নজরুল রচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
============================
এ. কে. আজাদ
============================
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ।।
পৃথিবীর আদিকাল থেকেই মানুষেরা বিভিন্ন কারনে বিভিন্নভাবে দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে আসছে। কেউ রাজনৈতিক কারনে, কেউ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় কারনে, কেউ ভৌগলিক কারনে, আবার কেউ ভাষাগত কারনে এই বিভাজনের অংশ হয়ে থাকেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন এই অঞ্চলের মানুষের বিভাজন হয় মূলত ধর্মীয় ভিত্তিতে ‘দ্বিজাতি’ তত্ত্বের আলোকে। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে অপসারনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা হৃত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষেরা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই আন্দোলনেরই একজন ‘তূর্য বাদক’ ছিলেন। তাঁর রচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুঁজতে গেলে এদেশীয় সাধারণ মানুষদের ওপরে ব্রিটিশদের নিপীড়ন এবং তৎপরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলন সম্বন্ধে খানিকটা আলোকপাত করার দরকার আছে বৈকি।
বাঙালী জনগোষ্ঠীর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের উজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয় ফকির সন্যাসী বিদ্রোহের মাধ্যমে ১৭৬০ থকে ১৮০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। সময়মত খাজনা না দিতে পারায় নিজের জমি থেকে উৎখাত হওয়া কৃষকেরা এই আন্দালনে যোগ দিলে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সাধারন মানুষদের মাঝে তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পরবর্তীতে ধর্মভিত্তিক ওয়াহাবী আন্দোলন, তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলিম রায়ত অধিকার আন্দোলন এবং হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহোত্তর কালে বাঙালী শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে খেলাফত আন্দোলনসহ নানান আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীকারের দাবী জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু তার পূর্বে থেকেই হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় গোষ্ঠিসমূহের মাঝে গড়ে উঠে এক তিক্ততম সম্পর্ক। ফলে জাতিতে জাতিতে বাদানুবাদ ছিল এই উপমহাদেশের মানুষদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আর ব্রিটিশ সরকারও ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধকে জিইয়ে রাখা এবং ইন্ধন যোগানে ভূমিকা পালন করেছে নিঃসন্দেহে। ফলে নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও সংঘাতে সর্বদাই লিপ্ত থেকেছে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীরা। এই সুযোগে ভারতীয় আদিবাসী মানুষদের উপরে ব্রিটিশের সাদা চামড়ার খবরদারীটা বেশ ভালই বেড়েছিল। সেই সাথে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে শোষণও করেছে ভারতীয়দেরকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ধূমকেতুর মত এক হাতে ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরি’ আরেক হাতে ‘রণ-তূর্য’ নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে এই ভারতীয় উপমহাদেশে।
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! [ধূমকেতু]
নজরুলের এই যে আগমন, তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি:
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা,
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব জাতির লজ্জা, সকলের অভিমান। [কুলি মজুর]
বিশ্ব নাগরিকের মত কবি নজরুল লিখেছেন সকল মানবের কথা, যেমনটি বলেছিলেন অ্যামেরিকায় জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ‘সঙ অব মাইসেল্ফ (Song of Myself) কবিতায়। তিনি লিখেছিলেন-
Whoever degrades another, degrades me,
And whatever is done or said, returns at last to me. [Song of Myself]
(হুএভার ডিগ্রেডস এনাদার, ডিগ্রেস মি,
এন্ড হায়াস্টএভার ইজ ডান অর সেইড, রিটার্নস এট লাস্ট টু মি)
অর্থাৎ
“যে কেউ যে কাউকে অপমান করে সে অপমান আমারই
(মানুষের বিরুদ্ধে) যা কিছুই করা হোক অথবা বলা হোক তা ফিরে আসে অবশেষে আমারই কাছে।”
এইভাবে মানুষ ও মানবতার জন্য কবি নজরুলের মনে সীমাহীন ভালবাসা তাঁকে করে তুলেছে প্রেমিক, সংস্কারবাদী ও বিদ্রোহী। এ সবের মিলনে আমরা পেয়েছি এক বিপ্লবী নজরুলকে; যে নজরুলের কাছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে কোন বিভেদ নেই, মানুষে মানুষে কোন দ্বন্দ্ব নেই, জাতিতে জাতিতে কোন সংঘাত নেই:
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান ।
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। [মানুষ]
এমন কি জাগতের যত ধর্মগ্রন্থ এবং উপাসনালয় আছে সেগুলো মানবদেহের সমান মুল্যবান এবং পবিত্র নয় বলে কবি নজরুল মনে করতেন। তাই তো তিনি লিখেছেন -
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ, ভজনালয়,
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়। [মানুষ]
নজরুলের কাছে মানুষই সব থেকে বড় কথা। তাঁর কাছে ধর্ম ও সম্প্রদায়গত কোন কারনে মানুষের অপমান গ্রাহ্য নয়। ধর্মের কারনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোন ভাবেই কাম্য নয়। মানুষের মাঝে ধর্মের কারনে বিবাদ এবং মানুষে মানুষে ব্যবধানকে কঠোর সমালোচনা করে তিনি গেয়েছেন সাম্যবাদের গান; গেয়েছেন মানুষ, মানবতা ও মানব-হৃদয়ের গান:
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিক-ক্রীশ্চান ।
গাহি সাম্যের গান-
কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চর্বাক-চেলা? বলে যাও, বলো আরো।
বন্ধু যা-খুশী হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশী পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরান-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক,
জেন্দাবেস্তা গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ!
কিন্তু কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছো শূল?
দোকানে কেন দর কষাকষি?- পথে ফুটে তাজা ফুল।
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব, সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজপ্রাণ!
--------------------------------------
কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত পুঁথি কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
--------------------------------------
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদীনা, কাবা ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা-মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
-----------------------------------------
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই। [সাম্যবাদী]
সুতরাং মন্দির, মসজিদ, গির্জা কিংবা প্যাগোডা নিয়ে দ্বন্দ্বের কিছু নেই- বলে মনে করেন বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, এক ধর্মের জন্য বা কেবল মাত্র কোন এক সম্প্রদায়ের জন্য যখন অন্য কোন উপাসনালয়কে ভেঙ্গে নিজেদের ধর্মীয় সংগীত গাওয়া হয়, তখন সেটা আর ধর্ম-সঙ্গীত থাকে না, সেটা আর প্রার্থনা থাকে না। মানবতাহীন ধর্ম-বিদ্বেষী এমন উপাসনালয় ভাঙ্গাকে কটাক্ষ করে বলেছেন-
ভাঙি’, মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত,
এক মানবের এই রক্ত নেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা। [প্রলয় শিখা]
আবার ধর্মশালা বা উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে এবং নিজেদের স্বার্থবাদীতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ীর দ্বারা মানুষকে যে অপমান করা, হয় বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন কাজী নজরুল। তিনি লিখেছেন-
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা পুরুষ লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।
কোথা চেঙ্গিস, গজনি মাবুদ, কোথায় কালা পাহাড়!
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায়রে ভজনালায়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়! [মানুষ]
ভারতবর্ষ বড় বিচিত্র একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের বাস। এখানে বহু ধর্ম যেমন বিদ্যমান, তেমনি বহু রকম সংস্কৃতিরও প্রচলন। ফলে বিভিন্ন ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষের মাঝে একটা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব চলমান। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম এই প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে দ্বন্দ্বটা বেশ খানিকটা চরম। এক দিকে ব্রিটিশদের দখল, দুঃশাসন আর নিপীড়নের স্টিমরোলার, অপর দিকে নিজ দেশের মানুষের মাঝে অন্তঃকলহ। এসব দেখে বিষিয়ে ওঠে নজরুলের অন্তর, ফেটে পড়েন প্রতিবাদে-
‘বন্ধু গো আর বলিতে পারিনা, বড় বিষজ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারিনা তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা। [আমার কৈফিয়ত]
তিনি ক্ষেপে গেলেও, যা মুখে আসে তাই মুখে বলার কথা বললেও, নজরুলের অন্তরে মহৎ একটা উদ্দেশ্য ছিল। আর সেটা হলো- পরমত সহিষ্ণুতা ও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে- হিন্দু মুসলমানের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করার মাধ্যমে এবং শক্তিশালী জাতিগঠনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের কে বিতারিড়ত করা। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। সুতরাং বড় উদ্দেশ্যকে সফল করতে ছোট ছোট কিছু বিভেদকে ভুলে যেতে হবে- এটাই তাঁর বাসনা। কিন্তু বিদ্যমান জাতি গোষ্ঠিগুলোর সেদিকে খেয়াল নেই। তারা ছোট খাটো বিষয়ে জাত গেলো জাত গেলো বলে- কঠিনতম আচরন করে, যেটাকে ব্যঙ্গ করেছেন কবি:
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছো জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় কো মোয়া!
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই তো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে একশ’খান!
এখন দেখিস ভারত জোড়া
পঁচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত শেয়ালের হুক্কা হুয়া ।
--------------------------------------------
জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল
তাই কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল?
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত
আজ না হয় কাল ভাঙবে সে তো
যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ নাই পরোয়া । [জাতের বজ্জাতি: বিয়ের বাঁশি]
কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন স্বামী বিবেকানন্দের বর্ণিত হিন্দু সমাজের কথা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন -
‘ভারতে যে দিন হইতে এই ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটির উৎপত্তি, সেদিন হইতে ভারতের পতন শুরু, মুসলমান আগমনে নয়। মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায় যে ধর্ম, তাহা আর যাহাই হোক ধর্ম নয়।’’
আর এই যে ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানি, তার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী। এই রকম এক পরিস্থিতিতে নজরুলের আগমন। কাজী নজরুল ইসলাম সব সময়ই চাইতেন এই ভারতবর্ষের প্রদান দু’টি সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য। এই ঐক্য না হলে জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মত জেঁকে বসা শাসকের নামে ব্রিটিশ বেনিয়া শোষকের শ্রেণীকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। তাই উভয় জাতির ‘এক মোহনায় মিলনের বাঁশি’ বাজালেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই উদ্দেশ্যের কথা স্বীকার করে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কে তাঁর ১৯২৫ সালের লেখা পত্রের জবাব দিতে গিয়ে ১৯২৭ সালের শেষ প্রান্তে নজরুল লিখলেন-
‘বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কি না জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি।’
আবার লিখেছেন-
‘হিন্দু-লেখক, জনসাধারন মিলে আমায় যে নিবিড় প্রীতি ও ভালবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তাহলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপারায়ন হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু সভাওয়ালা’, আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু এদের আঙ্গুল দিয়ে গোনা যায়। এদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। ---------
আজকার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমান এইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ - আমি যত বড়ই অসাম্প্রদায়িক হই না কেন।’’
আমি জানি যে, বাংলার মুসলমানকে উন্নত করার মধ্যেই দেশের সব চেয়ে বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর আত্মজাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ আজ রুদ্ধ। হিন্দু মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, এ আমিও জানি। এবং আমিও জানি যে একমাত্র সাহিত্যের ভেতর দিয়েই এই অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে।--------
আমি হিন্দু মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই এদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দুদের দেবদেবীর নাম নিই।
জাত-বিজাত নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিহীনতা নিয়ে ইতিপূর্বে ফকির লালনও (১৭৭২-১৮৯০) কথা বলেছিলেন। আর কোন কবিকে এমন কথা বলতে শোনা গেছে কিনা তা অবশ্য গবেষণার বিষয় বটে। তবে নজরুলের মত এতটা শক্ত করে লালনও বলেননি। তিনি গেয়েছিলেন:
জাত গেল জাত গেল বলে /একি আজব কারখানা,
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সবই দেখি তা না না ।
আসবার কালে কি জাত ছিলে/ এসে তুমি কি জাত নিলে,
কি জাত হবা যাবার কালে/ সে কথা ভেবে বল না ।
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি/ একজলে সব হয় গো সুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাউকে ছাড়বে না ।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/ তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়?
লালন বলে জাত কারে কয়? /এ ভ্রম তো গেলা না । [লালন গীতি]
ফকির লালন আরও লিখেছেন-
সব লোকে কয় লালন জাত সংসারে?
লালন বলে জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নজরে ।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়/ তাইতে জাতের ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে ।
যদি সুন্নাত দিলে হয় মুসলমান/ নারীর তবে কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/ বামনী চিনি কিসে রে? ।
জগত বেড়ে জাতের কথা/ লোকে গৌরব করে যথা তথা
লালন সে জাতের ফাতা/ ঘুঁচিয়াছে সাধ বাজারে । [লালন গীতি]
লালন আর নজরুলের মধ্যে পার্থক্য এই যে, লালন কিছু প্রশ্ন করেছেন, মোলায়েম সুরে গান গেয়েছেন, আর নজরুল তুলেছেন ঝংকার। বাজিয়েছেন অগ্নিবীণা। সেই সাথে হিন্দু মুসলিম উভয় জাতির ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি নিয়েও বলেছেন অনেক কথা। কিন্তু কেমন করে পারলেন নজরুল? এ প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে আমাদেরকে যেতে হবে নজরুলের জীবনে। তিনি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা একজন মৌলভী ছিলেন। তিনি ছোট বেলায় মক্তবে পড়েছেন, কুরআন হাদীস অধ্যায়ন করেছেন প্রচুর। যার ফসল আমরা দেখতে পাই তার কুরআন শরীফের আমপারার অনুবাদে; রসুল (সাঃ) এর জীবনী ‘মরুভাষ্কর’ রচনায়। তিনি নিজে মুয়াজ্জিন ও ইমাম ছিলেন, ফলে তিনি পড়েছিলেন কুরআনের বানী ‘লাইকরাহা ফি দ্দিন’’ ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নেই (সূরা- বাকারা- ২৫৬)। তিনি পড়েছিলেন সূরা কাফিরুন- লাকুম দীনুকুম ওয়ালি ইয়াদিন- তোমার দীন(ধর্ম) তোমার কাছে, আর আমার কাছে আমার দীন। আবার হিন্দু পরিবারে বিয়ে করাতে বেদ-পুরাণ, গীতা, মহাভারত- রামায়নও পড়েছিলেন একদিকে যেমন, তেমনি- জেনেছিলেন হিন্দু ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার অনুষ্ঠান। এ বিষয়ে নজরুল গবেষক ড. সুশীল কুমার গুপ্তের কথা বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন- ‘‘যেখানে কীর্তন হত, কথাবার্তা হত, যাত্রাগান হত, দূরন্ত বালক সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন। বাউল, সুফী, দরবেশ, সাধু-সন্যাশীর সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন।’’ [নজরুল চরিত মানস]
তাই তো তাঁর পূর্বাপর ও সমকালীন কবিদের থেকে আলাদাভাবে তিনি লিখতে পেরেছিলেন-
মোরা একই বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মনি, হিন্দু তাহার প্রাণ ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান ।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া/ এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই/ একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই/ কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান ।
[‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকে সংযোজিত গান]
এমনিভাবে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গানে তিনি লিখেছেন
অসহায় জাতি জানে না সন্তরণ!
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার ।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার । [কাণ্ডারী হুঁশিয়ার- সর্বহারা]
কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হলেও হিন্দু-মুসলমান বিবাদমান উভয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেমন অভিমানের বৃষ্টি ঝরিয়েছেন, অসাম্য ও বৈসাম্যের বিরুদ্ধে অগ্নিবাণ বিদ্রোহও তেমন করেছেন। আবার একই সময়ে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য লিখেছেন দরদভরা কবিতা ও গান। বাংলা সাহিত্যে তো দূরে থাক, পৃথিবীর ইতিহাসেও কোন কবি সাহিত্যিককে- এমন ভূমিকায় দেখা যায় নি।
মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ইসলামী কবিতা, ইসলামী গান, হামদ্, না’আত, আবার একই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য লিখেছেন দেব-দেবী নিয়ে গান, কীর্তন-শ্যামাসঙ্গীত। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর স্মরনে তিনি লিখেছেন না’তে রসূল-
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে। [জুলফিকার]
ঠিক একই ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দেবী মা-কালী কে নিয়ে লিখেছেন-
আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে/ দেখে যা আলোর নাচন,
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব/ যার হাতে মরন বাঁচন,
আমার কালো মেয়ের আধার কোলে/ শিশুরবি শশী দোলে
মায়ের একটুখানি রূপের ঝলক/ ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগণ । [বনগীতি]
কবি আবার লিখেছেন-
মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে,
তাই কি রে তোর কণ্ঠেরই গান এমন মধুর লাগে।
এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য লিখলেন-
বল্ রে জবা বল্
কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ তল।
নজরুল রচনার বৃহদাংশ জুড়েই রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিক-দর্শন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’সহ অন্যান্য রচনাবলীতে জাতিগত বিভেদসহ সকল অন্যায় অবিচার, দূর্নীতি, দুঃশাসন, অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। সেই সাথে তাঁর টার্গেট-দর্শন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ছিল তাঁর আজন্মের লড়াই। ১৯২২ সালে তাঁর প্রকাশিত “অগ্নিবীণা” কাব্যগ্রন্থে সংকলিত “প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বর-ধারিণী মা, ধূমকেতু, কামাল পাশা, শাত-ইল আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী, মহররম” ইত্যাদিসহ মোট ১২টি কবিতার মধ্যে আমরা কবির সেই দৃষ্টিভঙ্গিই লক্ষ্য করি। অপরাপর রচনাগুলোতেও এই একই সুর যেন নজরুল সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য। কি কবিতায়, কি গানে, কি প্রবন্ধে সবখানে যেন নজরুলীয় সম্প্রীতির একই সে মূলসুর বেয়ে চলে সাহিত্যের গগণ তলে, এ রকম অকপট সাম্প্রদায়িকতাহীনতা অন্য কোন সাহিত্যিকের কলমে ধরা পড়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর সাহিত্য জীবনের দর্শনই হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে তাঁকে ‘জাতীয় কবি’র সংবর্ধনায় অভিনন্দন পত্রের জবাব দিতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-
‘‘কোন অনাসৃষ্টি করতে আসিনি আমি। আমি যেখানে ঘা দিয়েছি, যেখানে ঘা খাবার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল, পড় পড় বাড়িটাকে কর্পোরেশনের যে কর্মচারী এসে ভেঙ্গে দেয়, অন্যায় তার নয়, অন্যায় তার যে ঐ পড় পড় বাড়িটাকে পুষে রেখে আরও দশজনের প্রাণ নাশের ব্যবস্থা করে রাখে। আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়েনিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোন দিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরন তাদের তাড়া করে ফিরছে। আমি তাতে একটু আধটু সাহায্য করেছি মাত্র।---------------------------
যারা আমার নামে অভিযোগ করেন তাদের মত হলুম না বলে, তাদেরকে অনুরোধ- আকাশের পাখিকে বনের ফুলকে, গানের কবিকে তারা যেন সকলের করে দেখেন। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম, যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহন করি, সে আমার দৈব, আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি। বনের পাখি নীড়ের উর্ধ্বে উঠে গান করে বলে বন তাকে কোন দিন অনুযোগ করে না। কোকিলকে অকৃতজ্ঞ ভেবে কাক তাড়া করে বলে কোকিলের কাক হয়ে যাওয়াটাকে কেউই হয়ত মর্থন করবেন না। আমি যেটুকু দিতে পারি, সেটুকুই প্রসন্ন চিত্তে গ্রহন করুন। আম গাছকে চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে বেঁধে যতই ঠ্যাঙান, সে কিছুতেই প্রয়োজনের কাঁঠাল ফলাতে পারবে না, উল্টো এই ঠ্যাঙানী খেয়ে তার আম ফলাবার শাক্তিটাও যাবে লোপ পেয়ে। ---------------------------
কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি- ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যাণ্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁঠ ছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।”
সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন-
‘‘কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়- সমগ্র বাঙালী জাতির স্বপ্ন।’’
অনুষ্ঠানের সভাপতি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন-
‘‘ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইয়ে সেদিন পড়ছিলাম। তাতে লিখা দেখলাম- সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হয়েছিল। আমার বিশ্বাস- নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হবে।” তিনি আরও বলেন- “নজরুল কবি প্রতিভাবান মৌলিক কবি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন