অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০

দুর্গা



 

লক্ষ্মী নন্দী
===================================================================================


দুর্গাকে নিতে এসেছে তার বাবা। তবে দুর্গার বাবা এখানে গিরিরাজ হিমালয় নয়, দিন মজুর অনন্ত। দেবব্রত বোসের বাড়িতে তিন মাস হল আছে দুর্গা। অসহায় দরিদ্র ঘরের দুর্গার চাল, চলন,আচার, ব্যবহার, সংবেদনশীল, ধীময়ী নিখুঁত রূপসী প্রতিমা যেন। এতদিন পর মেয়েকে দেখে স্নেহরসে বিগলিত অনন্ত জিজ্ঞেস করে, কেমন আছিস মা? দুর্গার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসুস্থ শয্যাশায়ী মায়ের মুখ। তবুও বলে না, মা কেমন আছে? আমার তোমাদের ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয় বাবা। অভিমানী দুর্গা বোঝে না তার বাবা মাও তাকে ছেড়ে কতটা ক্ষত বিক্ষত অসহায়। কিন্তু এই বিকশিত কুসুম যে বস্তিতে নিরাপদ নয়। ইতিমধ্য নিঃশব্দে ঘরে গিয়ে দুর্গা, একটা ব্যাগে ওর প্রায় সব কিছু নিয়ে বেরিয়ে আসে। অনন্ত বিস্মিত হয়ে বলে,কি নিয়েছিস এত কিছু ! দু-দিন পরেই তো চলে আসবি। ঠিক সেই সময় দেবব্রতর স্ত্রী মেনকা উদাস ভাবে বলে, অনন্ত তুমি ওকে নিয়ে যাও, আর নিয়ে এসো না। এক মহাপ্রলয় এসে অনন্তকে ঘূর্ণিপাকে ফেলে দেয়। তীব্র উৎকণ্ঠায় অনন্ত দুর্গাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে তুই কি করেছিস? জড় কঠিন শিলার মত স্তব্ধ পলকহীন চোখে দাঁড়িয়ে থাকে দুর্গা। উথাল পাথাল বিধ্বস্ত হলেও বাকরুদ্ধ অনন্ত পিতৃ হৃদয়ের বেদনার্ত অনুভূতিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। হঠাৎ অজানা ঝড়ের মগ্নতা ভেঙে দিয়ে দুর্গা বলে, বাবা আমি কখন মার কাছে যাব? এমন সময় একটা জলপাইরঙের গাড়ি এসে থামে দেবব্রত বোসের বাড়ির সামনে। গাড়ির থেকে নেমে বাড়িতে দৌড়ে ঢোকে মা-মা, বাপি - বাপি ডাকতে ডাকতে দুর্গার বয়সী এক মেয়ে। অবাক হয় দুর্গা, অবাক হয় অনন্ত। ঘরের ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে মেনকা। আত্মহারা হয়ে নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে , হাসি কান্না মিশিয়ে নানান প্রশ্ন করতে থাকে। কেমন করে ছিলি, কোথায় ছিলি আমাদের ছেড়ে এতদিন। পুলিশ দেবব্রতর হাত ধরে বলে আপনাদের এই দীর্ঘ চার মাসের সহযোগিতার জন্যই আপনার মেয়েকে উদ্ধার করা সম্ভব হল। যাই হোক আমরা পরে একদিন আসবো। কোনো ভয় নেই আর। দেবব্রতের বাড়িতে মুহূর্তেই নেমে আসে আনন্দের জোয়ার। একমাত্র মেয়ে হারিয়ে যাওয়া নন্দিনীকে ফিরে পেয়ে আবার চেতনা সহিষ্ণু মেনকা অপূর্ব প্রকাশিত হয়ে ওঠে। পরম স্নেহে দুর্গার সুন্দর চোখ দুটির মধ্যে অনুধাবন করে না বলা এক নিদারুণ কিশোরী অভিমান। কাছে ডাকে দুর্গাকে, বলে, দুর্গা তুই বড় লক্ষ্মীরে। আমার কাছে থাকবি? যেন একটা অলিখিত দৃশ্য আবার অনন্তর বুকে নতুন করে জন্ম নেয় প্রত্যাশার। কিন্তু আত্মসচেতনী দুর্গা বলে, না অামি মার কাছে যাবো। দুর্গা যে দেবব্রতের অনেকটা মন জুড়ে আছে সেটা বুঝতে পারে দেবব্রত। দুর্গা চলে যাচ্ছে ভেবে নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। শান্তির আনন্দলোকে দাঁড়িয়েও দেবব্রতের বাড়ির পরিবেশটা কেমন ভার হয়ে ওঠে। অনন্তকে কাছে ডাকে দেবব্রত। বেশ কিছু টাকা দেয় স্ত্রীর ভাল চিকিৎসার জন্য। অার ড্রাইভারকে বলে, তুমি ওদের সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।বড় শহরের আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং দেখতে দেখতে দুর্গা মায়ের জন্য অনেক অনুভূতি খনন করে নিয়ে চলে একান্ত নিজের মনভুমিতে। শহর পার হতেই বস্তির ছোট ছোট ঘরগুলি হাতছানি দেয় দুর্গাকে। এক সময় নিজেদের মাটির দেওয়াল দেওয়া বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। দুর্গা প্রশ্ন করে বাবা আমাদের উঠানে এতো ভিড় কেন? অনন্তর বুকটা দুমড়ানো - মুচড়ানো কাগজের মত হয়ে যায়। ভিড়ের মধ্য থেকে অনেকে অনেক কিছু বলতে এগিয়ে আসে। অশান্ত অনন্ত দুর্গার হাত ধরে ভির ঠেলে ঘরে ঢুকে থরথর করে কাঁপতে থাকে। দুর্গা বাবার হাত ছাড়িয়ে কলের পুতুলের মত এগিয়ে গিয়ে মার বুকে মাথা রেখে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মায়ের শরীর। তবুও চোখ খোলেনা দুর্গার মা, দুর্গাকে কাছে টেনে নিয়ে আদরও করেনা। হারিয়ে যায় দুর্গার মায়ের জন্য আনা সব শহুরে আনন্দ। চরম বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে কৈশোরের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে দুর্গা। মায়ের কানে ফিসফিস করে বলে আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা মা, তোমাকে ছেড়ে আর থাকবনা। দুর্গাকে মায়ের বুকের থেকে ছিনিয়ে নেয় প্রতিবেশীরা। দুর্গা চিৎকার করে বলে বাবা, আমি মার কাছে যাব।

1 টি মন্তব্য:

  1. আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়।

    উত্তরমুছুন