কথিকা বসু
====================================================================================
আর কয়েক দিন পরেই, শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা আর শিউলিকে সাক্ষী রেখে, উমা ফিরবেন বাপের ঘরে। আপামর মানুষের, একটা গোটা বছরের অপেক্ষার শেষে, শুরু হবে দেবীপক্ষ। আরো একবার মা, মেয়ে হয়ে ফিরবে, তার মায়ের কাছে, তার শিকড়ের কাছে। কাশবন পেরিয়ে, একটু একটু করে আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে চরাচর জুড়ে ঢাকের তালে তালে, সবার মনে।
কিন্তু সবার মনেই কি?
যে মায়ের, একমাত্র মেয়েকে, কিছুদিন আগে, তার শশুরবাড়িতে, পণ দিতে না পারার জন্য পুড়িয়ে মারা হয়েছে, অন্য আর এক মেয়ের, ঘরে ফেরার আনন্দ, কি তাকে আর ছুঁতে পারবে?
যে মেয়েটা বাধ্য হয়ে, রোজ রাতে শরীর বেচে বৃদ্ধ মা বাবার মুখে অন্ন তুলে দেয়, তার চোখে কি মা সত্যিই বলপ্রদায়নি?
যে মেয়েটার স্বামী সুন্দরবনের খালে, মীন ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছে, শরীরটা অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার কি আর মার কাছে গিয়ে সিঁদুর খেলতে পারার, আর্শীবাদ চাইতে ইচ্ছে করবে?
যে প্রেমিকা আগের বছরও মায়ের কাছে মানত করেছে, বিয়ে হলে জোড়ায় পুজো দিতে আসবে, আলাদা হয়ে, তার প্রেমিক অ্যাসিডে তার মুখ ঝলসে দিলে, আর কি তার মায়ের করা ম্যাজিকের উপর বিশ্বাস থাকবে?
শাস্ত্রে নিয়ম থাকলেও, যে মেয়েটা তার মায়ের উদ্দেশ্যে, তর্পণ করতে চেয়েও পারেনি, শুধু সমাজ কি বলবে, সেই ভেবে, সে কি আর কোন নারীশক্তির পুজোয় বিশ্বাস করবে?
যে মেয়েটা, রোজ রাতে, তার মদ্যপ স্বামীর হাতে ধর্ষিত হয়, সে কি আর কখনও মায়ের অসুরদলনী রূপে বিশ্বাস রাখতে পারে?
পারে না।
থাকে না।
করে না।
কিন্তু, আমি বিশ্বাস করি, মানুষ চাইলে সব পারে।
তাই এই পুজোয়, ঐ মেয়েহারা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে, ঐ মেয়েটার জন্য বিচার আমাদেরই চাইতে হবে এবং দেখতে হবে যাতে আর কোন মা, এভাবে কোনদিন তার মেয়েকে না হারান।
অন্য পেশার মতো যৌনপেশাকেও স্বীকৃতি দেবার ব্যবস্থাও আমাদের করতে হবে। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিও, যাদের বাড়ির মাটি ছাড়া তৈরি হয় না, তাদেরকে ব্রাত্য করে রাখার এই সমাজ কে?
বিধবা শব্দটাই মুছে দিতে হবে আমাদের, মেয়েদের জীবন থেকে। সিঁদুরে তৈরি করতে হবে, সবার সমান অধিকার।
বিশ্বাসঘাতকদের জন্য থেমে না গিয়ে, জীবনে আরো এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে হবে ঝলসানো চামড়ার মেয়েটাকে। তার চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া না করে, তাকে সাহস যোগাতে হবে যাতে সে তৈরি করতে পারে সৌন্দর্যের, ব্যক্তিত্বের আর সাফল্যের নতুন সংঙ্গা।
সমাজকে প্রশ্ন করতে হবে, সব কিছুতে নারী পুরুষের সমানাধিকার থাকলে, তর্পণে নয় কেন?
আর অসুররূপী স্বামীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠে, রাস্তায় বেরিয়ে আসবে যে মেয়েটা, তার পাশে দাঁড়িয়ে, তাকে ভালো থাকাও শেখাতে হবে আমাদেরই ।
শুধু মৃন্ময়ী মূর্তিপূজোই নয়, তার সাথে সাথে চিন্ময়ীদেরও পাশে দাঁড়াতে হবে এভাবেই। তবেই সার্থক হবে উমার বাড়ি ফেরা, তবেই সার্থক হবে মায়ের পুজো, তবেই সার্থক হবে এই দেবীপক্ষ।
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়।
উত্তরমুছুন