শঙ্খ মিত্র
===========================================================================
#এক
হাট বসেছে রোববারে। না, পদ্মাপাড়ে নয়, স্টেশনের একধারে। করোনা পরিস্থিতিতে হাট কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে আর বিকেলে নয়, সকাল দশটার মধ্যেই হাট বসে যাবে, চলবে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এতে সারাদিনই অল্প অল্প জনসমাগম হবে, ফলে ভিড় তুলনামূলক কম হবে। প্রতি সপ্তাহের মত সজল এদিনও হাটে এসেছে। কদিনের টানা বৃষ্টিতে যত্রতত্র কাদা আর জল জমে আছে। সজলের তাড়া নেই। বাজারে ঢুকেই পুরো হাটটা একবার পরিক্রমা করে দেখে নেয় কোন্ দোকানে কেমন শাক সবজি মাছ উঠেছে। যদিও সে তার পরিচিত নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকান থেকেই সবকিছু কেনে। তবুও এক চক্কর ঘুরে দেখাটাই যেন নিয়ম। ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে উত্তরের এককোণে একটা কদম গাছের নিচে সজলের দৃষ্টি আটকে গেল। সচরাচর সে এ দিকটায় আসে না, আজ কী মনে করে এল। একটা চটের বস্তা বিছিয়ে তাতে দুটো কলার মোচা নিয়ে বসে আছে ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে। বেশভূষা যথেষ্ট মলিন। নজরে পড়ার মত কিছু নয়, তবু থমকে গিয়ে কৌতূহলবশে এগিয়ে গেল। পাশেই আর একটি ছোট বাচ্চা, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সজলের দিকে। মেয়েটির ভাই মনে হয়। সজল জিজ্ঞেস করল-
-কত দাম রে মোচার?
-আপনি যা দেবেন।
-তাই আবার হয় নাকি? এগুলো কে নিয়ে এসেছে, তুই না তোর বাবা?
-আমিই নিয়ে এসেছি।
-তুই প্রতি হাটেই এখানে আসিস?
-না, আজকেই প্রথম। বাবা টোটো চালায়, গাড়িতে ধাক্কা মেরেছে, তাই আজকে বেরোতে পারেনি। কাল রাত থেকে কেউ কিছু খায়নি। একটু চাল আর আলুর পয়সা হলেই হবে।
-কী নাম তোর?
-মুনিয়া।
একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে মোচা দুটো ব্যাগে ভ'রে নিল সজল। মুনিয়া ওর ভাইকে নিয়ে বস্তা গুটিয়ে স্টেশনের পেছনের বস্তির দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
#দুই
কদিন ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনের এই শারদ মরসুমেও বর্ষার এমন যৌবনরূপ বেশ কয়েক বছরেও দেখা যায়নি। পুকুরের জল উপচে প্রায় উঠানে চলে এসেছে, আমনের ক্ষেত প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। দিগন্তজুড়ে দৃষ্টির গোচরে শুধুই জল আর জল। আজকেও সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হওয়ার পর দুপুরের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। আকাশ এখন অনেকটাই পরিষ্কার, টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁকে সূর্যও উঁকি দিয়েছে। টানা তিনদিন জলবন্দী হয়ে থাকার পর বিকাল বেলায় সজলের আর ঘরে মন টিকছে না। ইচ্ছে করল একটু বেড়িয়ে আসতে। বৃষ্টির পর চারিদিকে জলের শোভা দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে। হাঁটতে হাঁটতে আনমনে স্টেশনের দিকটায় চলে এসেছে। ছোট ছোট ডোবাগুলোতে কয়েকটা ছেলে মিলে এরইমধ্যে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। মাঝে মাঝেই সজলের নিজের ছোটবেলার মাছ ধরার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ স্টেশনের পাশে বস্তির দিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচিতে সজলের প্রকৃতি-তন্ময়তা কেটে গেল। কৌতূহলে এক-পা দু-পা করে সোজা ঢুকে পড়ল বস্তির ভেতরে। ঢোকার মুখেই একটা দিশি মদের আখড়া আছে। গণ্ডগোলের উৎস সেখানেই।
#তিন
সেদিন হাট থেকে বাড়ি ফিরে মুনিয়া জানতে পারে ওর বাবা আবার ওই মদের ঠেকে গিয়ে আকন্ঠ পান করে এসেছে। এখন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। মুনিয়ার মা শহরে ঠিকে ঝি-এর কাজ করে। সেদিনও তাই গেছে। মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাতে টাকা আসবে না। সামান্য ওই কটা টাকা দিয়েই ওদের টানাটানির সংসার। ঘরে একমুঠো চাল নেই। ছোট ভাই খিদেয় কাঁদছে। বাবা আগের দিন মদ খেয়ে টোটো চালাতে গিয়ে মেইন রোডে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেওয়ায় রাস্তার ধারে খালে পড়ে গেছে। সেই থেকে বাড়িতে। যে মালিকের টোটো চালাত সে তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত করেছে। এই অবস্থায় মুনিয়া নিজেই বাড়ির কলাগাছের দুটো মোচা নিয়ে হাটে গিয়ে বসেছিল। অল্প চাল ডাল আলু কিনে নিয়ে এসে দেখে বাবা যথারীতি বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। রোজকার এই দৃশ্য দেখে বিরক্ত মুনিয়া তখনই একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
#চার
একটু দূরেই একটা হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে মুনিয়া। বস্তিতে বড় হলেও এখানকার নোংরা পরিবেশ ওকে ছুঁতে পারেনি। এই বয়সেই সে যথেষ্ট পরিণত, জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও নিজস্ব মতামত আছে। মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ যথেষ্ট প্রখর এই মেয়ের। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বস্তির মদের আড্ডা যে করেই হোক ধ্বংস করতে হবে। আজ বৃষ্টি কমলে মুনিয়া ওরই বয়সী আরো কয়েকটি মেয়ে-বউকে নিয়ে চড়াও হয় মদের ঠেকে। অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরা আর মত্ত পুরুষেরা বস্তির মেয়েদের এই আগ্রাসী রূপ দেখে হঠাৎ ঘাবড়ে যায়। লাঠি বাশঁ নিয়ে তারা তছনছ করতে থাকে সবকিছু। মনে মনে এতদিন সবাই যেটা চাইছিল কিন্তু প্রকাশ্যে বলার সাহস পাচ্ছিল না, মুনিয়া আজ সেটাই করে দেখাচ্ছে। পুলিশ এলে মুনিয়া নিজেই সবার সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। মুনিয়া আর তার প্রমীলা বাহিনীর উদ্যোগে সেইদিন থেকে একেবারেই
বন্ধ হয়ে গেল মদের আখড়া। এক ষোড়শী তন্বী যেন দশভুজার মত বস্তিবাসীর দুর্গতিনাশে অবতীর্ণ হয়ে এসেছে। এরপর থেকে মুনিয়াকে ছেলে-বুড়ো সকলেই সমীহ করতে শুরু করে।
#পাঁচ
শরতের বাতাসে এখন কাশ আর শিউলির গন্ধ। চারিদিকে চলছে পুজোর প্রস্তুতি। প্রতি সপ্তাহের মত সজল আজকেও হাটে এসেছে। একটা নির্মীয়মান পূজা প্যান্ডেলের কাঠামো দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানে এর আগে কোনোদিন পূজা হয়নি। এগিয়ে গিয়ে জানতে পারল, বস্তির লোকজন এবারে পূজা করছে। যার মূল উদ্যোক্তা মুনিয়া আর তার দুর্গাবাহিনী। ওরা চাঁদা তুলতে শুরু করে দিয়েছে, রসিদের সাথে একটা করে লিফলেটও বিলি করা হচ্ছে। যেখানে মদ ও মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছে, যার বয়ান লিখেছে মুনিয়া নিজে। পুজো এখনো শুরু হয়নি, কিন্তু প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে সজল যেন স্পষ্টই দেখতে পেল দুর্গা প্রতিমার রূপ, যে কিনা কয়েকদিন আগেই মত্ত-মাতালরূপী মহিষাসুরদের বধ করেছে। আর এখনও দশভুজা দিয়ে সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সজলের চোখ সজল হয়ে উঠল, মনে মনে সে সেই দেবীকে প্রণাম করে প্রশান্ত চিত্তে বাড়ি ফিরে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন