সুতপা দাস
=======================================================================================
কাশফুলে ভরে ওঠা মাঠ, আকাশে পেঁজা তুলোর মত ভেসে বেড়ানো মেঘ, ভোরের বেলার কুয়াশা, বাতাসে শিরশিরে অনুভূতি, রাতের আকাশ থেকে শিশিরের নেমে আসে আর ভোরের নরম রোদ মেখে ঝরে পড়া..... এই.... এইসব ই জানান দেয় আগমনীর আগমনের।
দেখতে দেখতে কেটে যায় সময়, চলে আসে পুজো। প্রবাসীরা দেশে ফেরে শেকড়ের টানে, ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকরা ফেরে ঘরে, শহরে থাকা শ্রমিক ফেরে গ্রামে।
এইরকম ই একজন হল শিবু। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। দুর্গা চতুর্থী হয়ে গেছে তবু গ্রামে ফেরার জন্য খুব একটা অস্থিরতা নেই ওর। আসলে পুজো আসলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। এইরকম ই এক পুজোর সময় হারিয়ে গেছিল ওর বন্ধু তথা ভালোলাগা_মিলি। গায়ের রংটা একটু শ্যামলা হলেও মিলি বেশ সুন্দরী ছিল। সহজ-সরল ডাগর চোখের মিলিকে ভালোবাসতো শিবু, তবে মনে মনে। সেই যে সেবার বাবার সঙ্গে শহরে গেল আর এলোনা।
শিবুর মতো ই আরো কিছু শ্রমিক এখনো রয়ে গেছে শহরে। কাজ বন্ধ হয়ে গেছে তবু ঘরে ফেরেনি তারা। সকলে মিলে ঠিক করেছে এবারে দুটো দিন শহরের প্রতীমা দেখে তারপর ফিরে যাবে যে যার গাঁয়ে।
কিছু একটা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছিল নির্মীয়মান ফ্লাইওভার এর অদূরবর্তী ত্রিপল দিয়ে তৈরি দশ বাই আটের অস্থায়ী তাঁবুতে। শিবু আসতেই কেমন যেন সব চুপ হয়ে গেল সব এ ওর দিকে চোখের ইশারা করে। শিবু এটুকু শুধু বুঝল যে তাকে বন্ধুরা কোথায় যেন একটা নিয়ে যেতে চায়।
শহরের পুজো প্যান্ডেল, রাস্তা-ঘাট বহুবর্ণের আলোকমালায় যেমন সেজে উঠেছে তেমনি শহরের কুখ্যাত আধো-অন্ধকার গলিও সেজে উঠেছে আলোয়। তবে এ আলো ম্লান,মোহ ধরানো আলো। এ পাড়ার বাসিন্দা মেয়েরা এখন খুব ব্যস্ত। পুজোর এ কটা দিন তাদের কাছে পিক সিজন। এ কদিনেই অনেক রোজগার করে নিতে হবে তাদের। কেননা এ সময়ে শহরে প্রচুর লোক আসে অদূরবর্তী বিভিন্ন জায়গা থেকে ঠাকুর দেখতে। প্রতীমা দর্শনের ফাঁকে এখানকার দেবীদের ও দর্শন করে যায়।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে বের হয়ে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শিবুর এসে পড়ে এই অন্ধকারের গলিতে। তাকে গছিয়ে দেওয়া হয় ঝুমুর রানীর হাতে। উগ্র গন্ধে ভরা ছোট্ট ঘুপচি ঘরে ঢুকে ঝুমুর কে দেখে চমকে উঠে শিবু। ঝুমুর ও কম অবাক হয়নি। স্বাভাবিক হতেই কেটে যায় বেশ কিছু সময়। প্রথম কথা বলে ওঠে শিবু_'মিলি তুই ! তুই তো....' শেষ করতে পারে না কথাটা, আবেগে বুঁজে আসে গলা। ঝুমুর ধপ করে বসে পরে মেঝেতে, কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয় ও। তারপর শিবুর কাতর অনুরোধে সে বলতে শুরু করে তার মিলি থেকে ঝুমুর হয়ে ওঠার কাহিনী।
বছর পাঁচেক আগে ফুচকা বিক্রেতা বাবার কাজে সাহায্য করতে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল মিলি পুজোর সময়। এই সময়েই কিছু বাড়তি রোজগার হয় তাদের। নবমীর দিন হঠাৎ করে মিলির জ্বর আসে। সন্ধের দিকে জ্বর না থাকলেও দুর্বলতার জন্য বড় রাস্তার পাশের পুজো প্যান্ডেলের মাঠে বাবার দোকানে যায়নি আর। সস্তায় ভাঁড়া নেওয়া বস্তির ঘরেই ছিল সে। তেলের কুপি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেশ রাত্রে কখন কে জানে শিউরে উঠে ঘুম ভাঙ্গে মিলির । তেল শেষ হয়ে কুপি নিভে গেছে তাই ঘরটাও অন্ধকার। অন্ধকারে অচেনা লোকের স্পর্শে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে মিলি। কিন্তু চারিদিকে বাজতে থাকা মাইকের আওয়াজে চাপা পড়ে যায় সে চিৎকার। ধর্ষিতা হয় মিলি। সকালে ঝুপড়িতে ফিরে রক্তাক্ত অগোছালো মিলিকে দেখে যা বোঝার বুঝে যায় মিলির বাবা। লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কোন কিছু জানাতে নিষেধ করে। সেদিন বাবা আর কাজে যায় না , মুখ গুম করে বসে থাকে। বিকেলে সব বাঁধাছাদার কাজে লেগে যায়, পরদিন বাড়ি ফিরবে বলে। পরদিন সকালে মিলিকে দোকানে বিড়ি কিনতে পাঠিয়ে সেই সুযোগে মিলির বাবা শহর ছাড়ে মিলিকে একা ফেলে রেখে। ফিরে এসে ফাঁকা ঘর দেখে মিলি বুঝে যায় তাকে ত্যাগ করেছে বাবা। প্রথমে চিৎকার করে কাঁদলেও একসময় দমন করে নিজেকে। বুঝতে পারে একজন মেয়ে হওয়ায় অন্যের করা অন্যায়ের দায়ভার তার, পরিবারের মিথ্যা সম্মান রক্ষার জন্য তাকে যেভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে সেটার দায়ভার ও তার, ছোট দুই বোনের ভবিষ্যৎ ঠিক রাখার দ্বায়িত্ব ও তার ! আর নিজের নারীত্বাভিমান ? মূল্যহীন ..... নিতান্তই মূল্যহীন । বাবার ওকে ছেড়ে পালানোর পর , জীবনটা স্রেফ্ নরক হয়ে ওঠে মিলির। বস্তিঘরের মালিক কাকুর লোভের শিকার হয় ও দ্বিতীয়বারের মতো। পরে বহু হাত ঘুরে বিক্রি হয়ে যায় পতিতালয় এর এই অন্ধকারে। মিলি হারিয়ে যায় চিরতরে, বোধন হয় এই ঝুমুর রানীর।
পুনশ্চ: কপাল ফেরে মিলি ঝুমুর হয়ে উঠলেও ঝুমুর এর মধ্যে জেগে উঠেছে আজ অন্য রকম নারীসত্তা । তাই আজ সে তার উপার্জন এর বেশিরভাগটাই তুলে দেয় নারী পাচার বিরোধী এক সেচ্ছাসেবী সংগঠন এর হাতে।
অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.
শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০
এ এক অন্য বোধন
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়। শুভকামনায়
উত্তরমুছুন