অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.
শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০
মাতৃত্ব
মৌমিতা চক্রবর্তী
========================================================================================
ফুলঝুড়ি পিসিমার বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে এসে শরীরটা যেন আর নড়তে চড়তে চাইছে না। ওই, বেশি খেলে যা হয় আর কী! এতো এতো পছন্দের পদ, বারণ করা যায়? আমাদের সম্পর্কের দড়িতে রক্তের মাখন মাখানো নেই। ওনার নিচতলায় তিন বছরের ভাড়াটে। ভাড়াটে হিসেবে হায়েস্ট স্কোর এখনও আমাদের দখলেই আছে।
পিসেমশাইকে ছবিতে দেখেছি। পিসির মাথার পেছনের দেয়ালে প্লাস্টিক রজনীগন্ধার মালা ঝোলানো। টগর ফুলের মতো ধবধবে শার্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ক্লাসিক কাট চুল, বাঁদিকে সিঁথি কাটা। সম্ভবত পাসপোর্ট সাইজের ছবিকে বড়ো করা হয়েছে। সুন্দর বাড়ি তবে পুরোনো মডেলের। ওপরে পিসি একাই থাকেন। যদিও ছেলেরা অনেকবার মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু পিসি যেতে চাননি। পটরপটর ইংরেজি বলা দেশে গিয়ে টপ টু বটম ভারতীয় ফুলঝুড়ি কী করবেন? ঠিক ঠিক। পিসিমার জন্য দোতলার তিনটে রুম, কিচেন, পাশে ডাইনিং, প্রবেশ মুখে সিংহাসনে পদ্মাসনে বিরাজমান গুরুদেব। নিচতলায় ভাড়াটে আত্মীয়। শুভ্রকেশ-দাঁড়ি, কপালে শ্বেত চন্দন টিপ, হাসি হাসি মুখের গুরুদেবের ছবিটা নিশ্চয়ই শীতে তোলা হয়েছিল। সাদা শালের ভেতর থেকে ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা দৃশ্যমান। ঘরগুলোর একদম পেছনটায় প্রাকৃতিক কার্য সম্পন্ন করার স্থান। ইচ্ছে ছিল একটা ব্যালকনির। হবো-হচ্ছি করেও হলো না। ছাদে বাগানের কাজ করতে আসে মালী কাকু। ঘরের কাজে সাহায্য করে বিন্তি। স্টেশনের পাশে বস্তিতে থাকে। কাজ করা মুখ্য নয়। দুজনের ক্ষেত্রেই। রেশনের পঁচিশ কেজি চালে অমূল্যকাকুর ঠ্যালাগাড়ি সংসারের অচলাবস্থা। ছেঁড়া শাড়ি কাকির লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না বলে লজ্জায় জীর্ণ সিলিংয়ে আত্মগোপন করে আছে লাজ। বিন্তির বর সাধুর দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রেমে হাবুডুবু অবস্থা। ওরা বলে কম, শোনে বেশি। পিসিমা ই ওদের দুঃখ ঘাটেন। দাওয়াই ও দেন। দীনতার পারিশ্রমিকও জোটে। পাড়ায় ভিন্ন জনে পিসিমার বিভিন্ন নামকরণ করেছে। বকবকি, পটরপটর, বতরি, টকেটিভ আরও আছে। বাপী বলতো- 'কথার ফুলঝুড়ি এসেছেন।'
হ্যাঁ, ওই একটাই কারণ- সময়গময় বিচার-বিবেচনা না করে চলে আসেন নিচের তলায় নবান্তুকের ঘরে। অফিস যাওয়ার প্রাক্ ব্যস্ততম মুহূর্ত, অফিস যাওয়া এবং ফিরে এসে পিসিমার রসহীন পিগমেন্ট ভরা মুখ দর্শন, ভালো থেকে বিরক্তিকর বাড়িওয়ালির তকমা জোটে চার আঙুল কপালে।
ভাতঘুমের রসাস্বাদনে আবেশিত স্ত্রী লিঙ্গের তনু, বন্ধ দরজায় খট্ খট্ খট্। এলেন বাড়িওয়ালি। উফ্! খেয়েদেয়ে কোনও কাজ নেই মহিলার। বয়স চুরি করেছে ঘুম। শুরু হবে শাশুড়ির জমিদার বাপের বাড়ির আদি গল্প, শ্বশুরের বীর পদক প্রাপ্তির গর্বিত অধ্যায়, স্বামীর নাক ডাকার স্মৃতি, ছেলেদের লেখাপড়ায় একাগ্রতা, বৌমাদের সৌন্দর্যের গোপন রহস্য, পাড়ার সমবয়সী নারীশক্তির মহিমা, এলাকার বিখ্যাতদের শ্রেষ্ঠত্বের গুণকীর্তন, উপসংহারে অমূল্য, বিন্তি। সোম থেকে শনি- চিত্র অপরিবর্তনীয়। রোববার সন্ধের পর বাড়ি ফিরলে পিসিমা বলেন, 'কোথায় গিয়েছিল গো?' শাড়ি ভাঁজ করতে করতে মা বলছিল- 'বাপের বাড়ি। আগে ছুটিবার মানেই ঘোরা আর বাইরে খাওয়া। এখন ছেলেটা ছোটো বলে সম্ভব হয় না।' পিসিমার শ্যামলা মুখে শ্রাবণের মেঘ বাসা বাঁধছে। একাকীত্ব জড়ানো গলায় বললেন- 'বাড়িটা কেমন গিলতে আসছিল। এভাবে একা একা থাকা যায়, বলো? পাড়ায় দু'এক বাড়িতে গিয়েছিলাম, বড্ডো যান্ত্রিক! কথা বলতে কি কোনও ট্যাক্স দিতে হবে সরকারকে! যত্তসব!'
কয়েকমাস, বড়ো জোর বছর পেরোলেই ভাড়াটেরা নতুন আস্তানা খোঁজে। ঝগড়া-বিবাদ, জলের সমস্যা, গেট খোলা-বন্ধ করা, ইলেকট্রিক বিল নিয়ে বাড়িওয়ালি-ভাড়াটিয়ায় দড়ি টানাটানি, এসবের কোনও সিন্ আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই তালিকায়। তবুও প্রাইভেসি ভঙ্গ করার দায়ে পিসিমাকে একলা যাপনের সাজা ভোগ করতে হয়। পিসিমার গায়ে কেমন যেন একটা মা মা গন্ধ। কাছে এলে বড্ডো সুখ সুখ অনুভব হয়।
বিদায়ী ভাড়াটেদের নেমন্তন্ন করতে পক্ষপাতিত্ব করেননি ফুলঝুড়ি। উপস্থিত মোটামুটি পঞ্চাশ। অনুপস্থিত পরিবারের পুরুষরা। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ। ব্যস্ত অফিস, ব্যবসা, সেনসেক্স, অর্থনীতি। সবাই জানতে চাইছিল- 'মাসিমা উপলক্ষ্য কী জানতে পারলাম না তো?'
বয়স তার গরিমা প্রকাশ করছে পিসিমার হাতের লাঠিতে। অবলম্বনে ভর করে উঠে দাঁড়ালেন সোফা থেকে। বসার ঘরে জায়গা অনেক। পাশে আরেকটা ঘর। ফাঁকা। দক্ষিণের হাওয়া খেলে বেড়ায় ওখানে। দুটোকে আলাদা করেছে সুবৃহত অর্ধবৃত্তাকার পথ। নিচে ভাড়াটেদের ঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সবার কৌতূহলী বাতাস এসে গায়ে লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ঘরগুলোতে এখনও আমার শৈশব মাদাগাস্কারের শুকনো পাতাঝরা বৃক্ষের জঙ্গলে প্রাপ্ত গুলমোহর ফোটায়।
আঁচলে বাধা চাবিটা দিয়ে তালা খুললেন পিসিমা। বললেন- 'এসো, নির্ভয়ে এসো। তবে, এক এক করে। ওরা সভ্য। ভালোবাসা বোঝে। আঘাত করবে না।'
কাদের কথা বলছেন পিসিমা? আমরা চিনি ওদের? ভয় পাবো কেন? কেন আঘাত করবে?
ভেতরে ঢুকে এক এক করে বেরিয়ে আসছিল স্থির দৃষ্টি। ষোলোয় আমার পালা। প্রাণ ভরে দেখলাম আর বদ্ধ বিশ্বাস নিয়ে বেরোলাম- এক রাস্তা বন্ধ ভ্যে গেলে গাড়ি দুসর স্যে যেতে, রুখতে ন্যেই, ন্যেই রুখতে।
পিসিমার আটটি কুকুরের একজন মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে। বারো সন্তানের গর্বিত জননী। আত্মার আনন্দে আনন্দিত বৃদ্ধা। জমিয়ে সেলিব্রেট করেছেন নতুন অতিথিদের শুভাগমন। সাথে আমরাও। অজান্তেই।
আর একাকীত্বের তীব্র দহন জ্বালা ভোগ করতে হবে না পিসিমাকে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন