রবীন বসু
===========================================================================
ক্যাঁ...চ্…চ্….ও ও ও ও….
জোরে ব্রেক কশার শব্দে সচকিত হল পরমা l অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বড়রাস্তার মোড়ে একটা ট্যাক্সির জন্য l একটার মধ্যে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে, দুটো পাঁচে কলকাতা-ভুবনেশ্বর ফ্লাইট l বস মিঃ দত্ত পম্ পৌঁছে গেছেন l অনেক টাকার একটা নতুন অর্ডারের ব্যাপারে পার্টিকে প্রেজেনটেশন দিতে হবে l স্যার ওকেই সিলেক্ট করেছে সঙ্গে যাবার জন্য l
কিন্তু এই দুপুর বারোটায় কলকাতায় ট্যাক্সি পাওয়া আর লটারি পাওয়া একই ব্যাপার l এরই মধ্যে ওই বিকট শব্দ করে একটা টাটাসুমো দাঁড়িয়ে পড়ল l সবাই গেল গেল করে দৌড়ে এল, এক বয়স্ক ভদ্রলোক রাস্তা পেরোচ্ছিলেন টাটাসুমো তাঁকে ধাক্কা দিয়েছে l পরমা দৌড়ে গেল গাড়িটার সামনে l ভদ্রলোক পড়ে আছেন, মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে l সবাই দেখছে কিন্তু কি করবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না l কিছু লোক গাড়িটার ড্রাইভারকে নামিয়ে মারধোর করতে লাগল l ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ বলে উঠল, অ্যাক্সিডেন্ট কেস পুলিশে খবর দিতে হবে l
পরমা দেখল ভদ্রলোক বেশি রক্তক্ষরণে কেমন নেতিয়ে পড়ছেন l এভাবে আর কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে খারাপ একটা কিছু হয়ে যাবে l তাই আর দেরি না করে রাস্তায় বসে পড়ে ভদ্রলোকের মাথাটা কোলে তু্লে নেয়। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ওঁনার মুখে একটু জল দেয় l তারপর নিজের ওড়না দিয়ে ভদ্রলোকের জখম মাথা বেঁধে নেয় l
— প্লিজ, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, এখুনি কোন নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে l আছে কাছাকাছি কোন নার্সিংহোম? জানেন কেউ? পরমার গলায় আকুলতা আর উদ্বেগ ঝরে পড়ে l
ভিড়ের মধ্যে থেকে এক অটোওলা এগিয়ে এল l
— না দিদি, নার্সিংহোম না, পুলিশ কেস, তাই এনাকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে l পরে থানাকে জানাতে হবে l গাড়িটার নম্বর নিয়ে নিয়েছি, এখন চলুন আমার অটোতে কাছাকাছি একটা সরকারী হাসপাতাল আছে l
আরও দু’চারজনের সাহায্যে আহত ভদ্রলোককে অটোতে তুলে পরমা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল l
ভদ্রলোক ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন l ওঁনার রক্তমাখা আহত জ্ঞানহীন মুখের দিকে তাকিয়ে পরমার নিজের বাবার কথা মনে পড়ল। গত বছর অফিসে কাজ করতে করতে হঠাৎ স্ট্রোক। বিনা নোটিশে চলে গেলেন l
হাসপাতালে নিজেকে রিলেটিভ পরিচয় দিয়ে ফর্ম ফিলআপ করল পরমা l ডাক্তারবাবুরা ভয় নেই বলে পেশেন্টকে আই সি ইউতে ঢুকিয়ে নিল l
অটোওলা ছেলেটির খুব উপস্থিত বুদ্ধি l একটা ব্যাঙ্কের পাশবই তার হাতে দিয়ে বলল, দিদি, ওঁনার পকেটে ছিল, বোধহয় ব্যাঙ্কে এসেছিলেন পেনশন তুলতে l এখানে ওঁনার বাড়ির ফোন নম্বর আছে, খবর দিন l কাউকে আসতে বলুন l একটু পরে তো পুলিশ আসবে খোঁজ- খবর করতে l
ভদ্রলোকের বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে পরমা দেখে, অফিস বস মিঃ দত্তের মিসড কল গোটা চারেক l এতক্ষণে তার খেয়াল হয়, কোথায় তার যাবার কথা ছিল l প্লেন ছাড়তে আর মাত্র পঁচিশ মিনিট। স্যারকে ফোন করে l
—হ্যালো, স্যার—
—কি ব্যাপার পরমা, তুমি এখন কোথায়? তোমার কি কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই? তুমি এলে না কেন?
—আসলে স্যার, আমি এখন একটা সরকারী হাসপাতালে। পথদুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে…
পরমার কথা শেষ হবার আগেই ও-প্রান্ত থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে এল, তুমি জনসেবা করছ? এদিকে অত টাকার অর্ডার আমার হাতছাড়া হবে ! জানো, তোমার এই কর্তব্যে গাফিলতির জন্য আমরা তোমাকে চাকরি থেকে স্যাক করতে পারি?
—তা তো পারেন স্যার l কিন্তু কি জানেন, আমার কাছে নিজের চাকরির থেকে এই মুহূর্তে ওই মুমূর্ষু মানুষটার প্রাণ বাঁচানো বেশি প্রয়োজন l এঁনার জীবন দান আমার কাছে এই মুহুর্তে একমাত্র কাম্য।
ফোন কেটে দিয়ে পরমা এবার জোরে একটা শ্বাস নেয় l তাকে এখন দুটো ফোন করতে হবে l একটা ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে আর অন্যটি মাকে l
আন্তরিক ধন্যবাদ "অন্যমনে সাহিত্য"
উত্তরমুছুন