেছেন বিদেশিকন্যা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। যাকে খাবার টেবিলে স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থে বিমুগ্ধ ছিলেন ওকাম্পো। কোনো এক ফরাসি সাহিত্যিকের অনূদিত গীতাঞ্জলি পড়েই ওকাম্পো প্রেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথের।ক্রমেই কবির কাছে তিনি ভালো লাগার যে আবেদন প্রকাশ করেছেন তাতে দুজনের মধ্যে বেশ গোছানো একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়।
সাতান্ন বছর বয়সে একটি তরুণী উদিত হন তার জীবনে
যার নাম রানু অধিকারী। কাশীবাসী এক অধ্যাপকের উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী কন্যা। ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তার কাছে রবীন্দ্রনাথের দেবত্ব ছিলো অর্থহীন।
সবাই গুরুদেব বলে সম্মান জানালেও তিনি সম্মানের দূরত্ব রাখেননি। নিজের থেকে ৪২ বছরের বেশি বয়সী এক জগদ্বিখ্যাত বুড়োর বন্ধুতে পরিণত করেন।
তার চিঠিপত্রের মধ্যে নিজের ভালো লাগাটাকে লাগাম দিয়ে থামিয়ে দিতে চাননি।
ষোলো বছর বয়সে
রানু যখন শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে কবিকে ছাড়লেন, তখন কবির মনে হয়েছিলো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার সে সময়কার
অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ পেয়েছে কেবল তখনকার গান আর কবিতা থেকে। এর বহু বছর পরেও তার কথা মনে রেখে, তিনি গান লিখেছেন-
“ওগো তুমি পঞ্চদশী, পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে”
পরবর্তীতে রবীন্দ্র-জীবনে পাওয়া যায় গুণমুগ্ধ পাঠিকা হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর সদর্প উপস্থিতি।রবীন্দ্রনাথ ও হেমন্তবালা এই দুজনের মধ্যে আলাপ হতো পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে।কবিকে হেমন্তবালা ডাকতেন ‘কবিদাদা’। নানা অজুহাতে, পারিবারিক বাধা সত্ত্বেও এমন কি রাতের বেলায়ও ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে হঠাৎ গিয়ে হাজির হতেন তিনি।
হেমন্তবালা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেন, “আপনি আমার দেবতা, আমার কল্পলোকের রাজা। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমার পূর্ণ পূজা আপনার চরণে দিতে পারছি না। আপনি কি আমার মন দেখতে পারছেন না”? চিরসবুজ রবীন্দ্রনাথ গুণমুগ্ধ এই পাঠিকাকে স্বভাবসুলভ গুণেই আপন করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রেম সম্পর্কে প্রত্যেক পুরুষেরই একটা স্বেচ্ছাচারী ধারণা থাকে, যা স্বআরোপিত যখনই তা বাস্তব মননের সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের সাথে অমিল হয়ে যায় প্রেমিকের ভালোবাসা তাসের ঘর ভেঙ্গে পড়ে। পুরুষ সেটাকেই বাস্তব ধরে নিয়ে স্রোতের সাথে তার জীবন এলিয়ে দেয়, অথচ সারাজীবন না পাওয়ার আক্ষেপ বয়ে বেড়ায়।কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমের সাথে তার কোন আপোষ ছিল না। নজরুলের জীবনে নারীর প্রতি প্রেম মূলত তিন রূপে এসেছিল প্রথম নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয় তার স্ত্রী প্রমিলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। এর মাঝে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ ছিল কিংবদন্তী তুল্য।
নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। কোনও এক রাতে বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। তিনি নজরুলকে এসে জানতে চান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয়ের পরই নজরুল সেই যুবতী মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তার আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ যা ধীরে ধীরে বিবাহের দিকে টেনে নিয়ে যায় যদিও পরবর্তীতে তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে । মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ভগ্ন হৃদয় কবি নার্গিসকে লেখেন-
যারে হাত দিয়ে
মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে
ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি
আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি
দাড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও
না আর
নিশীথ অন্ধকারে।
দীর্ঘ ১৬ বছরের
বিছেদে যন্ত্রণায় কাতর তাঁর লেখায় অনুভব করি ক্রন্দনরত কবির আবেগঘন স্বর।
দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর
আমারে লইয়া খেল না
নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও
ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা।
তিনি তাঁর
প্রেমিকা তাঁর পরম প্রিয় নার্গিসের থেকে দূরে সরে যাওয়ার আকূল আর্তি নিয়ে লেখেন-
আমি ফিরি পথে, তাহে কর ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল
মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোন
দিন এসে দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে।
ভুলে যাও মোরে
ভুলে যাও একেবারে।
স্বভাব বিদ্রোহী নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহ থাকলেও প্রেম ও প্রকৃতির মাঝেও পাই এক অপূর্ব মেলবন্ধন। তোমারে পড়িছে মনে কবিতায় তিনি লেখেন -
আজি হেথা রচি নব
নীপ মালা-
স্মরণ পারের
প্রিয়া, একান্তে নিরালা
অকারণে! জানি আমরা
জানি
তোমারে পাব না আমি
এই গান, এই মালা খানি।
বস্তুত তার সাহিত্যের ছদ্মাবরণে মিশে আছে মানবপ্রেম যেখানে লিখনশৈলীতে ধরা দেয় কাব্যপ্রেমী ও প্রেমানুরাগী মন কিংবা নিষ্পেষিত নারীদের। মানবতাবাদী কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তার স্থান অনস্বীকার্য। অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি পেয়ে মানবতার জয়গান গেয়েই লিখেছেন-
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
যুগে যুগে তার গান ও কবিতা প্রেরণাদায়ক হয়ে আছে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে। আবার কোন কোন কবিতায় প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিকে কাছে টেনে নিয়েছেন। তাঁর লেখায় প্রকৃতি ও প্রেমের স্পর্শ অনুভব করা যায় হৃদয়েতে-
জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী
নিশীথ রাতের বন্ধু
আমার গুবাক-তরুর সারি !
কিংবা -
মাঝে মাঝে আমাদের মানসপটে ভেসে আসে-
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচ্ছে,
গীত শেষে বীণা পড়ে
থাকে ধূলি মাঝে।
সৌন্দর্য অনেকখানি তার প্রকাশধর্মিতার ওপর নির্ভরশীল। এই সৌন্দর্য উন্মোচনের উপায় কৌশলে যিনি সফল তিনিই হতে পারেন আক্ষরিক অর্থে কবি কিংবা শিল্পী।উন্মোচনের পথপরিক্রমায় দুটি বিষয় এসে সামনে দাঁড়ায়। সাহিত্যকেন্দ্রিক পরিভাষায় যাকে ক্লাসিক ও রোমন্টিক নামে অভিহিত করা হয়। ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য নিরূপণের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা থাকলেও কালে কালে উভয়ের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক স্থাপনেরও চেষ্টা চলেছে। ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমকে সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা কঠিন বিষয়। ক্লাসিসিজম হল একটি সাহিত্যিক মতবাদ , একটি সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি । লোকে যাকে বলে ‘ধ্রুপদী সাহিত্য’ । সাধারণতঃ যে সাহিত্যে থাকে সুসংযত রীতি , গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষা , ঐতিহ্যের অনুবর্তন – তাকেই বলে ‘ক্লাসিক সাহিত্য’ । আর সাহিত্য সৃষ্টিতে এই ভাব , ভাষা , রীতি ও আদর্শকে গ্রহণ করার নামই হল ‘ক্লাসিসিজম’ । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , ক্লাসিক মানে একটি সর্বাঙ্গসুন্দরতার পারফেকসনের ফর্মে অচল প্রতিষ্ঠা । Romanticism' হলো মূলত ইংরেজি শিল্প, সঙ্গীত, বুদ্ধিজগৎ ও সাহিত্যের দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি আন্দোলন, একটি নির্দিষ্ট শাখা বা সময়ভিত্তিক বিভাজন, যা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে পরিলক্ষিত হয়। এর অর্থ আসলে ঠিক যেরকম অধিকাংশ মানুষ ভেবে থাকেন তা নয়, Romantic Literature বা Romanticism নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি মূলত মানুষ ও প্রকৃতির সংযোগ, সাহিত্যে মুক্ত, শৈল্পিক, নান্দনিক চিন্তার বিকাশ ও মাটির কাছাকাছি বেঁচে থাকার কথা বলে। এর আরেক নাম 'The Return to the nature' । William Wordsworth ও Samuel Taylor Coleridge এর যৌথ প্রচেষ্টায় Lyrical Ballads এর প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে Romanticism এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।তবে ক্লাসিসিজম বলতে বোঝায় বর্হিমুখিনতা, আর রোমান্টিসিজম অর্ন্তমুখিনতা। একটি বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেয়, অপরটি আত্মনিষ্ঠতা। প্রথমটি অনুভূতির ব্যাপারে নিস্পৃহ আর অপরটি এ ব্যাপারে আরোপ করেছে গভীর গুরুত্ব। `Classic art portrays the finite, Romantic art the infinite.’ কাসিক্যালরা ভাবনার অতিন্দ্রিয় জগতে বিচরণ না করে জগৎ ও জীবনকে বস্তুময়রূপে প্রকাশে আগ্রহী। অন্যদিকে রোমান্টিকরা জগৎ ও জীবনকে প্রকাশ করবার জন্যে ব্যঞ্জনা ও আভাসের আশ্রয় নেন। অসীমের প্রতি সীমাহীন বিস্ময়বোধ রোমান্টিক ভাবনার মূলে কাজ করে। আর কাসিকধর্মিতায় থাকে বস্তুকে যে রূপে দেখা হয় সে রূপেই প্রকাশের আর্তি।
তবে প্রকৃত পক্ষে রোমান্টিসিজম ও ক্লাসিসিজম কোনো বিরোধ নেই। দার্শানক ক্রোচে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন-“A great poet is both classic and romantic.”
রবীন্দ্রনাথ আর কবি নজরুলের ক্ষেত্রেও কথাটি অনিবার্য
সত্য। উনারা উভয়েই একাধারে ক্লাসিক ও রোমান্টিক। ইনাদের কাব্যযাত্রায় দুটি ধারাই সমান্তরালগামী। উভয়ের ভেতরেই বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি ও নারী চেতনা সবকিছুর মূলেই রয়েছে প্রবল রোমান্টিকতাবোধ। নজরুলের
কবিতায় বিপ্লবের তুমুল প্রকাশ যতোখানি প্রেম, বিরহ ও অভিমানের গাঢ়তাও কোনো অংশে কম নয়।
প্রেম মানবজীবনের মৌলিক ও অনিবার্য উপস্থিতি। প্রেম
মানুষকে যেমন পূর্ণতার আলোকে সমুজ্জ্বল করে, তেমনি এর কারণেই মানুষ রিক্ততার অতলান্তে
নিপ্তি হয়। প্রেমে আছে মিলনের মহামহিম
আনন্দ। আবার উল্টোপিঠেই করুণ কষ্টের মর্মজ্বালা। নজরুল রোমান্টিকপ্রবণ বলেই তার কাব্যে প্রেমের আনন্দিত প্রকাশের
চেয়ে বিরহবিলাসই প্রবল। তার কবিতা, গানে বিষন্ন বেদনার প্রকাশ লক্ষণীয় ।
বিশেষ করে ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ও ‘বাঁধনহারা’ এ তিনটি রচনাতেই তিনি অপরিমেয় অভিমানী ও দুঃখবিলাসী। কারণ প্রেমের দীপশিখাটিকে
প্রোজ্জ্বল করে রাখে বিরহ। সম্ভাবনার দূর মরীচিকায় আকাঙ্খার সলতেটাকে উস্কে রাখে দুঃখ। দার্শনিক শ্লেগেল বলেছেন, -“There is no
bond of love without a separation, no enjoyment without the grief of losing
it.”
তাইতো চিরঅভিমানী
নজরুল চাঁদকে পাওয়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল সমুদ্রের দুঃখের সঙ্গে নিজের কষ্টকে
মিলিয়ে উচ্চারণ করেন,
বাসনা-তরঙ্গে তব
পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর,
ছায়া সে তরঙ্গে
ভাঙে, হানে মায়া, ঊর্ধ্বে প্রিয়া স্থির!
ঘুচিলনা অনন্ত
আড়াল,
তুমি কাঁদ আমি
কাঁদি কাঁদে সাথে কাল!
কাঁদে গ্রীষ্ম
কাঁদে বর্ষা বসন্ত ও শীত,
নিশিদিন শুনি
বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত,
নিখিল বিরহী কাঁদে
সিন্ধু তব সাথে,
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি কাঁদে প্রিয়া রাতে!
সেই অশ্রু-সেই
নোনা জল
তব চঞ্চল হে বিরহী
বন্ধু মোর-করে টলমল!
এক জ্বালা এক
ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি
কাঁদি কাঁদে মোর প্রিয়া।
নজরুলের কবিতায়
যৌবনের জয়ডংকায় শব্দপ্রাণ অত্যন্ত সজীব। সেখানে ধ্বংসের উন্মাতাল দিক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আত্মসমর্পিত প্রেমিক
হৃদয়ের সৃজন বেদনা-
হে মোর রানি!
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয় কেতন
লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর
তরবারী
দিনে দিনে কান্তি
আনে, হয়ে ওঠে ভারী,
এখন- এ ভার আমার
তোমায় দিয়ে হারি
নজরুল দুঃখ কষ্ট প্রেম বিরহ যাতনায় উদ্বেল হয়ে তার রচনায় যে সুন্দরকে সৃষ্টি করেছেন তাকে আরও মধুর ও লাবণ্যময় করেছে তার প্রকৃতি বন্দনা। সব কবিই প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেন। কিন্তু সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশের দুঃসাহস হয়তো ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো দু-চারজন কবিই দেখাতে পারেন। নজরুল সে অর্থে প্রকৃতির কনি নন। তবু প্রকৃতিবন্দনার মধ্য দিয়েই তিনি প্রেমের উদ্দীপনা ও বিরহমালাকে গ্রথিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন।
এক জন রোমান্টিক মানুষের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও ছিল অত্যন্ত প্রকট। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের প্রতি আকর্ষণ, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ রবীন্দ্র প্রতিভার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের প্রেমানুভূতিকে দারুণভাবে শাসন করেছে। ফলে প্রেমানুভূতির জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে নারীর প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। বরং নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে তিনি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। এ কারণে একসময় যে নারী ছিল সংসার-সীমার বাইরে কল্পনার মায়াঞ্জন মাখা, সে যখন সংসারের মধ্যে এসেছে তখন ওই নারী আবিষ্কার করেছে যে তাদের মধ্যে আগের সেই প্রেমের তীব্রতা নেই। নারী নিজেই তাদের প্রেম ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা করেছে এভাবে,
“এখন হয়েছে বহু কাজ,
সতত রয়েছ অন্যমনে।
সর্বত্র ছিলাম আমি
এখন এসেছি নামি
হৃদয়ের
প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে”। (‘নারীর উক্তি’, মানসী)
প্রেমিক পুরুষকে
দিয়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর একই কাব্যের ‘পুরুষের উক্তি’ কবিতায় একই কথা বলিয়েছেন,
“কেন মূর্তি হয়ে
এলে
রহিলে না ধ্যান
ধারণার”?
রবীন্দ্রনাথের
প্রেম সম্পর্কিত এই ধারণা ইউরোপীয় রোমান্টিক কাব্যধারার প্রবাহিত উষ্ণ প্রসবন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের প্রশ্নে ছিলেন আদ্যোপান্ত বিশুদ্ধতাবাদী। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে তিনি বরাবরই গৌণ মনে করতেন। বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতায়। ওই কবিতায় কবি তাঁর প্রেয়সীকে দেবী সম্বোধন করে বলেছেন,
“আনিয়াছি ছুরি
তীক্ষ্ণদীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম—
লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন এ কালো নয়ন মম।
এ আঁখি আমার শরীরে
তো নাই, ফুটেছে মর্মতলে—
নির্বাণহীন
অঙ্গারসম নিশিদিন শুধু জ্বলে।
সেথা হতে তারে
উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ—
তোমার লাগিয়া
তিয়াষ যাহারা সে আঁখি তোমারি হোক”।।
অন্ধ হয়ে গেলে যা হবে তা-ই তো সুরদাসের তথা কবির আরাধ্য, ‘হৃদয়-আকাশে থাক-না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি’। এ কারণে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর রবীন্দ্রকাব্য-পরিক্রমা গ্রন্থে বলেছেন, “যে প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের চারিপাশে ঘুরিয়া মরে, ব্যক্তি-মানুষের বাস্তব দেহ-মন যাহার ভিত্তি, সেই আবেগময়, আত্মহারা, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়।...প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে ধরা যায় না। দেহসম্বন্ধ বিরহিত, অপার্থিব সৌন্দর্যের নিবিড় অনুভূতি এক অনির্বচনীয় আনন্দরস”।
তাই তো কবি
প্রেমকে ভাষায় প্রকাশ করেন -
‘লও তার মধুর সৌরভ,
দেখো তার সৌন্দর্য
বিকাশ,
মধু তার করো তুমি
পান,
ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী
চেয়ো না তাহারে।
আকাঙ্ক্ষার ধন নহে
আত্মা মানবের।’
(‘নিষ্ফল কামনা’, মানসী)
মধ্যযুগের বাংলা কবিতার শারীরিক প্রেমের সাপেক্ষে এই প্রেম নতুনই বটে। প্রেমের এই ধারণা যে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গোগ্রাসে গ্রহণ করবে তা বলাই বাহুল্য। আদতে হয়েছেও তা-ই। প্রেমের এই শালীন, শৈল্পিক আর সূক্ষ্ম রূপই ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সেদিন উন্মাতাল করেছিল; আবিষ্ট করেছিল। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে এই শ্রেণি প্রেম সম্পর্কে যে ধারণা আর রুচি অর্জন করেছে, সেই ধারণা আর রুচিরই প্রতিফলন সে লক্ষ করেছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ইউরোপের ভিক্টোরিয়ান আদর্শবাদ দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন, সেহেতু তিনি প্রেমের প্রশ্নেও বিশুদ্ধতাবাদী। এ কারণে আমরা তাঁর প্রেমের কবিতায় নারীকে প্রায়শই ধরতে-ছুঁতে পারি না। ধরা ও ছোঁয়ার অনুভবের বাইরে বসবাস রবীন্দ্রনাথের নারীদের।চিত্রা কাব্যের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় তাই প্রেমের দেবতাকেও দেখা যায় বিজয়িনীর পদপ্রান্তে তির-ধনুক সমর্পণ করে তাকে দেবীর মতো প্রণাম করতে। নারীর দেবীর মহিমায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথে এত স্পষ্ট যে উদাহরণের দরকার পড়ে না। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুলের নারীপ্রেমের কবিতাকে রাখলে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। নজরুলের কাঙ্ক্ষিত নারী কবিতায় শারীরিকভাবে এত স্পষ্ট যে চাইলেই যেন তার চিবুকটা ছুঁয়ে দেখা যায়, তার শারীরিক অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নারী যেন রক্ত-মাংসের নারী নয়, দেবী। রবীন্দ্রনাথের নারীর এই দেবীতে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে বোধ করি রবীন্দ্রনাথের আবাল্য সংস্কারের মধ্যে দেবীমূর্তির আর ইউরোপীয় ‘পিউরিট্যানিজ্ম’ বা বিশুদ্ধতাবাদী চিন্তার প্রতিফলন।রবীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁসের চেতনায়¯স্নাত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কবি বলেছেন-
“কেন তাকে ভালবাসি
এ প্রশ্নের মিলবে
না কোনো সদুত্তর
এমন কোনো জাল নেই —
যা দিয়ে আটকে রাখা
যায় তাকে ...”
প্রাসঙ্গিক ভাবেই
ফিরে আসি নজরুলের কথায় ।
কবি নজরুল তার বিখ্যাত দুটি কবিতা লেখেন, বিদ্রোহী ও ভাঙার গান। নজরুল ইসলামের অন্তরের গভীর মর্মপীড়ার ফসল। কে এর প্রেরণার উৎস – নার্গিস না প্রমীলা? নজরুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্য কর্মে এই দুই নারীর অপরিসীম প্রভাব মুল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে প্রেমের জগতে অন্তরের গভীর প্রাধান্য পেয়েছিল নার্গিস।পক্ষান্তরে প্রমীলাকে নিয়ে কবি জড়িয়েছেন জীবন জগতে বাস্তবে”। নজরুলের সঙ্গে তার ভাবী পত্নী কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তের পূর্বরাগ চলছে সেই প্রেম নিবেদনের পালা ফুটে ওঠে ‘বিজয়িনী’ কবিতায় —–
হে মোর রানী !
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন
লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমা সমর-জয়ী অমর
তরবারী
দিনে দিনে
ক্লান্তি আনে, হ’য়ে উঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার
তোমায় দিয়ে হারি
এই হার-মানা-হার
পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন – দেবী!
আমায় দেখে কখন
তুমি ফেল্লে চোখের জল,
আজ বিশ্ব –জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই
রক্ত রথের চূড়ে,
বিজয়ীনি!
নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তুণ আমার আজ
তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন
জলে ভেসে’।
তিনি প্রেয়সী
প্রমীলার রূপে বর্ণনা তুলে ধরেন ‘দোদুল দুল’ কবিতায়।
মৃণাল – হাত
নয়ান – পাত
গালের টোল,
চিবুক দোল
সকল কাজ
করায় ভুল
প্রিয়ার মোর
কোথায় তুল?
কোথায় তুল?
কোথায় তুল?
কাকঁল ক্ষীণ
মরাল গ্রীব
ভুলায় জড়
ভুলায় জীব,
গমন – দোল
অতুল তুল্ ।
(দোলন চাঁপা কাব্য গ্রন্থ)
অবশেষে নজরুল প্রমীলা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।নজরুল প্রমীলার বিয়ে খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে অনুষ্ঠিত হয় নি। ছেলে মুসলিম-মেয়ে হিন্দু হওয়ায় অনেক সামাজিক গুঞ্জন ও বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে, তাই অনেকটা চুপচাপেই বিয়ে সম্পন্ন হয়।
পরবর্তীতে নানাবিধ সমস্যা সংঘাত শারীরিক অবক্ষয় নানা অভাব-অনটন, সংগ্রাম ও সংঘাতের মাঝে প্রমীলা দেবী তার সংসার টিকিয়ে রাখেন। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।
এর কিছুসময় পর নজরুলের প্রেমিক জীবনে আসে ফজিলতুন্নেসার স্নিগ্ধতা। মাত্র তিনজন ব্যক্তি এই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত প্রথম জন ফজিলতুন্নেসা, দ্বিতীয় জন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং তৃতীয় জন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যকেউ নজরুল-ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে জানতেন না। নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হন। দুই-তিন বছর নজরুলের অনুরাগ টিকেছিল। পরে ফজিলতুন্নেসা বিদেশে পড়তে গিয়ে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহের ছেলে সলিসিটর জনাব শামসুজ্জোহাকে পছন্দ করেন, পরবর্তিতে তাদের বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে নজরুলের জীবনে ফজিলতুন্নেসা পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
ফজিলতুন্নেসার
বিলেত গমন উপলক্ষে তিনি ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশ্যে একটি গানটি পরিবেশন করেন-
‘জাগিলে পারুল কিগো
‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে,
উদিলে চন্দ্র-লেখা
বাদলের মেঘের ফাঁকে।।
চলিলে সাগর ঘু’রে
অলকার মায়ার পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য
যেথায়
জীবনের
ফুল্ল-শাখে।।
আঁধারের বাতায়নে
চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে
ভুলে,
এ পারের মর্ত্য
কূলে,
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর
বাঁকে।।
এই কবিতা তার বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু কবিতাটি এমন নৈব্যক্তিকভাবে লেখা যে অধিকাংশ পাঠকের পক্ষে এর রূপকের রহস্য ভেদ করা কঠিন। তার শুধু দেখবেন প্রকৃতি কিভাবে বর্ষা ঋতু থেকে শীত ঋতুতে রূপ পরিবর্তন করছে। অথবা অন্য ভাবে বলা যায় যে, তিনি তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে চেতনাশ্রিত কল্পনায় এমন ভাবে জারিত করে নিয়েছিলেন যা থেকে তিনি মুক্তার মত এমন কতকগুলো কবিতা রচনা করেন যা তার অনুভূতিকে বিনয় চারিত্র্য দান করেছে’।
‘ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়।এই সময় লক্ষ্য করা যায় কবি তার আকাঙ্খিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরেছেন যেখানে প্রেমে কোন নৈরাশ্য নেই, কোন বেদনা নেই। প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ আত্মসমর্পন কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা বা ঈশ্বর ভাবনার দিকে ঝুঁকে পড়লেন’। পার্থিব প্রেমকে বিদায় দিয়ে নজরুল লেখেন-
পরজনমে দেখা হবে
প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা
ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম
করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।
হেথায় নিমেষে
স্বপন ফুরায়
রাতের কুসুম
প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে
হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা-ভরা
হেথা অমিয়।।
হেথা হিয়া উঠে
বিরহে আকুলি,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,
হৃদয়ে যথায় প্রেম
না শুকায়-
সেই অমরায় মোরে
স্মরিও।
সত্যিকার অর্থে প্রেম এবং প্রেমময় সৃষ্টি কবিকে যেন আজ অমর করে রেখেছে। আর এই প্রেমবোধ কবিকে কাদিয়েছে, হাসিয়েছে সর্বোপরি ভিন্ন আঙ্গিক সৃষ্টির রসদ যুগিয়েছে।তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, ব্যক্তির উপাসক নন। যে নারীর ভিতর সেই সৌন্দর্যের বিকাশ দেখেছেন এবং সে নারী তার মনে সেই পূজার যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করেছেন, তাকে পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা নিষেধ মানতে তিনি রাজি নন।
এমনই এক বাঁধনহারা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার মানুষ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি সুন্দরের পূজা করেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। যে হাতে বাঁশি সুর তুলেছে সে হাতেই রণতূর্য বেজেছে। যা অন্য কারও মধ্যে দেখা যায়নি। আর শাশ্বতপ্রেম বলতে যা বোঝায় তা হয়তো নজরুলের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।আবার কিন্তু এসব কিছুর পরও ‘আঁধার রাতের এক একলা’ রবীন্দ্রনাথ আবিস্কৃত হন। বিষন্ন প্রজ্ঞায় তিনি খুঁজে পান না কাউকে, কোনো এক শিপ্রা নদীতীরে “পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে” তিনি আর খুঁজে পান না। সাহিত্যের ক্যাথারসিস ছেড়ে একজন রবীন্দ্রনাথ তখন আকাশ পেরোনো নিঃসঙ্গতা নিয়ে বুকের কাছের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন। আকাশ তখন অন্ধকার, বাতাসের ব্যাকরণে সূর্যমুখী সুখ, কবিতার খাতায় হরিণীর পোট্রেট, সকল শব্দেরা প্রাঙমুখী.. ..।
কেবল রবীন্দ্রনাথ একা- আমাদের প্রতিদিনের নিঃশ্বাসের মতো একা, কোনোদিন প্রশ্বাসের সঙ্গে তার দেখা হয়
না।
অতঃপর আবার
রবীন্দ্রনাথ, এক টুকরো স্মিতহাস্য ভালোলাগার মতো।
তথ্যসূত্রঃ-
১। ভালোবাসার
কাঙাল রবীন্দ্রনাথ, গোলাম মুরশিদ
২। ওকাম্পোর
রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ
৩। রবিজীবনী, প্রশান্ত পাল
৪। রবীন্দ্র জীবনে
নারী, মুহাম্মদ জমির হোসেন
৫। মৈত্রেয়ী ও
রবীন্দ্রনাথ, হাসনাত আবদুল হাই
৬। ‘কুমিল্লায় নজরুল’ – আবদুল কুদ্দুস।
৭। ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ – কমরেড মুজফ্ফর আহমদ
৮। ‘যুগস্রস্টা নজরুল’ – খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন
৯। ‘স্মৃতিকথা’ – কাজী মোতাহার
হোসেন (প্রবন্ধ সংকলন)
১০।‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ – সৈয়দ আলী আশরাফ
১১।‘সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম’ – মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
১২।‘কাজী নজরুল ইসলামঃ জীবন ও সাহিত্য’ – রফিকুল ইসলাম
১৩।বিভিন্ন
সমসাময়িক ব্লগ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন